Monday, January 24, 2011

বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাতে আত্মশুদ্ধি ও বিশ্বের কল্যাণ কামনা

র্মপরায়ণ মুসলি্লদের আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে গতকাল রবিবার দুপুরে শেষ হয়েছে তাবলিগ জামাতের প্রথম পর্বের তিন দিনের বিশ্ব ইজতেমা। বৃহত্তর ঢাকাসহ ৩৩ জেলার মুসলি্লরা এ পর্বে অংশ নেন।

চার দিনের বিরতির পর ৩১ জেলার মুসলি্লদের নিয়ে ২৮, ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি এ ময়দানেই অনুষ্ঠিত হবে ইজতেমার শেষ পর্ব। গতকাল আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে ভোর থেকে টঙ্গীর চারপাশ থেকে সমবেত হন মুসলি্লরা। দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে শুরু হয় আখেরি মোনাজাত। মুহূর্তেই টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান ও তুরাগতীরবর্তী কয়েক কিলোমিটার এলাকা পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে আসে। মাঠ থেকে ইথারে ভেসে আসে আল্লাহর দরবারে শত মিনতি আর অশ্রুপূর্ণ ফরিয়াদ।
এবারও আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের অন্যতম নীতিনির্ধারক দিলি্লর নিজামুদ্দীনের মাওলানা যোবায়েরুল হাসান। ২০ মিনিট স্থায়ী মোনাজাতে তিনি ব্যক্তিজীবনের পরিশুদ্ধি, মুসলিম উম্মাহ ও বিশ্বমানবের কল্যাণ কামনা করেন। তাঁর অনুসরণে করজোড়ে লাখো মুসলি্ল রাস্তায়, নৌকায়, ঘরের চালে, বাসার ছাদে বসে কেবল আমিন আমিন বলেন।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই ধর্মীয় সমাবেশ ও আখেরি মোনাজাত ঘিরে দেশ-বিদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলি্লরা সমবেত হন। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয়
নেতা খালেদা জিয়াসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। মোনাজাত শুরুর আগ পর্যন্ত বৃদ্ধ, প্রৌঢ়, কিশোর, যুবক_নানা বয়সের মানুষ ছুটে আসে ময়দানের দিকে। দক্ষিণে র‌্যাবের প্রধান কার্যালয় ও উত্তরে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ছিল মুসলি্লদের স্রোত। আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে উত্তরা, টঙ্গী ও গাজীপুর এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, অফিস-আদালত প্রায় বন্ধ ছিল। সরকারি ঘোষণা না থাকলেও রাজধানীর অফিস-আদালত ছিল অনেকটা ফাঁকা। বাংলাদেশ বেতার ও কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আখেরি মোনাজাত সরাসরি সম্প্রচার করে।

আখেরি মোনাজাতের সংক্ষেপ
মাওলানা যোবায়েরুল হাসান আখেরি মোনাজাতে আল্লাহর দরবারে ইজতেমায় উপস্থিত সব হাতের হেদায়েত কামনা করেন। মিনতি কণ্ঠে তিনি বলেন, 'যাঁরা হাত ওঠালেন, তাঁদের কবুল করুন, সবার হেদায়েতের ফয়সালা করুন।'
আবেগতাড়িত কণ্ঠে মাওলানা যোবায়েরুল বলেন, 'হে আল্লাহ, আমাদের, আমাদের মা-বাবার, সারা বিশ্ববাসীর হেদায়েত দিন। যাঁরা জীবিত আছেন, তাঁদের মাফ করে দিন। যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁদের ক্ষমা করে দিন। আপনার মকবুল (উত্তম) বান্দা হিসেবে আমাদের কবুল করে নিন। দুনিয়ার যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে আমাদের বাঁচান। চরিত্র ভালো করে দিন। আপনার আদর্শমতো চলার তৌফিক দিন।' দীর্ঘ মোনাজাতে তিনি সারা বিশ্বের মুসলমানদের রক্ষা করার আবেদন জানান। হিংসুকের হিংসা, শত্রুর শত্রুতা দূর করে মুসলমানদের কদম ইসলামের ওপর দৃঢ় করতে আল্লাহর দরবারে সামর্থ্য কামনা করেন।

মুসলি্লর চাপ কমেছে সামান্য
মুসলি্লদের জায়গার সংকুলান না হওয়া এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মুসলি্লদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে তাবলিগ জামাত কর্তৃপক্ষ এ বছর থেকে দুই পর্বে ইজতেমা করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এ সিদ্ধান্তে মুসলি্লদের চাপ সামান্য কমলেও ইজতেমায় জনদুর্ভোগের ক্ষেত্রে দৃশ্যত কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েনি। বিশেষ করে অজু ও গোসলের পানির সংকটে মুসলি্লরা কষ্ট পেয়েছেন।
মিরপুর ৭ নম্বর থেকে ইজতেমায় আসা কাঁচামালের ব্যবসায়ী আরিফ হোসেন বলেন, 'এবারের ইজতেমায় কমপক্ষে গতবারের চার ভাগের এক ভাগ মানুষ কম হয়েছে।' আবদুল্লাহপুর সড়কে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, 'গত বছর এ জায়গায় গলায় গলায় জড়িয়েও হাঁটতে পারিনি। এবার হাঁটতে পারছি।' আরিফ জানান, ২০ বছর ধরে তিনি ইজতেমায় আসছেন।
গতকাল ফজর নামাজের পর বয়ান করেন তাবলিগের মুরবি্ব মাওলানা জমির উদ্দিন। সকাল ৯টা থেকে আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত তাবলিগ জামাতের ছয় মৌলিক নীতিমালার (কালেমা, নামাজ, ইল্ম, জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন, তাসহিহে নিয়ত) মর্মার্থ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন শীর্ষ মুরবি্ব মাওলানা সাদ। বাংলায় তা ভাষান্তর করে শোনান হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ যোবায়ের।

সকালে যানবাহনশূন্য, বিকেলে যানজটের দুর্ভোগ
সকালে ইজতেমায় যেতে যানবাহনশূন্যতায় দুর্ভোগ পোহান মুসলি্লরা। বিকেলে ওই রাস্তায় যানজটে পড়ে আবার দুর্ভোগ নিয়েই বাড়ি ফিরেছেন তাঁরা। ইজতেমা উপলক্ষে গতকাল ভোর থেকেই একদিকে মহাখালী, অন্যদিকে গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে সব ধরনের যাত্রীবাহী যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় শেষ সময়ে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ মুসলি্ল দলে দলে হেঁটে মোনাজাতে শরিক হন। কিছুসংখ্যক মুসলি্ল ভ্যানে ও মোটরসাইকেলে চড়ে ইজতেমায় অংশ নেন। পুলিশ বারিধারার স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় ব্যারিকেড দিয়ে প্রাইভেট কার চলাচলও নিয়ন্ত্রণ করে। মোটরসাইকেল ছাড়া ওই রাস্তায় অন্য কোনো যানবাহন চলাচল করতে দেওয়া হয়নি। রাস্তায় যাত্রীবাহী কোনো যানবাহন না থাকায় মুসলি্লরা দুর্ভোগে পড়েন। অনেকে চড়া ভাড়ায় রিকশাভ্যানে চড়ে গন্তব্যে ফেরেন। সন্ধ্যার পর 'গেটলক' বলে চড়া ভাড়ায় এ রুটের যানবাহনগুলো যাত্রী পরিবহন করে।
যানজট ঠেকাতে উত্তরা, আবদুল্লাহপুর, টঙ্গী, স্টেশন রোড, মিলগেট, চেরাগ আলী মার্কেট, বোর্ডবাজার, জয়দেবপুর চৌরাস্তাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে শনিবার রাতেই র‌্যাব, পুলিশ ও আনসার মোতায়েন করা হয়। কিন্তু ইজতেমা শেষ হওয়ার কিছু পর ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। টঙ্গীর চেরাগ আলী মার্কেট স্ট্যান্ডে থাকা বেশ কিছু খালি ট্রাক যাত্রী বহনের জন্য এলোমেলো করে রাস্তায় দাঁড়ালে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। টঙ্গী রেলস্টেশনেও মুসলি্লরা ভিড় করেন। বগিতে উঠতে না পেরে অনেকে ছাদে ওঠেন। স্থানীয় বাসিন্দারা মুসলি্লদের ট্রেনের ছাদে উঠতে 'মই' ভাড়া দেন।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার অংশগ্রহণ
রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান মূল বয়ানমঞ্চে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবদুল্লাহপুর পলওয়েল কনভেনশন সেন্টারের ছাদে এবং বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া টঙ্গীর এটলাস মোটরসাইকেল ফ্যাক্টরির ছাদে বসে আখেরি মোনাজাতে শরিক হন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এনামুল হক, সংসদ সদস্য কে এম মোজাম্মেল, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও জাহিদ আহসান রাসেল, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব এম এ করিম, প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদ উপস্থিত ছিলেন।
বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, ভাইস চেয়ারম্যান বেগম সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যাপক এম এ মান্নান ও রুহুল আলম চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, অর্থবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক মাসুদ আহমেদ তালুকদার, মহিলা দলের সভাপতি নূরে আরা সাফা, সাধারণ সম্পাদক শিরীন সুলতানা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

মাইক নিয়ে অসন্তোষ
মাঠের বাইরে পর্যাপ্ত মাইক না থাকায় এবার আখেরি মোনাজাতে অংশ নেওয়া মুসলি্লরা বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। আবদুল্লাহপুর, উত্তরা ও আজমপুরে অনেক মুসলি্ল পরস্পর দেখাদেখি মোনাজাত ধরেছেন, আবার মোনাজাত ছেড়েও দিয়েছেন। ইজতেমায় বয়ান শোনার জন্য এবার মাঠের বিভিন্ন স্থানে দেড় শ ছাতা মাইক ও পাঁচ শতাধিক লম্বা মাইক টাঙানো হয়। কিন্তু আবদুল্লাহপুর, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মাইক দেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় মুসলি্লরা অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
উত্তরার কাঁচাবাজার এলাকার বাসিন্দা শফিউল্লাহ নাতিকে নিয়ে আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে আসেন। টঙ্গী সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে চরম বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'অন্তত আজমপুর পর্যন্ত মাইক দেওয়া উচিত ছিল। মাইক না থাকায় অনেকে মোনাজাতে শরিক হতে পারবে না। ফলে লাখ লাখ মানুষের কষ্টটাই বৃথা যাবে।'

নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে
বিশ্ব ইজতেমায় নারীদের অংশগ্রহণ নিরুৎসাহিত করা হয়। এর পরও কয়েক বছর ধরে ইজতেমায় নারী মুসলি্লদের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। গতকাল ময়দানের দক্ষিণে আবদুল্লাহপুর সড়ক ও উত্তরা এলাকায় পুরুষদের পাশাপাশি চাটাই ও পলিথিন বিছিয়ে বিপুলসংখ্যক নারী মুসলি্লকে আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে দেখা যায়।
মিরপুর ১০ নম্বর থেকে হেঁটে ইজতেমায় আসেন সুফিয়া খাতুন। চার বছর ধরে তিনি আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। ভাইকে সঙ্গে নিয়ে সকাল ৬টায় তিনি বাসা থেকে বের হন। সাড়ে ১০টায় আবদুল্লাপুর পেঁৗছেন। লাখো মুমিনের সঙ্গে মোনাজাতে অংশ নিতে পারা বড় পুণ্যের কাজ বলে তিনি মনে করেন। অবশ্য তাবলিগ জামাতের একজন মুরবি্ব আখেরি মোনাজাতে নারী-পুরুষের অবাধ অংশগ্রহণ থাকলে ইজতেমায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন।

চার মুসলি্লর মৃত্যু
শনিবার রাতে ইজতেমার প্যান্ডেলে মালয়েশিয়ার এক নাগরিকসহ চারজন মুসলি্ল মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁরা হচ্ছেন মালয়েশিয়ার নাগরিক আবু বকর বিন মনছুর (৬৩), চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকার ফরিদ উদ্দিন (৬০), সিলেটের গোয়াইনঘাট এলাকার মো. মুসা মিয়া (৭০) ও ভোলার লালমোহনের ওয়াজিউল্লাহ (৫৮)। এর আগে সড়ক দুর্ঘটনা ও হৃদরোগে এক পুলিশ কনস্টেবলসহ আরো চারজন মারা যান।
মালয়েশিয়ার নাগরিক আবু বকর বিন মনছুরের লাশ জানাজা শেষে ইজতেমা মাঠেই দাফন করা হয়। বাকিদের লাশ নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মাঠের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা শুরু আজ
প্রথম পর্বের মোনাজাত শেষ হওয়ার পর আজ সোমবার থেকে আবার স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ শুরু হবে। মাঠ প্রস্তুতবিষয়ক জিম্মাদার আবদুল কুদ্দুছ জানান, এ কয়েক দিনে মাঠে প্রচুর আবর্জনা জমা হয়েছে। এগুলো পরিষ্কার করে দ্বিতীয় পর্বের মুসলি্লদের জন্য মাঠ প্রস্তুত করতে হবে। অজুখানা, পায়খানা, প্রস্রাবখানা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে হবে।
ইজতেমায় আসা বিদেশি মুসলি্লদের বেশির ভাগই দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শেষে নতুন জামাতবন্দি হয়ে বিভিন্ন দেশে তাবলিগে যাবেন। আন্তর্জাতিক নিবাসের নিরাপত্তা পাসের দায়িত্বে থাকা জিন্মাদার প্রকৌশলী মুহিব উল্লাহ জানান, বিদেশি মেহমানরা আপাতত কাকরাইল ও রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদে দাওয়াতি কাজ করবেন। তাঁরা দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায়ও অংশ নেবেন।

No comments:

Post a Comment