Monday, January 24, 2011

মহাজোট সরকারের দুই বছর এখন প্রয়োজন কম কথা বেশি কাজ

০০৮-এর ডিসেম্বর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান মহাজোট সরকার ভোটযুদ্ধে জয়লাভ করেছে। পাঁচ থেকে দুই গেলে থাকে তিন। যে সম্ভাবনার এবং স্বপ্নের জাল বুনেছিল প্রায় পনের কোটি মানুষের মনে, সেই স্বপ্নের জাল বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে।

সুতরাং দুই বছরের সাফল্য নিয়ে নানাজনের নানা মত। আলোচনা হচ্ছিল নানা টেবিলে। একজন শহীদের স্ত্রী বলেন, "সফলতার বীজ বুনতে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগবে খালেদা জিয়ার হাত থেকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি উদ্ধার, কেননা '৭৫-এর পট-পরিবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর পরিবারসহ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বাংলার মাটিতে শুরু হয়েছিল সেই ষড়যন্ত্রের একটি খুঁটি উপড়ে ফেলা হয়েছে।" সুতরাং নানাভাবেই নানাজন সফলতা দেখতে চাইবে। সেই সঙ্গে আমাদের বিফলতা বা না পারার অংকের হিসাবও পাশাপাশি মিলিয়ে নিতে হবে। তা না হলে ২০১৪ সালের অগি্নপরীক্ষায় এই সফলতা দিন বদলের পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে। মনে রাখা দরকার কোন্ পরিস্থিতি মহাজোট সরকার গঠিত হয়েছিল। সমগ্র দেশ জঙ্গীবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও গভীর ষড়যন্ত্রের জালে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল । আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল বাংলার মাটিতে।

দলতন্ত্র-পরিবারতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে বিরোধীদলকে গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেবার নীল-নকশা তৈরি করা হয়েছিলো রাষ্ট্রের সবের্াচ্চ পর্যায়ে । প্রগতিশীল শক্তিকে নস্যাৎ করে দেবার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা এবং লুটপাট, দুর্নীতি সমগ্র প্রশাসনকে স্থবির করে ফেলেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সকল চেতনাকে নির্বাসিত করার বিভিন্ন কায়দা-কানুন ইতিহাস বিকৃতি খেলা চলছিল । নারীকে অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলার লক্ষ্যে ধর্মকে ব্যবহার করে নারীর সকল অর্জনকে বন্দী করার পাঁয়তারা করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার । সেই রকম একটি অবস্থা থেকেই নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে এক আন্দোলন শুরু হল । সেই আন্দোলনেরই এক পর্যায়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে রাষ্ট্রপতি দেশের গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করল এবং দুই বছর সামরিক শাসকদের ছায়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালিত হয়। পরবতর্ীতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই মহাজোট সরকার নির্বাচিত হল । জনগণের সামনে প্রত্যাশা ছিল দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, যুুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, বঙ্গবন্ধুর হত্যার রায় কার্যকর করে এই দেশ ও জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করে এক অন্ধকার অতল গহ্বরে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে উঠে দাঁড়াবার জন্যই জনগণ ভোট দিয়েছিল। ভোট দিয়েছিল এবারে যারা প্রথম ভোটার হয়েছে এবং নারীরা। একটি গুমোট আবহাওয়া থেকে খোলা বাতাসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল মহাজোট সরকারের ক্ষমতা আরোহণের মধ্যদিয়ে। দু'বছরের বিভিন্ন কার্যক্রম দেখতে গেলে অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া জাতির জন্য সামনের এগিয়ে যাবার দিক বদলের কিছু নির্দেশনা দু'বছরে লক্ষ্য করা গেছে।

এক নজরে আমরা যদি দেখি

জনগণের কাছে সকল তথ্য পেঁঁৗছে দেয়ার লক্ষ্যে এবং তথ্য পাওয়া একটি গণতান্ত্রিক অধিকার হিসাবে বিবেচনায় এনে অবাধ তথ্যপ্রবাহের লক্ষ্যে তথ্য কমিশন গঠিত হয় এবং তথ্য অনুমোদন আইন হয়েছে ২০০৯-এর শুরুতে। যে দেশে জমি কম মানুষ বেশি সে দেশের জন্য কৃষিখাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কৃষিনীতি ঘোষণা করে সেখানে অনেকগুলো বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সারের মূল্য হ্রাস, ডিজেলের মূল্য হ্রাস, কৃষি ও তথ্য প্রযুক্তি জনগণের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দেয়া, তার জন্য কমিউনিটি রেডিও চালু করা, বেতার ও টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান প্রচারের বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ, কৃষি তথ্য সার্ভিসের ই- কৃষি কার্যক্রমের আওতায় কৃষকদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত ও পরামর্শ পাবার সুযোগ এবং অনলাইনে কৃষিতথ্য সেবা পেঁৗচ্ছে দেবার কার্যক্রম হাতে নিয়ে এক বিশাল দিক উন্মোচন করা হয়েছে। বিএডিসি বিভিন্ন অঞ্চলে কার্যক্রম বৃদ্ধি করে স্থানীয় জনপ্রিয় উন্নতমানের ধানের বীজ সরবরাহ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কৃষি কার্ড প্রবর্তন করে তার মাধ্যমে সেচ ও ডিজেলের সহায়তা দেবার জন্য ১০ টাকায় কৃষকের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ করে দিয়ে এক যুগান্তকারী সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এজন্য ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। কৃষক তার একটি সামাজিক মর্যাদা পেয়েছে। পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী সাফল্য অর্জনের দ্বার উম্মোচিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তাকে মোকাবিলা করার জন্য যে সকল কর্মসূচি এ সকল কিছুই এগিয়ে যাবার এক দিক-নির্দেশনা। একটি গণমুখী সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের উদ্যোগ একটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন ছিল। ধর্মীয় অনুশাসন, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির সামনে বারবারই হোঁচট খেতে হয়েছে এই গণমুখী শিক্ষানীতিকে। কিন্তু বর্তমান সরকার প্রায় সকলের মতামত নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি- ২০১০ অনুমোদন করেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করে শহর ও গ্রামের ব্যবধান কমিয়ে এক আধুনিক জাতিতে পরিণত করার উদ্যোগ তৈরি হয়েছে। '৭১-এর ১০ এপ্রিল জারিকৃত ঘোষণাপত্র এবং ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ শিক্ষানীতিতে যুক্ত করেই ইতিহাস বিকৃতির পথকে রুদ্ধ করা হয়েছে। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, উপবৃত্তি, ফলাফল ঘোষণায় প্রযুক্তির ব্যবহার ধীরে ধীরে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাবার পথ তৈরি করেছে। দু'বছরের বাজেট শ্রমিক-কৃষক-নারী-অতিদরিদ্র মানুষের কথা ভেবে রাষ্ট্রের দায়িত্বের অনেক দিক উন্মোচিত হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তার জাল বিস্তৃত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে এই সরকার। দীর্ঘ বছর ধরে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-এর প্রচারণায় মুক্তবাজার অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পণের যে নীতিমালা ছিল সেখান থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা হলেও রাষ্ট্র বাজারশক্তিকে নিয়মে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। হতদরিদ্র, বৃদ্ধ, অসহায়, বিধবা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বিভিন্ন ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যদিয়েও একটি দিন বদলের নির্দেশনা বুঝতে পারা যায়। শ্রম আইন-২০০৬-কে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে বিভিন্ন মতামত নিয়ে খসড়া তৈরি হয়েছে। পোশাক শিল্পের সুবিধার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ, গৃহ-শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে খসড়া নীতিমালা, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যুব সমাজের বেকারত্ব ঘুচাতে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ন্যাশনাল স্কিল ডেভলপমেন্ট কাউন্সিল (এনএসডিসি ) , নূ্যনতম মজুরি বোর্ড বিভিন্ন সেক্টরে মজুরি ঘোষণা করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি পোশাক শিল্প। পোশাক শিল্পের রপ্তানি আয় বাংলাদের গর্ব। ৩৫ লক্ষ শ্রমিক এখানে কাজ করছে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্নতম মজুরি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে। ১৬৬২.৫০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা নূ্যনতম মজুরি নির্ধারণ করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়েছে। শ্রমিক-মালিক সরকারের সমন্বয়েই উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। সেক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন হ্রাস শ্রমিকদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, বিক্ষোভ দমনে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট টিমই যথেষ্ট নয়, স্ব স্ব কারখানার নির্বাচিত প্রতিনিধি সফলতার চাবিকাঠি। নতুন বছরের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় ব্যবসায়ী মহলের উদ্দেশ্যে বলেছেন, শ্রমিকদের সুখী রাখলেই উৎপাদন বাড়বে, সরকারের এই দিক-নির্দেশনাই শ্রমজীবী মানুষের জন্য জরুরি। একদিকে দ্রব্যমূল্যের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা ঠিক একই সাথে আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা জরুরি। একদিকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন অন্যদিকে সেই বাহিনীর হাতে পুলিশ হেফাজতে বিচার বহিভর্ূত হত্যাকাণ্ডে মানুষের মৃতু্যবরণ দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে জ্বালাও-পোড়াও যেমন বন্ধ করতে হবে। কারা এর হোতা সেটা বের করতে যেয়ে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার অপপ্রয়াস স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘাড়েই দোষ চাপায়। এ সকল বিষয়ে 'সতর্ক পা' ফেলা সরকারের জন্য জরুরি। অভিবাসী শ্রমিকেরা অর্থনীতিতে আজ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে । বিশ্বের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অংশগ্রহণ এই দু'বছরে যেমন বৃদ্ধি হয়েছে তেমনি কিছু কিছু চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন হয়েছে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনা এবং দূতাবাসসমূহের দক্ষতাই এক্ষেত্রে আরো সফলতা বয়ে আনতে পারে। বিশ্ব শ্রমবাজারে নারীদের কাজের সুযোগ হয়েছে অনেক । ফলে নারীদের নিরাপত্তা এবং প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে পারলে শ্রমবাজার সম্প্রসারিত হবে। কৃষিশ্রমিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকেরা এখনও শ্রম আইনের বাইরে রয়েছে। এদের জন্য আইন তৈরির উদ্যোগ সফলতার দ্বার উন্মুক্ত করতে সাহায্য করবে। বাংলার মাটিতে আদিবাসীরা বৃহৎ গোষ্ঠী । যারা তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে ইতিমধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এর বৃহৎ অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম পার্বত্য শান্তিচুক্তির মধ্যদিয়ে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন করেছিল। বিগত সরকারের সময়ে এ চুক্তি প্রায় অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে আবার আলাপ-আলোচনার মধ্যদিয়ে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আবার একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে।'কারো সাথে শত্রুতা নয় সবার সাথে বন্ধুত্ব'_এই নীতিতে চলিস্নশ বছর ধরে দেশ পরিচালিত হবার পরও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি বিগত দিনগুলোতে বন্ধুত্বের কথা মুখে বলে শত্রু শত্রু খেলায় ব্যস্ত ছিল বিভিন্ন সরকার। গত দু'বছরে পররাষ্ট্র নীতিতে সে দিকটি পরিবর্তিত হয়েছে। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং জাতীয় স্বার্থের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করার এক মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে । ভারত থেকে চীন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে মায়ানমার এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা । সফলতার দিক উন্মোচিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। দীর্ঘদিনের আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের বন্দী হয়ে থাকা অনেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে গুরুত্বপূর্ণ অনেক আইন তৈরি হয়েছে। সমগ্র নারী সমাজ সম-অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি যে নারী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল সেখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল '৯৭ সালের নারী উন্নয়ন নীতি। আমরা লক্ষ্য করছি ২০০৪ সালে এ নীতি অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল। অধিকার, মর্যাদা ও কর্তৃত্ববিহীন এক নারী নীতি ঘোষণার যড়ষন্ত্র চলছিল যা সকল নারীই প্রত্যাখ্যান করেছে। এ সরকার আবারও উদ্যোগ নিয়েছে ১৯৯৭ সালের নারী নীতিকে যুগোপযোগী ঘোষণার চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত করতে। সারা বছরই আমরা দেখেছি নারী হত্যা, খুন, অপহরণ এবং নতুন কায়দায় ইভটিজিংয়ের নামে নারীর উপর নির্যাতনের নামে নতুন যারা প্রতিবাদ করেছে তাদের উপরও নেমে এসেছে নির্যাতন এবং অনেক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যদিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিলেও এখনো সংকট কাটানো যায়নি। নারীদের উপর এই সহিংসতা পরিবারেও ঘটে চলছে। ইতিমধ্যে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে একটি আইন পাস হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে ঘোষিত কর্ম - শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে নীতিমালা প্রণয়ন সে কাজও এগিয়ে চলছে।

সরকারের দু'বছরে ঘূর্ণিঝড় আইলা এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচী, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি হয়েছে। মঙ্গাপীড়িত জেলাসমূহের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করায় ২০১০ সালে তেমন সংকট এ জায়গাগুলোতে দেখা যায়নি। বিবিধ পর্যায়ে নানা ধরনের সাফল্যের কথা আরো বিস্তারিত বলা যেতে পারে কিন্তু যে বিষয়গুলো সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে সেদিকে দৃষ্টিপাত করা দরকার। দ্রব্যমূল্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১০ টাকা বা ২০ টাকা চালের বিতর্ক নয়, বিষয়টি অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহ মানুষের সাধ্যের আওতায় রাখাটাই সরকারের কাজ। অবাধ বাণিজ্যের সিন্ডিকেট বছরের পর বছর সরকার এবং জনগণকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েই চলছে। এক্ষেত্রে সরকারের খবরদারি আরো কঠোর হওয়া জরুরী। ওএমএস ও পূর্ণাঙ্গ রেশন ব্যবস্থা (চাল, ডাল, আটা, চিনি, কেরোসিন, লবণ, তেল) চালু এ সমস্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক । এছাড়া টিসিবিকে কার্যকর করার পথে সকল বাধা দূর করা জরুরী। এ সরকার বিদু্যতের ক্ষেত্রে এসেই ঘোষণা দিয়েছিল কিন্তু সমন্বয়হীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধীরগতি বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গায় আঘাত করেছে। চাঁদাবাজি, দলবাজি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরেও অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ করা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে ভর্তি ও নিয়োগ পরীক্ষাসহ অনেকক্ষেত্রে প্রশাসন নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। অতিদ্রুত বিদু্যৎ, দ্রব্যমূল্য এবং যানজট নিরসনে আরো দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ কাজে নেমে যাবার মধ্যেই সফলতা নিহিত। এসকল কাজের মধ্যেও সরকারকে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হয়েছে তাহলো বঙ্গবন্ধুর হত্যার রায় কার্যকর করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম শুরু করা এবং সংবিধানে গুরুতপূর্ণ সংশোধন আনা। বঙ্গবন্ধুর হত্যার রায় কার্যকর করে এ সরকার জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছে। আগামী প্রজন্মের কাছে এক পাপমুক্তির বার্তা ঘোষণা করেছে। দীর্ঘদিনের আত্মস্বীকৃত খুনীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেশে-বিদেশে আস্ফালন করেছে। বুক ফুলিয়ে বলেছে 'ন্যায্য কাজটি তারা করেছে'। এই ঔদ্ধত্য জাতি বরদাশত করেনি। দীর্ঘদিন পরে হলেও সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যায়কারীরা কখনও পার পাবে না, ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়। সেই পথ ধরে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ পরবতর্ী সময়ে যে সকল যুদ্ধাপরাধী মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অপরাধ করেছিল, হত্যা,ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদি সংঘটিত করেছিল তারা ভেবেছিল পার পেয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তারই পথ ধরে বাংলাদেশের বুকে আজ এ সকল ঘাতক-দালালদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে ট্রাইবুনাল গঠন হয়েছে। বিচারক এবং আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। তদন্তের ভিত্তিতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে গ্রেফতার হয়েছে নিজামী, সা্ঈদী, মুজাহিদসহ আরো অনেকে। এই বিচার কার্য অতি দ্রুত শুরু হোক জাতি তা দেখতে চায়।'৭৫-পরবতর্ী যে রাজনীতি শুরু হয়েছিল তা ছিল ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। নীতিহীন, মূল্যবোধহীন, ভিন জাতির সংস্কৃতি এবং হত্যা ও কু্য-এর রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা হল কর্ণেল তাহেরকে। যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের পুনর্বাসিত করা হল। রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হল। এই ছিনিমিনি খেলা খেলতে হাজার হাজার সৈনিককে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা হল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টায় পাঠ্যপুস্তকসহ অনেক কিছু বদলে ফেলা হল। অবৈধ ক্ষমতা দখলের মধ্যদিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিনতাই হল। সামরিক শাসন জারি এবং সামপ্রদায়িক রাজনীতি বেগবান হল। এ সবকিছুকে বাতিল করে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাষ্ট্র ও দেশকে পুনর্গঠনের জন্য সংবিধান সংশোধন কমিটি গঠিত হল সংসদে। তাই সংবিধান সংশোধনের মধ্যদিয়ে জাতি আবার ফিরে পাবে অতীত, গৌরব ও সম্মান। যুগোপযোগী আরো সংশোধনের মধ্যদিয়ে জনগণের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ বাস্তবায়িত হবার পথ উন্মুক্ত হবে। এ কাজটি করতে হাইকোর্টের দুই রায় পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিলের ঘোষণা সহজ করে দিয়েছে যাত্রাপথ। কিন্তু এই সফলতার পথ বেয়ে এগোতে হলে প্রয়োজন মহাজোটের ঐক্যকে 'চোখের মণি'র মত লালন করা। দু'বছরে এই ঐক্য বিস্তৃতি লাভ করতে পারেনি জেলা পর্যায় পর্যন্ত । অনেক ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে আরো উপযুক্ত কৌশল নিতেও ব্যর্থ হয়েছে সরকার। 'একলা চলো নীতি'- ধাঁচ যদি না কমানো হয়, ঐক্যকে জোরালো না করা যায় তবে এই সফলতার অংশীদারিত্ব জাতির কাছে বড় করে তোলা দুরূহ হবে। তাই আর সময়ক্ষেপণ নয়, প্রয়োজন কম কথা, বেশি কাজ। প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ পরিকল্পিত নীতিমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ।

No comments:

Post a Comment