Monday, January 24, 2011

সিদ্ধিরগঞ্জে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে নিহত ১

চাকরি স্থায়ীকরণ ও মজুরি বাড়ানোর দাবিতে গতকাল রোববার নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পুলিশের গুলিতে এনামুল হক (২৫) নামের এক শ্রমিক নিহত এবং ১৫ জন আহত হয়েছেন বলে শ্রমিকেরা অভিযোগ করেছেন। তবে পুলিশের দাবি, শ্রমিকদের ইটপাটকেলের আঘাতে এনামুলের মৃত্যু হয়েছে।

দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা হামলা চালিয়ে কারখানার প্রতিটি বিভাগ তছনছ করেন। ভাঙচুর করেন ১২টি গাড়ি। পুরো কারখানা পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। শ্রমিকদের ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হয়েছেন ১০ পুলিশ সদস্য, পথচারী, শ্রমিকসহ অন্তত শতাধিক ব্যক্তি।
সংঘর্ষের সময় শ্রমিকেরা প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) ইশতিয়াক আহম্মেদকে মারধর ও অবরুদ্ধ করে রাখেন। এক ঘণ্টা পর তাঁকে গুরুতর আহতাবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। কারখানার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি।
নিহত এনামুলের বাড়ি রংপুর জেলায়। তিনি নারায়ণগঞ্জ শহরের হাজীগঞ্জ এলাকায় একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। এসিআই ওষুধ কারখানায় অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
গতকাল রাত সোয়া আটটায় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে নিহত এনামুলের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁর মুখ ও বুকে অনেকগুলো রাবার বুলেটের চিহ্ন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল পানিরকল এলাকায় অবস্থিত এসিআইয়ের ওষুধ কারখানায় ১৬৭ জন স্থায়ী শ্রমিক ও ৬০০ অস্থায়ী শ্রমিক কাজ করেন। গত বৃহস্পতিবার স্থায়ী এক শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে দাবি করে অস্থায়ী শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে তাঁরা মজুরি বাড়ানোর দাবি জানান। অস্থায়ী শ্রমিকদের দৈনিক ১২০ থেকে ১৪০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। শ্রমিকেরা এই মজুরি ২৫০ টাকা করার দাবি জানান।
দাবি আদায়ে অস্থায়ী শ্রমিকেরা গতকাল সকালে কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাঁরা কারখানার ভেতরে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করেন। শ্রমিকেরা তাঁদের দাবি আদায়ে অনড় থাকেন। একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) ইশতিয়াক আহম্মেদকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। তাঁরা কারখানার দুটি ইউনিটে (এনিমেল ড্রাগস ও হিউম্যান ড্রাগস) ভাঙচুর চালান। এতে আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে বেলা ১১টায় ঘটনাস্থলে যায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পুলিশ। এ সময় আন্দোলনরত শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করে। শ্রমিকেরা পাল্টা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ও ওষুধের কাচের বোতল নিক্ষেপ করেন। শুরু হয় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ। শ্রমিকেরা কারখানার ভেতরে সাতটি মাইক্রোবাস, তিনটি কাভার্ড ভ্যান, একটি পিকআপ ভ্যান ও একটি প্রাইভেট কার ভাঙচুর করেন। দফায় দফায় চলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া আর সংঘর্ষ।
পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এতে অন্তত ১৫ জন গুলিবিদ্ধ হন। তাঁদের শহরের খানপুরে অবস্থিত ২০০ শয্যাবিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে পাঠানো হয়। দুপুর সাড়ে ১২টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় কারখানার অস্থায়ী শ্রমিক এনামুলের মৃত্যু হয়।
আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আর্মড পুলিশের নায়েক মনির হোসেন, কনস্টেবল হেলাল এবং ২৬ শ্রমিককে শহরের ২০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহত অন্যদের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
গতকাল বেলা তিনটায় গিয়ে দেখা যায়, পুরো কারখানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কারখানার জানালার কাচ, চেয়ার, টেবিলসহ আসবাব, কম্পিউটার, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করা হয়েছে। প্রতিটি কক্ষই ছিল তছনছ। কারখানা পাহারা দিচ্ছিল পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা। কারখানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শ্রমিক সোহেল, ময়না, সজীব ও মামুন জানান, ‘আমরা মূল মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫০ টাকা করার দাবি করছিলাম। কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ আমাদের দাবি মেনে নেয়নি। দাবি আদায়ে আন্দোলন করলেই শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়। ১৫ বছর ধরে চাকরি করছেন এমন অনেক শ্রমিক আছেন, যাঁদের চাকরি এখনো স্থায়ী করা হয়নি। এসব দাবিতে কয়েক দিন ধরে আমরা কারখানায় শান্তিপূর্ণভাবে কর্মবিরতি পালন করছিলাম। কিন্তু গতকাল সকালে পুলিশ আমাদের ওপর বেপরোয়া লাঠিপেটা ও গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে আমাদের সহকর্মী এনামুল হক নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হন আরও ১৫ শ্রমিক। আহত হন শতাধিক।’
এসিআই কারখানার সিবিএ সভাপতি নুরুল হক দাবি করেন, পুলিশ নিরীহ শ্রমিকদের ওপর বেপরোয়া লাঠিপেটা ও গুলিবর্ষণ করেছে। তিনি হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।
এ বিষয়ে এসিআই কারখানার আহত কর্মকর্তা ইশতিয়াক আহম্মেদ জানান, শ্রমিকেরা অযৌক্তিক দাবিতে কয়েক দিন ধরে কারখানায় কর্মবিরতি পালন করছেন। গতকাল সকালে শ্রমিকেরা কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর করলে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষ বাধে।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম বদরুল আলম জানান, শ্রমিকেরা কারখানায় ভাঙচুর চালালে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ৩০-৪০টি কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা করে। একপর্যায়ে শ্রমিকেরা লাঠিসোঁটা নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালালে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শতাধিক রাউন্ড রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। তবে পুলিশের গুলিতে এনামুলের মৃত্যু হয়নি। শ্রমিকদের ইটপাটকেলের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
ওসি বদরুল জানান, সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত এনামুলের লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করা হয়নি। সংঘর্ষ, কারখানায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। পুলিশ সুপার বিশ্বাস আফজাল হোসেন জানান, ‘ঘটনাটি শুধুই শ্রমিক অসন্তোষ, নাকি পেছনে কারও ইন্ধন রয়েছে, আমরা তা খতিয়ে দেখছি।’

No comments:

Post a Comment