Thursday, December 02, 2010

স্মরণ: শিক্ষাবিদ সেলিনা বাহার জামান

জ ১ ডিসেম্বর ২০১০। ২০০৪ সালের এইদিনে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতিসেবী সেলিনা বাহার জামান চৌষট্টি বছর বয়সে হূদরোগের চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। সেলিনা বাহার জামান ১৯৪০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা হাবীবুলস্নাহ বাহার, মা আনোয়ারা বাহার চৌধুরী ও ফুফু বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ ছিলেন সে যুগের আলোকিত মানুষের প্রতিনিধি। বাবা-মার জ্যেষ্ঠ সন্তান সেলিনা বাহারের এক ভাই ইকবাল বাহার চৌধুরী ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা সার্ভিসের প্রধান ও আরো তিন বোন শাহীন চৌধুরী-দেশের প্রথম মহিলা স্থপতিদের অন্যতম, অন্য দুই বোন নাসরীন শামস্ ও তাজিন চৌধুরী যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপিকা।
কলকাতায় প্র্যাট মেমোরিয়াল স্কুলে সেলিনা বাহারের স্কুলজীবন শুরু হয়, ৪৭-এর দেশ বিভাগের পরে ঢাকায় এসে কামরুন্নেসা স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা (ম্যাট্রিক) পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯৫৬ সালে ইডেন কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষা দেন, ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশুদ্ধ গণিতে এমএসসিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। অত্যন্ত মেধাবী সেলিনা বাহার ১৯৬১ সালে ইডেন কলেজের গণিতের প্রভাষক হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে বদরুন্নেসা কলেজে গণিতের সহকারী অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। ঐ বছরই প্রকৌশলী বদিউজ্জামানের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। ১৯৭৭ সালে ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ কলেজে গণিতের সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন এবং ১৯৮৪ সাল থেকে ঐ কলেজেই গণিতের অধ্যাপক এবং পরবতর্ীতে বিভাগীয় প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করে ১৯৯৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

ঐতিহ্যবাহী পরিবারের উত্তরাধিকার-পারিবারিক আভিজাত্য ও খ্যাতিমান বাবা-মা'র সানি্নধ্যে ও অনুপ্রেরণায় সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় এবং লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ হন সেলিনা অল্প বয়স থেকে। তাঁর বাবা ও ফুফু চলিস্নশের দশকের মাঝামাঝি সময় কলকাতার 'বুলবুল' পত্রিকা প্রকাশনা ও 'বুলবুল' পাবলিশিং হাউজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেই সময়ে আধুনিক সাহিত্য ধারা সৃষ্টি এবং প্রধানত বাংলা সাহিত্যে আধুনিক মুসলিম সাহিত্যিকদের সাহিত্য চর্চা ও প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে দেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনেক কবিতা ও গান 'বুলবুল' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। নন্দিত সাহিত্যিক শওকত ওসমানের জীবনের প্রথম লেখাও 'বুলবুল' পত্রিকায় ছাপা হয়। পরিবারের এই অনন্য ঐতিহ্য এবং সাহিত্যানুরাগ সেলিনা বাহারকে সংস্কৃতিসেবী, লেখিকা এবং কবি জনরুলের একনিষ্ঠ ভক্ত ও বিশেষ অনুরাগী করে তোলে। সেলিনা বাহার তাঁর নিজের লেখনির মাধ্যমে যেমন আমাদের সাহিত্য জগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন তেমনি তাঁর দক্ষ সম্পাদনায় কাজী নজরুল ইসলামের দুটি বই আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডারে অমূল্য সংযোজন নিঃসন্দেহে। একজন যোগ্য সম্পাদক হিসাবে ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমী হতে তাঁর সম্পাদনায় 'নজরুল পাণ্ডুলিপি' এবং ২০০১ সালে নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত অর্ধ সাপ্তাহিক 'নজরুলের ধূমকেতু' বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এবং নজরুল গবেষকদের কাছে একটি গাইড বিশেষ। সেলিনা বাহার পরবতর্ীতে হাবীবুলস্নাহ বাহার (১৯৯৫), জহুর হোসেন চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৬), আনোয়ারা বাহার চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৭), শামসুদ্দিন আবুল কালাম স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৮), আব্দুল ওয়াহাব মাহমুদ স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৯), শামসুন্নাহার মাহমুদ স্মারকগ্রন্থ (২০০০), বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন স্মারকগ্রন্থ (২০০২), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর তাঁর সম্পাদিত স্মারকগ্রন্থ 'আমায় তুমি অশেষ করেছ' (২০০৪) ইত্যাদি।

সেলিনা বাহার জামানের স্বামী এম বদিউজ্জামান বিসিআইসির অবসর প্রাপ্ত ডাইরেক্টর, পেশায় প্রকৌশলী। দুই ছেলে বড়জন পারভেজ জামান, পেশায় ডাক্তার যিনি ২০০১ সালের মার্চ মাসে লন্ডনে এক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ছোট ছেলে রিয়াজ জামান, কম্পিউটার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তার স্ত্রী ও একটি কন্যা আছে।

তাঁর ষষ্ঠ মৃতু্যবার্ষিকীতে সকলের সাথে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

তারিক রহমান সৌরভ

No comments:

Post a Comment