Saturday, January 29, 2011

বই এবং খানিকটা অথবা অনেকটা সংশয় by শান্তনু কায়সার

র তিন দিন পর ১ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে শুরু হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১১। বইমেলা নিয়ে ‘সাহিত্য সাময়িকীর’ বিশেষ আয়োজন
Remember
First to possess his books, for without them
He is but a sot, as I am.
(The Tempest/Act 3, Scene 2)
উদ্ধৃতাংশটি ক্যালিবান বলছে প্রসপেরোর শত্রুদের উদ্দেশে, কী করে তাকে জব্দ করা যায়।
অন্যদিকে প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে ক্যালিবানই তার প্রভু প্রসপেরোকে বলছে—You taught me language, and/My profit on’t/Is, I know how to curse। অর্থাৎ আপনি আমাকে ভাষা শিখিয়েছেন, তাতে সুবিধা হচ্ছে, আমি এখন জানি কীভাবে অভিশাপ দিতে হয়। এ থেকে বইয়ের দ্বান্দ্বিক সত্যকে বোঝা যায়। ভাষা নিজে ভালো বা মন্দ না হলেও বই কিন্তু নৈর্ব্যক্তিক অথবা নিরপেক্ষ নয়। আমাদের একুশের গ্রন্থমেলার বয়স যেহেতু এখন খুব একটা কম নয়, সেহেতু এটাকে নিয়ে খানিকটা ভাবনা ও বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে।
তার আগে বলি, বাংলা একাডেমীর একুশের ঐতিহ্যের রয়েছে দ্বান্দ্বিক চারিত্র্য। কী করে ভুলি, একজন পরিচালককে (তখনো মহাপরিচালকের পদ সৃষ্টি হয়নি) তাঁর ভুল ভূমিকার জন্য এবং ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবিতা যিনি লিখেছেন, সেই রকম একজনকে স্বৈরাচারী শাসকের মন্ত্রী হওয়ার কারণে বটতলার অনুষ্ঠানমঞ্চ থেকে তুলে দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে স্বৈরাচারী ওই আমলে আহমদ শরীফ বেশ কয়েকবার ২০ ফেব্রুয়ারির বৈকালিক অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে নির্জলা যে সত্য কথা বলতেন, তাতে তৎসম-কণ্টকিত দুরূহতা অতিক্রম করে তা জনসাধারণের এতটাই সানন্দ অনুমোদন পেত যে সমস্ত প্রাঙ্গণ করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠত।
বই যতই প্রিয় হোক, হোক তা পাঠকের প্রেরণা ও অনুপ্রেরণার উৎস, সবাই ত্যাগ করলেও বইয়ের মতো বন্ধু যে পাঠককে ত্যাগ করে না, বরং তাকে ভরিয়ে তোলে; তা সত্ত্বেও প্রকাশকের কাছে বই একটা পণ্যও বটে। তিনি হিসাব করে দেখেন, কী বই, কত দিনে বিক্রি হবে; তাঁর বিনিয়োগ করা অর্থ কত দিনে ফেরত পাওয়া যাবে, আদৌ অথবা কতটা মুনাফা পাবেন এবং এ বই তাঁকে আর কী কী ও কী পরিমাণ দেবে। আমাদের যতই ভালো লাগুক, বাজার অর্থনীতিতে বই তো আর আলাদা কিছু হতে বা পেতে পারে না।
যে প্রকাশক বলেন তিনি মানসম্মত বই প্রকাশে আগ্রহী, তিনিই আবার নানা চাপ ও স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। যে প্রকাশকেরা বলেন, তাঁদের প্রকৃত প্রকাশকের সংখ্যা ৭০-৭২ বা বড়জোর ১০০, তাঁরা একুশে গ্রন্থমেলার আগে দ্বিগুণ/তিনগুণে কী করে পৌঁছান; সেই প্রকাশকেরা যেসব সময় নীতি মেনে চলেন, তা-ও নয়। চাণক্যনীতির সুযোগ নিতে তাঁরাও খুব পিছিয়ে থাকেন না।
সেদিন এক প্রকাশক বলেন, লেখক যদি প্রকাশকের সঙ্গে লিখিত চুক্তির ভিত্তিতে বই না দেন, তাহলে তিনি কী করে আইনি অধিকার দাবি করতে পারেন। কিন্তু আমরা জানি, লেখক দুর্বল পক্ষ। বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে ভাড়াটেকে যেমন জিম্মি হয়ে থাকতে হয়, সাধারণভাবে লেখকের অবস্থাও তা-ই। আর যেসব লেখক ক্ষমতাবান অর্থাৎ অসম্ভব জনপ্রিয়, তাঁদের রয়্যালিটির টাকা তো প্রকাশকেরা বাড়িতে গিয়ে আগামও দিয়ে আসেন। লেখক হলেও তাঁরা ব্যতিক্রম।
মানসম্মত নয় এমন বই প্রকাশ করা আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু মুদ্রণ-বিস্ফোরণের এই সময়ে এর প্রকাশ রুদ্ধ কিংবা অন্তত সীমিত করা যে অসম্ভব, সেকথা বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো মানুষই স্বীকার করবেন। এখন বঙ্কিমের যুগ নয় যে ‘লেখক’রা ‘যশের জন্য লিখিবেন না।’ এই ধরনের ব্যক্তিরা বিশ্বাসও করেন না যে ‘তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভালো হইবে না।’ বঙ্কিম যে বলেছিলেন, ‘যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না, কিছুকাল ফেলিয়া রাখিবেন’—সেই ধৈর্যও সবার নেই। এত সুযোগ থাকতে গ্রন্থকার না হওয়াই বরং মূর্খের কাজ!
অতএব যা ঘটার তা-ই ঘটে। আবুল মনসুর আহমদ ভোট-ভিক্ষুকদের কথা বলেছিলেন, আমরা প্রায়ই বই-ভিক্ষুকদের দেখা পাই। লাইন ধরে তাড়া খাওয়া গ্রন্থকারেরা যেভাবে নিজের বইয়ের কথা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সামনে বলেন, তাতে খাঁটি পাঠকের লজ্জার শেষ থাকে না।
গত কয়েক বছরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে যেভাবে ‘ভালো’ ফল করে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকছে, তাতে সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার বাস্তব পরিস্থিতি কী দাঁড়াচ্ছে, তার নির্মোহ জরিপ হলে বোঝা যেত, সাধারণত পাঠকেরা কী পড়েন বা পড়তে চান। এ অবস্থায় বইয়ের ভালো কাটতি আমাদের সৃজন ও মননচর্চায় কতটা ভূমিকা রাখে বা রাখতে পারে, সে ভাবনাকেও তুচ্ছ করে দেখা যায় না।
অর্থনীতির গ্রেশামস ল যে বলে মন্দ টাকা ভালো টাকাকে তাড়িয়ে দেয়, আমাদের গ্রন্থমেলারও সেই চারিত্র্য দাঁড়াচ্ছে কি না, এখন থেকেই বুঝি তা একটু একটু করে দেখা দরকার। আর এই ফাঁকে সারপ্লাস ভ্যালু তথা উদ্বৃত্ত মূল্য কোথায়, কার পকেটে ঢুকছে, সেটাও জনস্বার্থে দেখা প্রয়োজন।
দুই.
সারা দেশেই নানা গ্রন্থাগার রয়েছে। গ্রন্থাগারগুলো কতটা ভালো চলছে কিংবা সৎ ও অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের কাছে পৌঁছাতে পারছে কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষত নিচের পর্যায়ে গ্রন্থাগারের প্রকৃত ভূমিকার কথা কেউ আর ভাবেই না। দুর্বৃত্তায়িত নানা পথে এসব ক্ষেত্রে যে বইগুলো কেনা হয়, শিক্ষার্থীদের বোধহয় সেসব বই না পড়াই ভালো। তাতে অন্তত তাদের পক্ষে দূষণমুক্ত হওয়া অথবা থাকা সম্ভব। আর সাধারণ ও গণগ্রন্থাগারগুলোর পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচিত ব্যক্তিদের কাছে পঠন-পাঠন কোনো বিষয় নয়, বিষয় হচ্ছে সামাজিক মর্যাদা রক্ষা ও কর্তৃত্বের প্রকাশ।
কিন্তু কী হওয়া উচিত ছিল বা কী হতে পারত, তার একটি পুরোনো উদাহরণ দেওয়া যায়। ১৯১৩ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরির সভাপতি ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু এর সভাপতি ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯১১ সাল থেকে আমৃত্যু এই গ্রন্থাগারের সহসভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ঐতিহ্য, উত্তরাধিকার ও বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র বইয়ে শ্যামল চক্রবর্তী প্রফুল্লচন্দ্র সংগৃহীত বইয়ের যে তালিকা ও বিবরণ দিয়েছেন, তাতে দেখা যায়, তিনি রোমান্টিক কবিদের ও নন্দনতত্ত্ববিষয়ক গ্রন্থাবলি অত্যন্ত খুঁটিয়ে পড়ছেন এবং মার্জিনে এ বিষয়ে মন্তব্য লিখে রাখছেন।
তাহলে প্রশ্ন, একুশ শতকে এসে আমরা কি এগিয়ে, না পিছিয়ে গিয়েছি অথবা যাচ্ছি?
তিন.
তবুও একুশে গ্রন্থমেলার সার্থকতাই আমাদের কাম্য। অনেক অপূর্ণতা থাকলেও বাংলাদেশ যেমন আমাদের অনেক দিয়েছে, বইয়ের জগতে এসেও তেমনি আমাদের প্রাণ ভরে যায়। বই হাতে নিয়ে এটিকে দেখতে দেখতেও আমরা অন্তত এই মেলার অনেক অপূর্ণতার কথা ভাবতে পারি। আর সৎভাবে অপূর্ণতার কথা ভাবলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনার কথাও আমাদের না ভেবে উপায় নেই। পরিমাণগত বাস্তবতাই একসময় আমাদের গুণগত পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাবে। যাবেই। এ ছাড়া তো আমাদের ভিন্ন কোনো পথ নেই।

No comments:

Post a Comment