Thursday, June 09, 2011

শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া- মাটির রং থেকে মাটির ঘরে

দেশের মাটিকে খুব ভালোবাসতেন তিনি। গভীর মমতায় পর্যবেক্ষণ করতেন মাটির ধূসর, গৈরিক, পাটকিলে, ছাই রঙের বৈচিত্র্য। সেই সব রং তুলে আনতেন তাঁর ছবিতে অসাধারণ ‘টেক্সচার’, সুষমামণ্ডিত সমন্বয় আর অনিন্দ্য বিন্যাসে। শুধু রঙেরই ছবি। আর কিছু নেই। তবু সেই ছবির দিকে তাকালে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে।

জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছিলেন তাঁর কবিতায়, ‘আমার মতো আর কেউ নেই’, তিনিও আমাদের দেশের চারুকলার ভুবনে ছিলেন ঠিক তেমনই। তাঁর মতো আর কেউ নেই। তিনি মোহাম্মদ কিবরিয়া। গতকাল মঙ্গলবার তিনি চলে গেলেন মাটির ঘরে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে।
বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং দেশের নির্বস্তুক চিত্রকলার পথিকৃৎ এই বরেণ্য শিল্পী ল্যাবএইড হাসপাতালে সকাল সাতটা ১৫ মিনিটে অন্তিম নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। গত মাসের মাঝামাঝি অবস্থার অবনতি হলে জাতীয় হূদেরাগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে গত ৩১ মে ল্যাবএইড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তাঁর হূদ্যন্ত্র, কিডনি, ফুসফুস ও যকৃতের কার্যক্ষমতা কমে গিয়েছিল। শেষ দিকে ফুসফুসেও সংক্রমণ দেখা দেয়।
শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার মরদেহ বারডেমের হিমঘরে রাখা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী কনিষ্ঠ পুত্র জুনের কিবরিয়ার দেশে ফেরার অপেক্ষায়। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ১০ জুন শুক্রবার সকাল নয়টায় মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হবে সর্বস্তরের জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। এরপর চারুকলা অনুষদ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে আনা হবে। বাদ জুমা এখানে জানাজার পর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে দাফন করা হবে।
তাঁর মৃত্যুর সংবাদে শিল্পী ও কলারসিকদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। ল্যাবএইড ও বারডেমে দেশের দেশবরেণ্য শিল্পী, শিল্পশিক্ষক, তাঁর অনেক ছাত্র ও শিল্পানুরাগী উপস্থিত হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোকবাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিল্পকলা চর্চায় তাঁর অবদান জাতির কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক শোকবাণীতে বলেছেন, তাঁর মৃত্যুতে দেশের শিল্পক্ষেত্রে যে ক্ষতি হলো, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
চারুকলা চর্চায় মোহাম্মদ কিবরিয়া একটি স্বতন্ত্র ধারার সৃষ্টি করেছিলেন। বিমূর্ত চিত্রকলার এই ধারা পরিচিত ‘কিবরিয়া ধারা’ বলে। গত পাঁচ দশকের চিত্রকলায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই ধারাটির প্রভাবই সব থেকে গভীর ও ব্যাপক। তাঁর অনুসারীর সংখ্যাও সে কারণে সর্বাধিক। প্রথম পর্যায়ের কাজে তিনি অবয়ব ও জ্যামিতিক বিন্যাস নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন। জাপানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর তাঁর কাজে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তিনি নির্বস্তুক ছবির চর্চায় নিবেদিত হন।
শিল্পকর্ম রচনা ছিল তাঁর কাছে গভীর সাধনার বিষয়। নীল, কালো, ধূসর, পাটকিলে—এ ধরনের কিছু রং নিয়েই তিনি কাজ করেছেন। তাঁর ছবি স্নিগ্ধ, মাধুর্যমণ্ডিত। বিনম্র। একধরনের নিঃসঙ্গ ধ্যানমগ্নতার দ্যোতনায় উদ্ভাসিত তাঁর চিত্রতল। তাতে গভীর আবেগের কোমল সঞ্চার। প্রকৃতির অন্তর্গত সত্তার স্বরূপ উন্মীলনে উন্মুখ। দর্শকের সংবেদনশীলতাকে খুব সহজ সাবলীলতায় স্পর্শ করে যায় সেই ছবি। দৃষ্টিকে আটকে রাখে।
জীবনপঞ্জি: মোহাম্মদ কিবরিয়ার জন্ম ১৯২৯ সালের ১ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সিঁউড়ি গ্রামে। বাবা মোহাম্মদ রফিক, মা সায়েরা বেগম। বীরভূম জেলা স্কুলে পাঠ শেষে ১৯৪৫ সলে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে এখান থেকে স্নাতক হন। পরের বছর ১৯৫১ সালে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ঢাকায় এসে নওয়াবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে চারুকলার শিক্ষক হিসেবে। ১৯৫৪ সালে যোগ দেন সরকারি চারুকলা ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ)। ১৯৫৯ সালে বৃত্তি নিয়ে জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাপচিত্রের উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৮৭ সালে তিনি অধ্যাপক হন এবং ১৯৮৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন, ২০০৮ সালে তিনি ইমেরিটাস অধ্যাপক হন। স্ত্রী আনজুম কিবরিয়া, দুই পুত্র নাশরিদ কিবরিয়া ও জুনের কিবরিয়া।
প্রদর্শনী: দেশ-বিদেশে তাঁর অনেক একক ও যৌথ প্রদর্শনী হয়েছে। উল্লেখযোগ্য এককের মধ্যে আছে: ১৯৬০ সালে টোকিওর গ্যালারি ইয়োসিদো, ’৬৩ সালে বিজুতসু শিপ্পানায়, ’৭৯ সালে দিল্লিতে দক্ষিণ এশীয় সাংস্কৃতিক উৎসবে তাঁর ২০টি ছবির বিশেষ প্রদর্শনী, ঢাকায় ২০০০ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে। এ ছাড়া জাপানের মারুচিনি ও যুগোস্লাভিয়ার দ্যে যোশেফ ব্রজ টিটো গ্যালারিতে তাঁর একক প্রদর্শনী হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, লাহোর, করাচি, কলকাতা, জাপান বিভিন্ন স্থানে তাঁর যৌথ প্রদর্শনী হয়েছে।
পুরস্কার: ১৯৫৭ সালে ঢাকায় আয়োজিত জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৫৯ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত প্রথম তরুণ শিল্পী প্রদর্শনীতে ‘স্টারলেম’ পুরস্কার। ’৬০ সালে সর্বজাপান প্রিন্ট প্রদর্শনীর পুরস্কার, ’৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট পদক পেয়েছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৮৩ সালে পেয়েছেন একুশে পদক, ’৮৫ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সম্মাননা, ১৯৯৯ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার এবং ২০০২ সালে পেয়েছেন জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বিশেষ সম্মাননা।
মোহাম্মদ কিবরিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অনেকেই এসেছিলেন ল্যাবএইড ও বারডেম হাসপাতালে।
কাইয়ুম চৌধুরী: বাংলাদেশের শিল্পজগতে অত্যন্ত প্রতিভাবান শিল্পী। অনেক উত্তরসূরি তৈরি করে গেছেন। নির্বস্তুক চিত্রকলার পথিকৃৎ তিনি। নতুন একটি শৈলী সৃষ্টি করেছিলেন। বিমূর্ত ধারার চর্চা করলেও তাঁর কাজে বাংলাদেশের সত্তাকে পাওয়া যেত।
রফিকুন নবী: তাঁর খ্যাতি আমাদের দেশ, উপমহাদেশ বা কেবল এশিয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বের বহু বিখ্যাত গ্যালারিতে তাঁর কাজ সংগৃহীত আছে। আমাদের দেশে তিনিই প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান শিল্পী। নম্র, বিনয়ী, নিরহংকার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য মিশে ছিল কাজে। জাপান থেকে ফেরার পর তাঁর বিমূর্ত ধারার কাজ আমাদের অবাক করে দিয়েছিল। রঙে-রেখায় টেক্সচারে প্রতিটি কাজ আলাদা।
মনিরুল ইসলাম: ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তিনি যত বড় শিল্পী, মানুষ হিসেবে তার চেয়েও বড়। কোনো দিন কারও নামে নিন্দা, বিষোদগার করতে শুনিনি। কাছে গেলে অন্তর থেকেই তাঁর প্রতি একটা শ্রদ্ধা উঠে আসত। শিল্পী হিসেবে তাঁর একটি নিজস্ব শিল্পজগৎ ছিল। অনেকেই ছবি আঁকেন, কিন্তু নিজস্ব শিল্পভুবন না থাকলে শিল্পী হওয়া যায় না। কোনো অবয়বের আভাস নেই তাঁর কাজে। পেইন্টিং বা ছাপচিত্র সব ক্ষেত্রেই তিনি একেবারে শুদ্ধ নির্বস্তুক। তাঁর ছবি দর্শককে আটকে রাখে। কোনো চড়া, ঝলমলে রং নেই, তবু অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকা যায় তাঁর ছবির দিকে।
শহীদ কবির: অনেক লম্বা সময় তাঁর নিবিড় সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তাঁর মতো নিবেদিতপ্র্রাণ শিল্পী আমাদের দেশে আর একজনও নেই। শুধু শিল্পকর্মের জন্যই সারা জীবন ব্যয় করেছেন। মাটির প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুসন্ধিৎসা, গভীর আবেগ। বহুবার দেখেছি বিভিন্ন ধরনের মাটি এনে তার রং, ভেতরের সত্তার বিষয়টিকে তিনি আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছেন। সংগীত ও সাহিত্যেও ছিল তাঁর অগাধ জ্ঞান। কোনো গোঁড়ামি ছিল না। ‘ও আমার দেশের মাটি’ গানটি তাঁর প্রিয় ছিল। একবার আমাকে বলেছিলেন, এই গানটি শুনলে মনে হয় মাটির সঙ্গে বুক মিলিয়ে শুয়ে থাকি। একটা মরমি ব্যাপার ছিল তাঁর।
মাহমুদুল হক: আমাদের চিত্রকলায় তাঁর যত অনুসারী তৈরি হয়েছে, আর কারও এত অনুসারী সৃষ্টি হয়নি। এ থেকেই আমাদের চিত্রকলায় তাঁর প্রভাব ও অবদান বোঝা যায়।
আবুল বারক আলভী: তিনি ছাত্রদের সব সময় উৎসাহ দিতেন। খুব বেশি ভুল ধরতেন না। কিন্তু উপযুক্ত পরামর্শটি দিতেন। শুধু ছাত্ররাই নয়, অনেক শিক্ষকও তাঁদের কাজ দেখাতে আনতেন কিবরিয়া স্যারের কাছে।
নিসার হোসেন: সব ধরনের দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে থেকে শিল্পচর্চা করেছেন। আমাদের চারুকলায় তিনি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে আরও উপস্থিত ছিলেন গ্যালারি চিত্রকের পরিচালক শিল্পী মনিরুজ্জামান, চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগের শিক্ষক আনিসুজ্জামান, জয়া শাহরীন, শিল্পী রফি হক, আহমেদ নাজিরসহ অনেকে। সবাই বলছিলেন, ইহজাগতিক নিয়মে মোহাম্মদ কিবরিয়া চলে গেলেন বটে, তবে বাংলাদেশের চিত্রকলা তাঁকে সঞ্জীবিত করবে নিঃসন্দেহে।

No comments:

Post a Comment