Wednesday, December 15, 2010

হায় হায় কম্পানি by মোস্তফা কামাল

ত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে নাদের আলী চাকরির জন্য দরখাস্ত করে। সঙ্গে জামানতের তিন হাজার টাকার ব্যাংক ড্রাফট পাঠায়। এ জন্য তাকে ধারদেনা করতে হয়। সে ভাবে, চাকরি হলে তিন হাজার টাকা শোধ করা কোনো ব্যাপার হবে না!

একটি বেসরকারি সংস্থায় প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদে চাকরির আশায় নাদের আলী প্রতিবেশীর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ব্যাংক ড্রাফট করে পাঠায় ঢাকায়। এমনিতেই চাকরির বাজার মন্দা, ডিগ্রি পাস করে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে চাকরিটা যদি পাওয়া যায়, মন্দ কী! মা-বাবার সংসারে কিছুটা সহায়তা তো করা যাবে!
চাকরি হওয়ার খবর নেই, ইন্টারভিউ কার্ড পেয়েই নাদের আলী খুশি। বিগত তিন বছরে সে কম দরখাস্ত করেনি। কোনো দিন ইন্টারভিউ কার্ডও পায়নি। আজ কার্ড পেয়ে সে মাকে দেখায়, বাবাকে দেখায়। পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে এমনভাবে বলে, যেন তার চাকরি হয়ে গেছে।
ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য ঢাকায় রওনা হয় নাদের আলী। এত বড় শহরে এসে খেই হারিয়ে ফেলে। ঠিকানা হাতে নিয়ে এর-ওর কাছে জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু সেই ঠিকানায় কাউকে খুঁজে পায় না। কেউ বলতেও পারে না। এখন কোথায় যাবে, কী করবেÑকিছুই ভেবে পায় না নাদের আলী। সে চুল ছেঁড়ে আর বলে, এ তো দেখছি হায় হায় কম্পানির পাল্লায় পড়লাম! দেনা করে ব্যাংক ড্রাফট করলাম। এখন শোধ দেব কী দিয়ে! মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে সে।
নাদের আলী ঢাকার ফুটপাত দিয়ে হাঁটে আর ভাবে, ঢাকায় থাকার কোনো জায়গা নেই, বাড়িতে যাওয়ার উপায় নেইÑএখন কী করি! সে পথচারী হাবলু মিয়াকে বলে, ভাই, আমাকে একটা বুদ্ধি দেবেন?
হাবলু মিয়া বলল, জি না।
কেন?
ফি লাগবে।
কত টাকা?
দুপুরের খাওয়ার পয়সা দিলেই হবে।
ও, আপনার অবস্থাও তো আমার মতো!
মানে!
আমি হায় হায় কম্পানির পাল্লায় পড়ে দেউলিয়া হয়েছি। এখন টাকা-পয়সা হাতে নেই। ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা নেই।
তাই নাকি! আরে ভাই আগে বলবেন না! আমারও তো একই অবস্থা। পত্রিকায় সত্যি সত্যি হায় হায় কম্পানির নামে একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, শর্ত সাপেক্ষে লোক নিয়োগ করা হবে। তবে চাকরিপ্রার্থীদের অবশ্যই পাঁচ হাজার টাকার ব্যাংক ড্রাফট পাঠাতে হবে। ওই টাকা সিকিউরিটি মানি হিসেবে জমা থাকবে। চাকরি না হলে পুরো টাকা ফেরত দেওয়া হবে। আমি সরল বিশ্বাসে পাঁচ হাজার টাকার ব্যাংক ড্রাফট পাঠাই। এসে দেখি, হায় হায় কম্পানির একটি সাইনবোর্ড আছে, কিন্তু কোনো লোক নেই।
কী বলেন! কম্পানির নামই হায় হায় কম্পানি?
হ্যাঁ ভাই, হ্যাঁ!
তাহলে তো ঠিকই আছে।
কী ঠিক আছে?
তারা নিজেদের হায় হায় কম্পানি ঘোষণা করেই আপনার টাকা নিয়েছে। এতে তাদের কোনো দোষ নেই।
কী বললেন! আচ্ছা ভাই, হায় হায় কম্পানি মানে কী?
মানে ভুয়া কম্পানি।
তাই! আমি এত বোকা!
আপনার নামই তো হাবলু! বুদ্ধিমান হওয়ার সুযোগ কোথায়! আপনি আবার আমাকে বুদ্ধি দিতে চান!
হাবলু মিয়া হাবাগোবার মতো নাদের আলীর দিকে তাকিয়ে থাকে। নাদের আলী আর দাঁড়ায় না। সে আপন মনে হাঁটতে থাকে।

২.
হাঁটতে হাঁটতে নাদের আলী তাবানী বেভারেজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিশাল গেটের সামনে এক জায়গায় লেখা আছে, ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ’। আরেক জায়গায় লেখা আছে, ‘লোক নিয়োগ চলছে’।
নাদের আলী খুব ভালো করে লেখা দুটি পড়ে। তারপর গেটে দাঁড়ানো এক লোককে বলে, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
জি, করেন।
আবার ফি দিতে হবে না তো!
কিসের ফি?
কথা বলার ফি।
এই মিয়া, ইয়ার্কি করেন!
না ভাই, ইয়ার্কি করছি না। এক লোক বুদ্ধি দেওয়ার জন্য ফি চাইল তো, তাই বললাম! সরি ভাই, মনে কিছু করবেন না।
ঠিক আছে, করব না। এবার আপনার প্রশ্নটা করেন।
এই যে গেটের এক পাশে লেখা কারখানাটি বন্ধ, আরেক পাশে লেখা লোক নিয়োগ চলছেÑঘটনা কী!
ঘটনা আছে। আপনি চাকরি করবেন?
চাকরির জন্যই তো ঢাকায় এসেছি!
চাকরি পেতে হলে ঘুষ লাগবে!
ঘুষ! এটা আবার কী?
ঘুষ মানে জানেন না? টাকা লাগবে, টাকা! টাকা দিলে চাকরি হবে।
হ্যাঁ, খুব ভালো বলেছেন, আমি টাকা দিই, আর আপনি টাকা নিয়ে ভাগেন! দরকার নেই আমার চাকরির। আমি যাই।
নাদের আলী হাঁটে আর মনে মনে বলে, কী ব্যাপার, ঢাকা শহরে কি সবই হায় হায় কম্পানি!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments:

Post a Comment