Wednesday, December 15, 2010

ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে শ্রমিকবান্ধব সিদ্ধান্ত নিনঃ অনাকাঙ্ক্ষিত শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা

তৈরি পোশাক কারখানায় মজুরির সমস্যাকে কেন্দ্র করে শ্রমিক বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে এ পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু এবং শতাধিক আহত হওয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শ্রমিকের সংখ্যা এবং পুলিশ-র্যাবের ৫০০ গুলি ও প্রায় শতটি টিয়ার শেল নিক্ষেপ থেকে সংঘর্ষের ব্যাপকতা অনুমান করা যায়। এই মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কী কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো, তার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার। পাশাপাশি কী কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেল, তাও সঠিকভাবে চিহ্নিত হতে হবে।

গত জুলাই মাসে সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় কমিটির মাধ্যমে পোশাকশিল্পে নতুন ন্যূনতম জাতীয় মজুরিকাঠামো ঘোষিত হয়। প্রথমত, আশানুরূপ না হওয়ায় শ্রমিকদের বড় অংশই এটা মানতে রাজি ছিল না। দ্বিতীয়ত, সেই মজুরিও চার মাস পর অর্থাৎ গত নভেম্বর থেকে দেওয়ার ঘোষণায় তাঁরা আরও হতাশ হন। এর মধ্যে দুটি ঈদেও তাঁরা কাঙ্ক্ষিত বোনাসও পাননি। তার পরও শ্রমিকেরা ডিসেম্বর মাসের জন্য দিন গুনেছেন। কিন্তু ডিসেম্বরের শুরুতেই নভেম্বরের বেতন হাতে পেয়ে তাঁদের একাংশের হতাশা চরমে ওঠে। তাঁদের অভিযোগ, নতুন শ্রমিকদের বেতন কিছুটা বাড়লেও পুরোনো ও দক্ষ শ্রমিকদের বেতন সেই অনুপাতে বাড়েনি। অনেক ক্ষেত্রেই তা নতুন শ্রমিকদের থেকেও কম হয়ে গেছে। এর জের ধরেই গত শনিবার চট্টগ্রাম ইপিজেডের ১৬টি কারখানা এবং ঢাকা বিভাগের ১১টি কারখানা বিশৃঙ্খলা ও ভাঙচুরের মুখে বন্ধ হয়ে গেছে। গত রোববার রাজধানীর কুড়িলে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করেন। একই দিনে চট্টগ্রাম ইপিজেডে শ্রমিকেরা কাজে যোগদান করতে গেলে ফিরিয়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে এবং নির্ধারিত বৈঠক না হওয়ার প্রতিবাদে আবারও বিক্ষোভ শুরু হয়। বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষের পেছনেও এ কারণটিই প্রধান। তিনটি প্রাণের দুঃখজনক মৃত্যু এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ভাঙচুরের পটভূমিও এটি।
পোশাকশিল্পের মজুরি-সমস্যা দুরারোগ্য ব্যাধির মতোই সবাইকে ভুগিয়ে চলছে। শিল্পটির জন্মের পর থেকেই এ কারণে বিক্ষোভ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন অনেক শ্রমিক, ঘটেছে অজস্র ভাঙচুর ও নৈরাজ্যের ঘটনা। আশা করা হয়েছিল, নতন মজুরিকাঠামো বাস্তবায়নের মাধ্যমে এর নিরসন ঘটবে। কিন্তু মালিকদের চুক্তি ভঙ্গ করা এবং শ্রমিক ঠকানোর প্রবণতার জন্যই সরকারি চেষ্টা সত্ত্বেও শ্রমিকাঞ্চলে শান্তি আসছে না।
মালিকদের নতুন মজুরিকাঠামো মানতে বাধ্য করার দায়িত্ব বিজিএমইএ ও সরকারের। পোশাক খাত দেশের অর্থনীতিতে তো বটেই, মালিকদের অর্থ-বিত্তকেও বিপুলভাবে বৃদ্ধি করেছে। এই সাফল্যের অংশীদার শ্রমিকেরাও। পোশাকশিল্পের প্রবৃদ্ধির হার এ বছর ৩৮ শতাংশ। এত অনুকূল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও লাভের ভাগ মালিকের, দুর্ভোগের দায় শ্রমিকের—এটা চলতে পারে না।
চট্টগ্রামে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। এ মুহূর্তে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং শিল্পমালিকদের যেকোনো বাড়াবাড়ি মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। একই সঙ্গে শ্রমিকনেতাদের বুঝতে হবে, গঠনমূলক আন্দোলনই দীর্ঘ মেয়াদে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা করতে পারে, নৈরাজ্য নয়। জরুরি ভিত্তিতে ত্রিপক্ষীয় কমিটির বৈঠক হওয়া দরকার। সেখানে সরকারের দায়িত্ব বিজিএমইএকে দিয়ে নতুন মজুরিকাঠামোর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও শ্রমিক অসন্তোষের ইতি ঘটানো।

No comments:

Post a Comment