Tuesday, January 18, 2011

বার্মা কিংবা বর্মা এখন মিয়ানমার by লিয়াকত হোসেন খোকন

কেউ বলেন মিয়ানমার, আবার কেউবা 'মায়ানমার' বলেন। তবে একদা ছিল বর্মা বা বার্মা। সবার মনের মানচিত্র থেকে বার্মা বা বর্মা নামটি চিরতরে মুছে গেলেও বর্মার কাঠ, বর্মার চাল, বমর্ী চপ্পলের কথা কিন্তু ভোলা সম্ভব হয়নি। একদা ভেলভেটের ষ্ট্র্যাপ লাগানো বমর্ী চপ্পল বাংলাদেশে সহজলভ্য ছিল।

শুধু তাই নয়, বর্মার সিল্কের লুঙ্গিও ছিল এক সময় বাংলাদেশে জনপ্রিয়। বমর্ীরা ওই লুঙ্গিকে বলতো, লুঞ্জি।

১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষ আর বর্মা এক ভাইসরয়ের শাসনে ছিল। এর পরেই বর্মা এবং ভারতবর্ষ ইংরেজের শাসনে সুবিধা করার জন্য আলাদা হয়ে গেল।

এক সময়ে বর্মায় বাঙ্গালিরা যেতো ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য। তখন ওখানে যারাই যেতেন তাদের অধিকাংশেরই ভাগ্য ফিরে যেতো। কত শত হাজারো বাঙালি ওখানে বসতি গড়ে তুলেছিল। বর্মা সেটেল্ড হওয়া তখন তেমন কোনো কষ্টই ছিলো না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানিরা যত এগুতে লাগল তা শুনে তো বাঙালিরা পেলো ভয়। যুদ্ধের ভয়ে কী আর করা বাঙালিরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বর্মা ছাড়তে লাগলেন। সেই সময় প্রায় সব পরিবারই ফিরে এসেছিল নিজ দেশে। ফিরে এসে কত শত মানুষ চোখের জল ফেলে বলতে বাধ্য হয়েছিল এমন শান্ত নির্বিরোধী মানুষের দেশ, প্রাকৃতিক সবুজ আর নীল আকাশের দেশ কী আর এ জীবনে দেখা হবে। এনিয়ে কতই না ছিল বিলাপ। এদিকে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগাভাগি হয়ে গেলো। বাঙালিরা আর ফিরলো না বর্মায়। একদা বাঙালি যারা বর্মায় ছিলেন তাদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন তারাও এই বৃদ্ধ বয়সে বর্মা ছেড়ে আসার দুঃখ ভোলেননি!

সেই বর্মা এখন মিয়ানমার। সম্প্রতি মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সান সুচির মুক্তি ও এর আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে দেশটির জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। অং সান সুচির মুক্তির মধ্য দিয়ে তাই আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে মিয়ানমারের নামটি। মিয়ানমারের যে নাম ছিল বর্মা- একথা কেউ আর বলে না।

১৯৪৮ সালে বর্মা স্বাধীন হবার আগে যুব নেতা আউং সান এবং তার ক'জন সহকমর্ী আততায়ীর গুলিতে নিহত হলেন। এই আউং সানের মেয়েই হলেন অং সান সুচি। তিনি নির্বাচনে প্রচণ্ড জিতেও সামরিক কর্তাদের শাসনে গৃহবন্দী হয়েছিলেন। নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পরও পুরস্কার আনতে যেতে পারেননি। এ থেকে আঁচ করা যায় মিয়ানমারের সামরিক কর্তারা যে কত নিষ্ঠুর, কত জালিম। শরৎচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে বর্মাকে বাঙালির কাছে এনে দিয়েছিলেন। তার গল্পের নায়ক আর পাঁচজন বাঙালি ভাগ্যান্বেষীর মতে শ্রীকান্তও বর্মা গিয়েছিলেন। তার বাসস্থান ছিল রেঙ্গুনের বাঙালি পাড়ায়। সেই রেঙ্গুন এখন ইয়াঙ্গুন নামে খ্যাত। ইয়াঙ্গুন বা রেঙ্গুনের প্রতীক হলো শোয়ে ডাগন প্যাগোডা। এই শহরে দু'টি লেক আছে। লেকের পাশে রয়েছে প্রশস্ত রাস্তা। লেকে ভাসে বড় বড় বজরা। বজরায় বসেছে রেস্টুরেন্ট।

শোয়েডাগন প্যাগোডা সম্পূর্ণ সোনায় মোড়া রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এটি দু'হাজার বছর আগে তৈরি হয়েছিল। পৃথিবীর আশ্চর্যতমের মধ্যে এটি এখন অন্যতম বলে মায়ানমারবাসী মনে করেন। শেষ বিকেলে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় আশ্চর্য সুন্দর দেখায় এই প্যাগোডাটি। এটি ছাড়াও ইয়াঙ্গুনে ছোট-বড় অনেক প্যাগোডা ও মন্দির রয়েছে। প্রতিটিতেই গৌতম বুদ্ধ নানা রূপে বিভিন্ন মন্দিরে অবস্থান করছেন।

অতীতে বর্মা জাহাজে যাওয়া ছাড়া যাওয়ার আরেকটা পথ ছিল, তাহলো পদব্রজ। ভয়াল নির্জন পাহাড় জঙ্গল পেরিয়ে একশ বছর আগে কত শত লোক বার্মা যেতো। তখনতো বর্মার মেয়েরাই এসব কাজ করতো। সংসার এবং সংসারের বাইরে পুরুষরা বর্মা চুরুট মুখে দিয়ে অলস সুখে দিন যাপন করতো। এখন আর সেই দিন নেই।

No comments:

Post a Comment