Tuesday, January 18, 2011

পাংশায় ভয়! এজেন্টকে দেখিয়ে সিল মারতে হলো ভোটারদের

'দেশ স্বাধীনের পর কখনোই এমন পরিস্থিতি হয়নি। অব্যাহত হুমকির কারণে ভোটের আগে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল; আর আজ ভোট দিতে হলো প্রকাশ্যেই।' কথাগুলো বলছিলেন পাংশা পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ঢেঁকিপাড়া গ্রামের ৭০ বছর বয়সী জামালউদ্দিন।

গতকাল সোমবার দুপুর ১২টার দিকে শাহজুই মাদ্রাসাকেন্দ্রে তিনি ভোট দেন। সাংবাদিক পরিচয় জেনে ক্ষোভের সক্সগে অভিযোগ করলেন_স্বাধীন রাষ্ট্রে গোপন ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ থাকলেও পাংশা পৌরসভার ক্ষেত্রে তাঁর ব্যতিক্রম ঘটেছে। ভয়ে তাঁর মতো অনেককেই
'নির্ধারিত প্রার্থীর এজেন্টদের দেখিয়ে' ব্যালট পেপারে সিল মারতে হয়েছে। প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করেছেন এই কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা পারনারায়ণপুর গ্রামের ৬০ বছর বয়সী শের আলী বিশ্বাস, আবুল বিশ্বাসসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্তত ১৫ ভোটার।
জামালউদ্দিনের অভিযোগ, শুক্রবার রাতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ওয়াজেদ মাস্টারের ভাই ইদ্রিসসহ ১০-১২ জন তাঁর বাড়িতে গিয়ে শাসিয়ে এসেছেন। বলেছেন, বেঁচে থাকার ইচ্ছে থাকলে এজেন্টের সামনেই 'আনারসে' ভোট দেবেন। না হলে পরিণাম ভয়াবহ হবে। চাপের মুখে গ্রাম ছেড়ে আত্মীয়বাড়ি কলিমহরে গিয়ে দুই দিন থাকার পর গতকাল সকালে গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের পরামর্শে বাড়ি ফিরে ওয়াজেদ মাস্টারের এজেন্টের সামনেই ভোট দিয়েছেন।
জামালউদ্দিন, শের আলী, আবুলসহ একাধিক ব্যক্তির অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে কেন্দ্র থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরের পারনারায়ণপুর গ্রামে গেলে একাধিক বাসিন্দা প্রকাশ্যেই করেন নানা অভিযোগ। আলী শেখের বৃদ্ধা মা আমেনা খাতুন, স্ত্রী ফেরদৌসী বেগম এবং ছোটভাইয়ের স্ত্রী নয়ন বেগম বলেন, গত শনিবার রাতে ১০-১২ জন মুখে কাপড় বেঁধে তাঁদের বাড়ি গিয়ে দরজায় লাথি মেরে ও হুক্সকার দিয়ে ডেকে বের করে। সবাইকে ঘুম থেকে তুলে আনারস প্রতীকে ভোট দেওয়ার নির্দেশ দেয়। তা না হলে গ্রামছাড়া করা হবে বলে শাসিয়ে যায়। একই অভিযোগ পারনারায়ণপুর গ্রামের যুবক রেজাউল, খোকন, মাসুদ, রমজানসহ আরো অনেকের। তাঁরা জানান, এলাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাড়া অন্য দলের কেউ কথা বলতে পারছে না।
কেন্দ্র পরিদর্শনে আসা কালিকাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও পৌরসভার বাসিন্দা সুরজ মুন্সী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শাহজুই মাদ্রাসা কেন্দ্রটি আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর নিজস্ব এলাকা হওয়ায় অন্য প্রার্থীর সমর্থকরা এখানে কোণঠাসা। হুমকি ও ভয় দেখানোর বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার সত্যতা আমিও জেনেছি। এলাকায় উৎসবের আমেজে ভোটগ্রহণ দেখা গেলেও সাধারণ অনেক ভোটারেরই মনে রয়েছে তীব্র ক্ষোভ ও কষ্ট।'
শাহজুই মাদ্রাসা কেন্দ্রে কথা হয় বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাবিবুর রহমান রাজার সক্সগে। তিনি দুপুর ১টার দিকে অভিযোগ করে বলেন, 'আমি স্থানীয় ছয় বিএনপি কর্মীকে কেন্দ্রটিতে পোলিং এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য মনোনীত করি। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকদের হুমকির কারণে মাত্র একজন যোগ দিয়েছেন। নিরুপায় হয়ে পার্শ্ববর্তী ৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে তিনজনকে ডেকে এনে তাঁদের সক্সগে আমি নিজেও পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব পালন করছি। ভোট গণনার সময়ও এখানেই থাকব।' তিনি জানান, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পাংশা জজ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান করা তাঁর ভাই এলাহী হোসেনকেও প্রতিপক্ষের লোকজন তাড়িয়ে দিয়েছে। আধা ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্য জিল্লুল হাকিম কেন্দ্র পরিদর্শনের নামে এখানে অবস্থান করে প্রিসাইডিং অফিসারের সক্সগে চা-নাস্তা খাওয়াসহ খোশগল্প করেছেন। এ সময় তাঁর সক্সগে ছিলেন ১৫ জনেরও বেশি নেতা-কর্মী।
অভিযোগের সত্যতা জানতে প্রিসাইডিং অফিসার ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সৈয়দ আহমেদ জমসেদের কক্ষে গেলে এমপি জিল্লুল হাকিমকে সেখানে বসে থাকতে দেখা যায়। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সকাল থেকে এ পর্যন্ত পাঁচটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। কোথাও কোনো অনিয়ম দেখিনি।' ভোটারদের হুমকি ও ভয় প্রদর্শন প্রসক্সগে তিনি বলেন, পৌরসভার ভেতরে তেমন চরমপন্থী নেই; তবে চর এলাকায় রয়েছে। যদিও এখন তাদের ক্ষমতা কমে গেছে।
অভিযোগ প্রসক্সগে প্রিসাইডিং অফিসার সৈয়দ আহমেদ জমসেদ বলেন, 'এই কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবেই ভোটগ্রহণ হচ্ছে। কেন্দ্রের দুই হাজার ১১ ভোটারের মধ্যে দুপুর ১টা পর্যন্ত ছয়টি বুথে প্রায় ১২০০ ভোটার ভোট দিয়েছেন। ভয়ভীতি থাকলে এটা সম্ভব হতো না।'
নির্বাচনী আচরণবিধি ভক্সগ : পৌনে ১২টার দিকে শাহজুই মাদ্রাসা ভোটকেন্দ্রে ঢুকতেই দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ওয়াজেদ আলী মাস্টারের নাম ও প্রতীক সংবলিত সাদা টি-শার্ট ও ক্যাপ পরিহিত দুই শিশুকে। শিশু দুটির পরিচয় জানতে গিয়ে কথা হয় ওয়াজেদ আলী মাস্টারের স্ত্রী মনোয়ারা বেগমের সক্সগে। তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, 'ভোটারদের আকৃষ্ট করতে মাত্র ১৮ জোড়া ক্যাপ ও টি-শার্ট ছাপানো হয়েছে। যদিও আমাদের ফ্যামিলি অনেক বড়।'
দেখা গেছে, একই ধরনের শার্ট ও ক্যাপের কারণে ওই ভোটকেন্দ্রের অধিকাংশ ভোটারেরই শিশু দুটির দিকে বাড়তি মনোযোগ ছিল। এ ছাড়া মাইক্রোবাস নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপির উপস্থিতি সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করে।
এই কেন্দ্রে ভ্যানে চড়ে ভোট দিতে আসেন পারনারায়ণপুর গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধা আকিরুন বেগম। কথা প্রসক্সগে একই গ্রামের ভ্যানচালক জামাল জোয়ার্দ্দার জানান, ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী রইচউদ্দিন ৫০০ টাকায় দিনব্যাপী ভ্যানটি ভাড়া নিয়েছেন। এই ভ্যানে করে তাঁর সমর্থিত ভোটারদের কেন্দ্রে আনা-নেওয়া হচ্ছে।
বেলা ২টার দিকে কেন্দ্র পরিদর্শনে আসা রাজবাড়ী জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাজিদ আনোয়ার জানান, পৌরসভার কেন্দ্রগুলোর সার্বিক অবস্থা সুশৃক্সখল। আচরণবিধি ভক্সগের তেমন অভিযোগ মেলেনি। পরে টি-শার্ট ও ভ্যান ভাড়া প্রসক্সগ তুললে আশপাশে তিনি তাঁদের খুঁজতে থাকেন।
পাংশা জজ স্কুলকেন্দ্রে অবস্থানরত ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী গোবিন্দচন্দ্র কুণ্ড অভিযোগ করেন, প্রতিপক্ষ রামদাস দত্তের লোকজন তাঁর সমর্থকদের মাঠের আশপাশে থাকতে দেয়নি।
পাংশা পৌরসভার আওয়ামী লীগ প্রার্থী ওয়াজেদ আলী মাস্টার গতকাল সন্ধ্যায় টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নিশ্চিত পরাজয় জেনেই অভিযোগ করেছে বিএনপি প্রার্থী। পাংশা এলাকায় প্রশাসনের তদারকি কঠোর ছিল। ফলে ভয় দেখিয়ে কিংবা প্রকাশ্যে ভোট নেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়।' ছাপানো ক্যাপ ও টি-শার্ট সম্পর্কে তিনি বলেন, 'কিছু অতি উৎসাহী সমর্থক এটা করে থাকতে পারে। তবে তা আমার জানা নেই।'
জেল-জরিমানা : নির্বাচনী আচরণবিধি ভক্সগের অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত গতকাল রাজবাড়ী পৌরসভা এলাকায় ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সুমন হোসেন, ২ নম্বর ওয়ার্ডের হেলাল উদ্দিন ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সিদ্দিকুর রহমানকে ছয় মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন। পাংশা পৌর এলাকায় দুটি ট্রাকের অবাধ চলাচলের কারণে চালকদের দেড় হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া গোয়ালন্দে ভোট কেনার জন্য টাকা দেওয়ার সময় মাজেদ নামের এক যুবককে ছয় মাসের, জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগে বিল্লু বিশ্বাস এবং মাসুদ নামের এক পোলিং এজেন্টকে সাত দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক সৈয়দা সাহানা বারী গতকাল সন্ধ্যায় টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রশাসনের নানা পদক্ষেপ ও তদারকির ফলে রাজবাড়ী, পাংশা ও গোয়ালন্দ পৌরসভায় শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ হয়েছে। তিনটি পৌরসভার কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আর নির্বাচনী আচরণবিধি ভক্সগকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।'

No comments:

Post a Comment