Wednesday, June 08, 2011

অদক্ষ মন্ত্রী ও আমলাতন্ত্রের ফাঁদে গতিহীন 'দিনবদল'

প্রশাসনযন্ত্রের চাকা আর চলে না। থমকে গেছে কেন্দ্র থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনের কার্যক্রম। বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বা প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা অজুহাত দেখিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে মাসের পর মাস। সরকারের মেয়াদের প্রায় অর্ধেক চলে গেলেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি খুব সামান্যই। এমনকি বিভিন্ন সভা, সমাবেশ ও সরকারি দপ্তর পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও নির্দেশনা বাস্তবায়নের অবস্থাও নাজুক।

এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি), সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি প্রকল্প (পিপিপি) এবং সরকারের অগ্রাধিকার কর্মসূচি বাস্তবায়নের অগ্রগতিও সন্তোষজনক নয় বলে সরকারের বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। জরুরি ভিত্তিতে
এখনই এ অবস্থার পরিবর্তন করা না হলে জনগণের রায়ে মহাজোট সরকারের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার মূলমন্ত্র (নির্বাচনী ইশতেহার) 'দিনবদলের সনদ ও ভিশন ২০২১' বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সরকারি কর্মকাণ্ড মন্থর হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত ১৩ কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো হচ্ছে মন্ত্রীদের অতিমাত্রায় প্রধানমন্ত্রী ও আমলানির্ভরতা, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অহেতুক হস্তক্ষেপ, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের আমলাদের হতাশা ও আন্তরিকতার অভাব, শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অদক্ষতা, প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড সঠিকভাবে কাজ না কারা, নিজ নিজ ডেস্ক থেকে ফাইল নিষ্পন্ন না হওয়া, বিভিন্ন পর্যায়ে সমন্বয়হীনতা, পুরনো বিধিবিধান অনুসরণ করতে গিয়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, শূন্যপদ পূরণের ছাড় পেতে অহেতুক কালক্ষেপণ, দলীয় নেতা-কর্র্মীদের তদবিরে কাজের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হওয়া এবং রুলস অব বিজনেস, সচিবালয় নির্দেশিকা ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগের অনুপস্থিতি। এসব সমস্যা নিরসনে গত দুই বছরে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উদ্দেশে ১১টি বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ইতিবাচক ফল আসেনি।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি : বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এবং মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১১৬টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রায় ৬৪ শতাংশেরই বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি নেই। প্রক্রিয়াধীন এসব প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মো. আবদুল করিমের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষাবিষয়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি হতাশাব্যঞ্জক। ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে ২৩টি প্রক্রিয়াধীন। অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বেশির ভাগ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন, প্রক্রিয়াধীন অথবা পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায়। বৈঠক থেকে বলা হয়েছে, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে কোনো অনিয়ম বা বাধা থাকলেও তা জরুরি ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানাতে হবে। পাশাপাশি পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ বাড়ানোর জন্যও মন্ত্রণালয়গুলোকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের চুক্তি : গত প্রায় আড়াই বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৭টি দেশ সফরকালে সাতটি দেশের সঙ্গে ৫৭টি সিদ্ধান্তসহ বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সম্পাদন করা হয়। চীনসহ পাঁচটি দেশের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হয় ১৫টি। চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক হয় ছয়টি। তিনটি দেশের সঙ্গে ১৪টি বিষয়ে বাংলাদেশ সম্মত হয়। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ছয়টি দেশের কাছ থেকে পাওয়া যায় ১০টি আশ্বাস। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর ১০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয় একই বছরের ৭ আগস্ট। এ ঋণের আওতায় ২০টি প্রকল্প নেওয়া হলেও বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি নেই। ২০০৯ সালের ২০ থেকে ২৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরকালে দ্বৈত করারোপ প্রত্যাহার এবং পারস্পরিক বিনিয়োগ বর্ধন ও সংরক্ষণ চুক্তি স্বাক্ষরে দুই দেশ সম্মত হয়েছিল। প্রায় দেড় বছর পর গত জানুয়ারিতে দ্বৈত করারোপ প্রত্যাহার চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু পরেরটি ঝুলেই আছে। কাতার সফরকালে কাতার এয়ারলাইনসকে দোহা-ঢাকা রুটে ফ্লাইট পরিচালনার ব্যাপারে দুই দেশ সম্মত হয়। পরে এ বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও কাতার দূতাবাসের জন্য ঢাকায় জমি ইজারা প্রদানের বিষয়ে চুক্তি হয়নি এখনো। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর কুয়েত সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল পদ্মা সেতুর জন্য অর্থায়ন এবং কুয়েতে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির নতুন সুযোগ সৃষ্টি। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে কোনো আশ্বাস মেলেনি। আর বাংলাদেশ থেকে কুয়েত দক্ষ জনশক্তি নেওয়ার আগ্রহ দেখালেও এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। পানিসম্পদ, যোগাযোগ, প্রতিরক্ষা; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ; কৃষি, শিল্প, স্বরাষ্ট্র, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন, বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয় মিলিয়ে ১০টি মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তথ্য না পাওয়ায় তা উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি এ-সংক্রান্ত গত ২৭ ফেব্রুয়ারির সভায়। একইভাবে ২০১০ সালে চীন সফরকালে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তও কাগজপত্রে সীমাবদ্ধ আছে, বাস্তবায়ন হয়নি।
এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মো. আবদুল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, কাজের অগ্রগতি তেমন আশানুরূপ নয়। জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এডিপি বাস্তবায়ন : চলতি বছরের এডিপির আকার ছিল ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কাটছাঁট করার পর তা দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ১৭০ কোটি টাকায়। প্রথম ছয় মাসে বরাদ্দের ৩০ শতাংশও খরচ হয়নি। ৯ মাসে খরচ হয়েছে ৫০ শতাংশ, ১০ মাস শেষে ৬০ শতাংশ খরচ করতে সক্ষম হয়েছে সরকারের মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলো। এ হারকে 'উৎসাহব্যঞ্জক' বলেছেন তদারকির দায়িত্বে থাকা আইএমইডির সচিব হাবিবুল্ল্যাহ মজুমদার। তবে কাজের গুণগত মান নিয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি। বাস্তবায়নে অক্ষমতার জন্য এডিপির আকার কাটছাঁট করতে হয় স্বীকার করে অর্থমন্ত্রী প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা ও তদারকি বাড়ানোর কথা ২০০৯-১০ সালের বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন। আইএমইডির কর্মকর্তারা বলেছেন, 'মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তাকেই প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁরা ঢাকায় বসে থকেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরা বিদেশ ভ্রমণে উৎসাহী হলেও দেশের ভেতর প্রকল্প এলাকায় যান না। এসব কারণে প্রকল্পের কাজে গতি আসে না, কাজের মানও ভালো হয় না। মাঝখানে খরচ হয় জনগণের করের টাকা আর প্রকল্প সহায়তা হিসেবে আসা বিদেশি ঋণ।'
অগ্রাধিকার প্রকল্প : ২০০৯-১০ ও চলতি ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় ঘোষিত মোট ৩৬৭টি কার্যক্রমের মধ্যে ১০টি মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন করার কথা ১১২টি কার্যক্রম। জানা গেছে, এর মধ্যে মাত্র ৬৫টির অগ্রগতি সন্তোষজনক। বাকিগুলোর বেশির ভাগেরই বাস্তবায়ন কাজ প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা ৭৮টি নীতি ও কর্মসূচির মধ্যে ৩৩টির বাস্তবায়ন হয়নি।
দুই বছরেও গতিহীন পিপিপি : সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) প্রকল্পে গত দুই অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে সরকারি পর্যায়ে নানা ঘোষণা এবং বেসরকারি মহলে ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও গত দুই বছরে তেমন অগ্রগতি হয়নি। কেবল ঢাকা উড়াল সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে পিপিপির আওতায় এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বরাদ্দ করা বাকি অর্থ কোনো কাজে আসেনি।
প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি : নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। যোগাযোগ খাতের এমন সাতটি প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকারের অপচয় হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগে এ রকম উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রকল্প রয়েছে বলে জানা গেছে।
ঋণ সহায়তা হাতছাড়া : প্রকল্প তৈরিতে দেরি, বাস্তবায়নে মন্থরগতি, অদক্ষতা ও অপচয়ের বিষয় বিবেচনায় এনে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) তাদের প্রতিশ্রুত ঋণ ও সহায়তা থেকে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার ছেঁটে ফেলেছে।
যেসব কারণে প্রশাসনে গতি নেই
আমলাদের আন্তরিকতার অভাব ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের অদক্ষতা : বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলে বিপুলসংখ্যক যোগ্য আমলাকে বর্তমান সরকার আস্থায় নিতে না পারায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের করা হয়েছে পদোন্নতিবঞ্চিত অথবা ওএসডি। আবার ঘন ঘন বদলির শিকারও হতে হচ্ছে অনেককে। এতে বিভিন্ন স্তরের আমলাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা। তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন কাজের স্পৃহা। দায়সারাভাবে কার্যদিবস শেষ করেন তাঁরা। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদপুষ্ট অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মকর্তারা বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন এবং অদক্ষ হওয়া সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এক হিসাবে দেখা যায়, বর্তমান সরকার এ পর্যন্ত প্রশাসনের উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে ৯৫০ জনকে পদোন্নতি দেয়। এতে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকার পরও পদোন্নতি পেতে ব্যর্থ হয়েছেন ৬৯৭ জন কর্মকর্তা। ২০০৯ সালের ১৬ অক্টোবর ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের নবনির্বাচিত নির্বাহী কমিটির অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, প্রশাসনে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, তা তদন্ত করে দেখা হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পরও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি মন্ত্রণালয়।
চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম : সরেজমিনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ঘুরে দেখা গেছে, যাঁরা পদোন্নতি পেয়েছেন তাঁদের মধ্যেও এক ধরনের হতাশা কাজ করছে। একজন যুগ্ম সচিব বলেন, 'আমার ডেস্কের উপসচিব চাকরিতে আমার সিনিয়র হওয়ায় তিনি আমার কোনো নির্দেশই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে চান না। ফলে ফাইল নিষ্পত্তির কাজ ঝুলে যাচ্ছে।' প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করলেন আরেক মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের (বলা হয় ১৯৮৩ ব্যাচ) একজন অতিরিক্ত সচিব, যাঁর ডেস্কের যুগ্ম সচিব হচ্ছেন ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের প্রথম ১০-এ স্থান পাওয়া কর্মকর্তা। এভাবে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড এক রকম ভেঙে পড়েছে। স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও ঝুলে যাচ্ছে।
অতিমাত্রায় প্রধানমন্ত্রী ও আমলানির্ভরতা : মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্য নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর পরিবর্তে অতিমাত্রায় আমলানির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। সংশ্লিষ্ট এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, সরকারের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রুলস অফ বিজনেস, সচিবালয় নির্দেশিকা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতাসংক্রান্ত বিধানসহ বিভিন্ন বিধিবিধানের বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নেই বেশির ভাগ মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর। ফলে আমলারা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী যেভাবে বুঝ দিচ্ছেন, সেভাবেই চলছে সব কিছু। হয় ক্ষমতা নেই অথবা নূ্যনতম আগ্রহ নেই প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই করার জন্য প্রয়োজনীয় পড়াশোনা করার। এমনকি কোনো কাজে সামান্যতম জটিলতা দেখা গেলেই প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির জন্য মন্ত্রীদের মাসের পর মাস অপেক্ষা করার নজিরও আছে। নিজ দায়িত্বে নথি ছাড় করেন না কেউ।
নথি ছাড় না করা : অন্যদিকে দায়িত্ব এড়াতে উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিবরা নিজ নিজ ডেস্ক থেকে নিষ্পন্ন না করে প্রায় সব নথি মন্ত্রীর ডেস্কে পাঠিয়ে নথিজটের সৃষ্টি করছেন। ভবিষ্যতে মামলা-মোকদ্দমা হতে পারে_এমন আশঙ্কায় বেশির ভাগ আমলা নিজের এখতিয়ার থাকা সত্ত্ব্বেও সহজেই কোনো নথি ছাড় করেন না। কারণ মামলার আসামি হওয়ার পর দেখা গেছে, সরকারের নীতি-নির্ধারকরা সহযোগিতা করার ব্যাপারে তেমন আন্তরিক হন না। ফলে সচিবালয় নির্দেশিকা অনুযায়ী নথি ছাড় করার সর্বোচ্চ সময়সীমা ৭২ ঘণ্টা কার্যকর হচ্ছে না।
সম্প্রতি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া সচিব মো. শরফুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি বর্তমান সরকারের সময় দুটি (সংস্কৃতিবিষয়ক এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ) মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলাম। দৈনিক ৫০ থেকে ৬০টি নথিতে স্বাক্ষর করতাম। এর মধ্যে মাত্র দু-তিনটি নথি আমার ডেস্কে আসার উপযুক্ত। বাকিগুলো নিচের স্তরে থেকেই নিষ্পত্তি হওয়ার কথা; কিন্তু তা হয় না।'
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব ড. মশিউর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমলাদের অহেতুক আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যাঁরা দক্ষতা ও সততার সঙ্গে কাজ করবেন, তাঁদের কোনো সমস্যা নেই। আগে কী হয়েছে তা জানি না, তবে ভবিষ্যতে যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তারাই পদোন্নতি পাবেন_এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে নিশ্চিত করেছেন।' তিনি আরো বলেন, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে নেওয়া প্রকল্পগুলো নিবিড় মনিটর করা উচিত। প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো আপত্তি এলে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
উল্লেখ্য, ক্ষমতায় আসার পর সচিবদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, 'প্রয়োজনে আইন বা বিধি সংশোধন করে দেওয়া হবে, যাতে আপনারা কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে পারেন।' আইন বা বিধির কারণে কাজ ফেলে না রাখার জন্যও নির্দেশ দেন তিনি।
প্রশাসনের স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে গত দুই বছরে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উদ্দেশে ১১টি বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়। যেমন, ২০০৯ সালের ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগের কথা জানিয়ে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের চিঠি দেয় তাঁর কার্যালয়। যাঁদের কারণে প্রশাসন স্থবির হয়ে পড়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় ওই চিঠিতে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবরা রুলস অব বিজনেসের বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘন করে প্রশাসনে ফাইলজটের সৃষ্টি করছেন বলে একই বছর ৭ মে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও ২৬ এপ্রিল অর্থসচিব এবং ২০১০ সালের ২৪ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলাদা তিনটি চিঠি দিয়ে সব সচিবদের স্মরণ করিয়ে দেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান এসব ব্যাপারে বলেন, কর্মকর্তাদের আস্থায় নিতে না পারলে তাঁরা সরকারের কাজকে নিজের কাজ মনে করতে পারবেন না। চাকরির বয়স ২৫ বছর হওয়ার পরপরই একজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরের আতঙ্ক পেয়ে বসে। স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারেন না তাঁরা। আর যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতিবঞ্চিত করা হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে গোটা প্রশাসনে। কাজের স্পৃহা হারিয়ে ফেলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিদ্যমান এসব সমস্যা জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করা না হলে সরকারের দিনবদলের সনদ ও ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন প্রকৃত অর্থেই দুরূহ হয়ে পড়বে। দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি।

No comments:

Post a Comment