Sunday, September 04, 2011

তিন চুক্তি, পাঁচ এমওইউ, দুই প্রটোকল চূড়ান্ত

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় স্বাক্ষরের জন্য গতকাল শনিবার পর্যন্ত তিনটি চুক্তি, পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) ও দুটি প্রটোকল চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ। চূড়ান্ত হওয়া চুক্তি তিনটি হলো_ তিস্তা নদীর পানিবণ্টনে অন্তর্বর্তী চুক্তি, ফেনী নদীর পানিবণ্টনে অন্তর্বর্তী চুক্তি ও ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি। এমওইউ পাঁচটি হলো_ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সহযোগিতা, মৎস্য খাতে সহযোগিতা, বিটিভি ও দূরদর্শনের মধ্যে সহযোগিতা এবং যৌথ বিনিয়োগে কয়লাভিত্তিক এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন। এ ছাড়া স্থল সীমানা ও বাঘ রক্ষায় পৃথক দুটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হবে। এর বাইরে পুরনো একটি প্রটোকলের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত (অ্যাডাপ্ট) হবে রহনপুর-সিঙ্গাবাদ রেল রুট।

গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। আজ রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সম্ভাব্য চুক্তি, এমওইউ ও প্রটোকলগুলো সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হতে পারে।
এদিকে সম্ভাব্য তিস্তা চুক্তি নিয়ে বিতর্ক এড়াতে এক সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো গতকাল ঢাকায় এসে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন। পরশু মঙ্গলবার ঢাকায় আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর থেকেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐতিহাসিক সফরের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ঢাকা। এ সফরে ভারতের সঙ্গে ১৪টি চুক্তি, এমওইউ ও প্রটোকল স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা থাকলেও গতকাল শনিবার পর্যন্ত ১০টি চূড়ান্ত হয়েছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, ট্রানজিট নিয়ে ভারতের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের আগ্রহ তিস্তা ও ফেনী নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে। এরই মধ্যে ট্রানজিট নিয়ে এ সফরে কোনো চুক্তি হচ্ছে না বলে মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। তবু হিসাবে দেখা গেছে, ট্রানজিট নিয়ে কোনো সমঝোতা হলেও তা বাস্তবায়নে কয়েক বছর সময় লাগবে।
গতকাল পর্যন্ত চূড়ান্ত হওয়া তিনটি চুক্তির দুটি তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন ১৫ বছর মেয়াদি অন্তর্বর্তী চুক্তি। পুরনো একটি প্রটোকলের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা যে রহনপুর-সিঙ্গাবাদ রেল রুট, সেটি ভুটানকে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার জন্য। শিবশঙ্কর মেনন আবারও ঢাকায় : কয়েক দিন ধরে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে দুই দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ থেকে নির্বাচিত লোকসভার এমপি কংগ্রেসের আবু হাসেম খানের বক্তব্য নিয়ে ঢাকায় ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। এরপর গতকাল ঢাকায় অনুষ্ঠেয় যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠক পিছিয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন মহলে তিস্তা চুক্তি নিয়েই শঙ্কা দেখা দেয়। এই বিতর্কের অবসান করতে গতকাল বিকেলে ঝটিকা সফরে ঢাকায় আসেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর সঙ্গে বৈঠক করেন। গত সপ্তাহেও দুদিনের সফরে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন।
শিবশঙ্কর মেননের সফর সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, মনমোহনের সফরের সার্বিক বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি আবারও ঢাকায় এসেছেন। ভারতের একজন এমপির উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশকে তিস্তার পানির ২৫ শতাংশ দেওয়া হচ্ছে বলে যে প্রতিবেদন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, 'এটা হতেই পারে না। ৪৮ঃ৫২-ও হয়তো হবে না।' তিনি বলেন, 'ঘাবড়ানোর কিছু নেই, তিস্তা চুক্তিতে বাংলাদেশ লাভবান হবে।'
এদিকে কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, শেষ পর্যন্ত তিস্তার পানি সমানভাবেই ভাগ করা হতে পারে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। জেআরসির বৈঠক না হওয়া প্রসঙ্গে জানা গেছে, তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টনে প্রায় সব কিছু ইতিমধ্যে চূড়ান্ত হয়ে গেছে। ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী পবন কুমার বানসাল সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকা সফর করবেন।
অন্যদিকে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গতকাল দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এবং পরে পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েসের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অনুবিভাগের মহাপরিচালকদের বৈঠক হয়। জানা গেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকে সফল করার বিষয়ে বৈঠকগুলোতে আলোচনা হয়েছে। মনমোহনের সফরসঙ্গীরা : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্ত্রী গুরশরণ কাউরকে নিয়ে ঢাকায় আসবেন। তাঁদের সঙ্গী হবেন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় পাঁচ রাজ্যের পাঁচ মুখ্যমন্ত্রী। তাঁরা হলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমা, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গোগোই ও মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লাল থানহাওলা। তাঁরা সবাই মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে নয়াদিলি্ল থেকে ঢাকায় আসবেন। এ ছাড়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ, পানিসম্পদমন্ত্রী পবন কুমার বানসাল, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব টি কে এ নায়ার, পররাষ্ট্রসচিব রঞ্জন মাথাই, গণমাধ্যমবিষয়ক উপদেষ্টা ড. হারিস খারিসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ঢাকায় আসছেন। জানা গেছে, ৯৩ সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধিদলের মধ্যে থাকবেন ৬৪ জন সাংবাদিক। ঢাকায় মনমোহনের সফরসূচি : ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে বহনকারী ভারতীয় বিশেষ বিমান ঢাকা পেঁৗছাবে মঙ্গলবার সকাল ১১টা ৫৫ মিনিটে। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুপুর ১২টায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ১৯ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে সালাম জানাবে সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ওই সময় বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকবেন। বিমানবন্দর থেকে দুপুর সোয়া ১২টায় মনমোহন সিংকে বহনকারী মোটর শোভাযাত্রা রওনা হবে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের উদ্দেশে। দুপুর ১টায় জাতীয় স্মৃতিসৌধে পেঁৗছে মনমোহন সিং এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আত্মত্যাগকারী বীর শহীদদের প্রতি পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর তিনি জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করবেন এবং স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে গাছের চারা রোপণ করবেন। স্মৃতিসৌধ থেকে মনমোহন সিংয়ের মোটর শোভাযাত্রা রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে পেঁৗছাবে দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে। তিনি সেখানেই দুপুরের খাবার খাবেন এবং বিশ্রাম নেবেন। বিকেল ৪টার পর মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে আলাদাভাবে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ওই সাক্ষাৎ শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যাবেন তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। অন্যদিকে মনমোহন সিংয়ের স্ত্রী গুরশরণ কাউর এ সময় গুরুদুয়ারা পরিদর্শন করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাবেন এবং পরিদর্শন শেষে সোনারগাঁও হোটেলে ফিরবেন।
মনমোহন সিং তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পেঁৗছে সেখানে শিমুল হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আধা ঘণ্টার একান্ত বৈঠকে অংশ নেবেন। এরপর বিকেল ৫টা ৩৫ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন কক্ষ চামেলীতে চলবে দুই দেশের আনুষ্ঠানিক বৈঠক। বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে এবং এরপর একটি যৌথ ঘোষণা দেওয়া হবে। এরই ফাঁকে দুই প্রধানমন্ত্রী ঢাকা থেকে সুইচ চেপে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ উদ্বোধন করবেন। সন্ধ্যা ৭টায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী সোনারগাঁও হোটেলে ফিরবেন এবং রাত ৮টায় ওই হোটেলের গ্র্যান্ড বলরুমে তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর সম্মানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আয়োজিত নৈশ ভোজে যোগ দেবেন। নৈশ ভোজে দুই প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেবেন। দ্বিতীয় দিন বুধবারের সফরসূচি অনুযায়ী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী সোনারগাঁও হোটেল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা হবেন সকাল পৌনে ১১টায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে সকাল ১১টা থেকে দুপুর পৌনে ১২টা পর্যন্ত তিনি 'ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ, সাউথ এশিয়া' শীর্ষক বক্তব্য দেবেন। সেখান থেকে সকাল তিনি বঙ্গভবনে যাবেন দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে। সেখানে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে ১২টা ৫৫ মিনিটে তিনি ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে যাবেন। সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, জাদুঘর পরিদর্শন এবং পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করবেন। সোনারগাঁও হোটেলে ফিরবেন দুপুর দেড়টায়। দুপুরের খাবারের পর বিকেল ৫টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত বিশ্রাম নেবেন। বিশ্রামের ফাঁকে তাঁর সঙ্গে আলাদাভাবে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরপর মনমোহন সিং হোটেল থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জান্তিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হবেন। বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে বিমানবন্দরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এভাবেই শেষ হবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঐতিহাসিক ঢাকা সফর। আজ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন : ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সফরের প্রাক্কালে আজ রবিবার বিকেল সাড়ে ৪টায় সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সফরের সার্বিক বিষয়গুলো নিয়ে সাংবাদিকদের জানাবেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

No comments:

Post a Comment