Sunday, September 04, 2011

বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি সহজে দূর হচ্ছে না by তারিক হোসেন খান

সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কার্যকর বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। এমনকি সাফটা চুক্তি সম্পাদনের পরও সার্কভুক্ত দেশগুলোর আন্তবাণিজ্যের পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে চরম ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। বৈধপথে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য ব্যবধান প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। ভারতে আমরা রপ্তানি করতে পারছি মাত্র দুই হাজার ২০০ কোটি টাকার পণ্য। নেপাল-ভুটানে বাণিজ্যর ট্রানজিট আর ভারতের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ঢাকাকে বাণিজ্য ব্যবধান হ্রাসে তেমন একটা সুখবর দেবে না। কেননা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে বাংলাদেশ চাহিদা অনুযায়ী ৪৭টি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলেও ২০ মিলিয়ন ডলার বা এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি সম্ভব ভারতে। তবে বাণিজ্য ব্যবধান হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে চট্টগ্রাম-মংলা বন্দর আর ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্ট। আড়াই থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ এ খাত থেকে আয় করতে পারে। তার পরও থেকে যাবে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি।
বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যগুলোর মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে তৈরি পোশাকসামগ্রী। ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছর ভারতে আট মিলিয়ন পিস তৈরি পোশাক শুল্কমুক্তভাবে রপ্তানি করার সুযোগ পেয়েছে। সম্প্রতি এ কোটা আরো দুই মিলিয়ন পিস বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য হতাশাজনক খবর হলো, পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায় ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানির সুযোগ কম। উপরন্তু বাংলাদেশের রপ্তানি ঝুড়িও ছোট। ভারত বিশ্বে আমদানি-রপ্তানি বিবেচনায় স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি রাষ্ট্র। মেশিনারি ও সামরিক সরঞ্জামের বিষয়টি বাদ দিলে ভারতের আমদানি খরচ বাংলাদেশের তুলনায় কম! দেশটির রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের রয়েছে সুনির্দিষ্ট ভিশন। প্রায় ৮০ কোটি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সস্তা শ্রমবাজার ভারতকে বিশ্বে রপ্তানিমুখী করে তুলেছে। সুতরাং যুক্তিসংগত কারণেই বোধগম্য বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানির খুব একটা সুযোগ নেই ভারতে। তবে বাণিজ্য ব্যবধান হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে চট্টগ্রাম-মংলা বন্দর আর ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্ট। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইকে গুজরাল বলেছিলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দর আর ট্রানজিট দিয়ে বাংলাদেশ আড়াই হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারে। রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক কারণে তা হচ্ছে না। ক্ষতিটা কার?' সময় এসেছে গুজরালের প্রশ্নটির চুলচেরা বিশ্লেষণের।
পররাষ্ট্রনীতি এখন আর কৌটিল্য যুগে নেই। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী ভারতবর্ষের অন্যতম চিন্তাবিদ কৌটিল্য তাঁর ক্লাসিক অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ করেছেন, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র অবধারিতভাবে 'শক্ররাষ্ট্র'। সীমান্ত প্রসারণ/আগ্রাসন সমস্যা ছাড়াও পাশের দেশটির সঙ্গে সামরিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ থাকে প্রতি রাষ্ট্রের। কাজেই কৌটিল্যের মতে, সব দেশপ্রেমী রাজন্যবর্গের উচিত পার্শ্ববর্তী শত্রু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গোপনে ষড়যন্ত্র করা। সেই রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা। কৌটিল্যের সূত্র অনুযায়ী পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রটির পাশের রাষ্ট্রটি হবে বন্ধু। কেননা শত্রুর শত্রু বন্ধু। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ নীতি পাশ্চাত্যে অকেজো হয়ে পড়ে; বরং উল্টোটা প্রতিফলিত হয়। শত বছর ধরে যুদ্ধ করা ব্রিটেন-ফ্রান্স বন্ধুত্ব স্থাপন করে। হাজার বছরের দীর্ঘ রক্তাক্ত ইতিহাস ভুলে ইউরোপে কার্যকর হয় ইইউ (ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন)। ল্যাটিন আমেরিকায়ও এখন কৌটিল্যনীতি নির্বাসিত। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-কিউবা-ভেনিজুয়েলার নেতৃত্বে সেখানে এখন কার্যকর রয়েছে পশ্চিমা শোষণবিরোধী জোট। নাফটার মাধ্যমে নিজেদের অর্থনীতির প্রায় ৭০ শতাংশ সমাপ্ত করে উত্তর আমেরিকা অনেক আগেই সীমান্তবর্তী অঞ্চলে কার্যকর সহযোগিতার ক্ষেত্র নিশ্চিত করেছে। বিশ্বের এ চলতি প্রবণতার বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চল সার্ক। নিজেদের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ সম্পন্ন করে দক্ষিণ এশীয় জোট। এর প্রধান কারণ ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ। তবে ভারতের সঙ্গে এর পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদও এই প্রবণতা উসকে দিয়েছে। আশ্চর্য লাগে, বাংলাদেশের একশ্রেণীর স্বঘোষিত জাতীয়তাবাদী 'থিংকট্যাংক' কৌটিল্যনীতিকে আঁকড়ে ধরে ভারত বিরোধিতা করছে।
ট্রানজিট কিংবা ট্রানশিপমেন্ট অথবা কানেকটিভিটি স্থাপিত হলে রাষ্ট্রের সর্বভৌমত্ব বিলুপ্ত হয় না। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সহযোগিতায় যে দ্বৈতনীতি প্রচলিত, তার মধ্যে শেষোক্তটি বাংলাদেশের জন্য বেশি কার্যকর। লাভজনক। নিরাপত্তার গ্যারান্টিসূচক। মনে রাখা জরুরি, দুটি অসম শক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতার ধারণা হাস্যকর। সক্রেটিসপূর্ব সফিস্ট গ্রিসে দার্শনিক থুকিডিসি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন_'দুটি অসম শক্তির মধ্যে ন্যায়ের ধারণাই অন্যায়। ন্যায় হলো শক্তিমানের দণ্ড, ইচ্ছা, স্থিরকৃত নীতি।' নৈতিক প্রেক্ষাপটে থুকিডিসির সমালোচনা হলেও বৈশ্বিক রাজনীতিতে এ নির্মম সত্যকেই সমর্থন করেছেন 'রিয়েল পলিটিক' খ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মর্গেন্থু।
১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারত প্রথম পানি প্রত্যাহার শুরু করে। কিন্তু বাংলাদেশকে অনূ্যন ৪৪ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার কথা ছিল। পরে জিয়াউর রহমান সরকার ৩৪ হাজার কিউসেক পানির চুক্তি করে। ১৯৭৭-এর চুক্তিতে কোনো 'গ্যারান্টি ক্লজ' ছিল না। এপ্রিল মাসের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ১০ দিন যখন গঙ্গায় পানিপ্রবাহ কমে যায়, তখন পানির কোনো নিশ্চয়তা ছিল না রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের চুক্তিতে। ১৯৭৫-এর রক্তাক্ত পটভূমি পরিবর্তনের পর গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে দিলি্লর সঙ্গে ঢাকার পানি সমস্যা শুরু হয়। গঙ্গা ইস্যুতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে বিশাল রোডমার্চ হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশের পানি সমস্যা দূর হয়নি। ভাসানী দিলি্লর ওপর চাপ প্রয়োগ করে এক ফোঁটা বাড়তি পানিও পাননি। দিলি্ল বিষয়টিকে কোনো পাত্তাই দেয়নি। এরপর বিষয়টি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করা হয়; কিন্তু ভয়াবহ সত্য হলো, ভারতের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রই নিন্দা প্রস্তাব আনেনি। এমনকি ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) কোনো মুসলিম রাষ্ট্র গঙ্গা ইস্যুতে সরাসরি বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। জেনারেল জিয়াকে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের পরামর্শ দেন। সাধারণ পরিষদ থেকে শূন্য হাতে ফিরে আশাভঙ্গের বেদনায় কাতর রাষ্ট্রপতি জিয়া ১৯৭৭ সালে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করতে ছোটেন দিলি্ল। পরে সাত্তার ও এরশাদ সরকার গঙ্গা চুক্তিতে আগ্রহী হলেও দিলি্ল ছিল নারাজ। খালেদা জিয়া সরকারের প্রথম আমলে (১৯৯১-৯৬) গঙ্গায় পানিপ্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। তিনি বিষয়টির আবারও আন্তর্জাতিকীকরণ করেন; কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে কোনো ফল আসেনি। আমাদের মনে রাখা জরুরি, বিশ্বদরবারে কোনো রাষ্ট্রই ভারতের মতো বিশাল অর্থনীতির গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে সমর্থন করবে না। বাস্তবিক পররাষ্ট্রনীতির কোনো হিসাব-নিকাশ তা কাম্য করে না। উপরন্তু ভারতের দক্ষ-রাজনীতিক-আমলারা আন্তর্জাতিক চাপ বা জনমতকে রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্ব দেয় না। কাশ্মির তার বড় প্রমাণ। জাতিসংঘ ১৯৪৭ সালে কাশ্মিরে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব পাস করে; কিন্তু ভারত তা আমলে নেয়নি। সংক্ষিপ্ত এ আলোচনার একটিই সারকথা_সমস্যার আন্তর্জাতিকীকরণ করে ঢাকা বিশ্বদরবারে সহমর্মিতা বা করুণা পেতে পারে; কিন্তু মূল লক্ষ্য অর্জন হবে না। ঢাকাকে দিলি্লর সঙ্গে বৈঠকে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বন্ধুত্ব দিয়েই ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে হবে। নতুবা বাংলাদেশকে ক্রমাগত লোকসান গুনতে হবে। গঙ্গার ঘোলা পানি তার সাক্ষী। বিশাল রোডমার্চ আর জাতিসংঘে গিয়ে আমরা গঙ্গার পানি পাইনি। শেখ হাসিনা সরকার বন্ধুত্ব দিয়েই দিলি্লর হায়দরাবাদ দরবার থেকে পানি আনেন।
গেল বছর দিলি্লর হায়দরাবাদ হাউসে শেখ হাসিনা ও মনমোহন সিংয়ের আনুষ্ঠানিক বৈঠকের একদিন পর ১২ জানুয়ারি যৌথ ঘোষণা দেওয়া হয়। ৫০ দফার ঘোষণায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমন, ট্রানজিট, সীমান্ত বিরোধ ও ব্যবস্থাপনা, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, বাণিজ্য বৈষম্য, বাংলাদেশি ৪৭টি পণ্যের প্রবেশাধিকার, ঋণ সুবিধা, বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতাসহ বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় বিষয় স্থান পেয়েছে। দিলি্ল বাংলাদেশের রেল কাঠামো, ব্রডগেজ ইঞ্জিন, বগি, রেলওয়ে কারখানা সংস্কার ও নদী পুনঃখনন প্রকল্পে ঋণ সহায়তা হিসেবে ১০০ কোটি ডলার দেবে। বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে ভারত-বাংলাদেশ একে অন্যের সমুদ্র, রেল ও সড়কপথে ব্যবহার করবে। সহজ কথায়, ভারত তার দীর্ঘ চাহিদা অনুযায়ী চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দর ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত বোন রাজ্যের সঙ্গে বিকল্প সংযোগ স্থাপন ও বাণিজ্য সহজীকরণের লক্ষ্যে দিলি্ল চাহিদামতো ট্রানজিট রুট পেয়েছে। যৌথ ঘোষণায় সন্ত্রাসবাদ দমনে দুই দেশের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিতে দিলি্ল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। কেননা উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ছাড়াও এ অঞ্চলে বর্ধিষ্ণু উগ্র মুসলিম জঙ্গিরা ভারতের নিরাপত্তার একটি প্রধান হুমকি। বাংলাদেশের কিছু দুর্গম ভূখণ্ড এসব জঙ্গির স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ বিচারে দিলি্ল নিরাপত্তা ইস্যুতে চমৎকার এক গ্যারান্টি পেয়েছে।
ইন্দিরা ডকট্রিন থেকে গুজরাল ডকট্রিন (মতবাদ); ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ঐতিহাসিক যে বিবর্তন, তার আলোকেই হাসিনা-মনমোহন ঘোষণায় বলা হয়েছে নেপাল-ভুটানে বাণিজ্য করতে ঢাকাকে ট্রানজিট দেবে দিলি্ল। একই সঙ্গে দিলি্ল ৪৭টি বাংলাদেশি পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দেওয়ার কথাও বলেছে ভারত। আগামী ৬ সেপ্টেম্বর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরে এসবই চূড়ান্ত হওয়ার কথা। স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে স্মারক দিয়ে বাংলাদেশ এখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করতে অপেক্ষা করছে। দেখা দরকার 'উদীয়মান ভারত' কতটা উদার হয়।

No comments:

Post a Comment