Saturday, August 20, 2011

মন্ত্রীদের ব্যর্থতায় নেতারা বিব্রত by জাহাঙ্গীর আলম

যোগাযোগমন্ত্রী ও নৌপরিবহনমন্ত্রীসহ কয়েকজন মন্ত্রীর ব্যর্থতা এবং বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের দায়ভার নিতে চায় না ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক দলগুলো। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতা-সাংসদেরাও এসব মন্ত্রীর কর্মকাণ্ডে বিব্রত, ক্ষুব্ধ। মহাজোটের শরিকদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে এই মন্ত্রীদের নিয়ে মহাজোট আরও বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে পারে। এ জন্য তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের ব্যর্থতা নিয়ে মহাজোটে ব্যাপক আলোচনা আছে। তাঁদের কর্মকাণ্ড, বক্তব্য ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতায় শরিক দলগুলো প্রকাশ্যেই সমালোচনামুখর।
এসব মন্ত্রীর পদত্যাগ চায় দলগুলো। মহাজোটের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কারণেই তাঁদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে মনে করেন দলগুলোর নেতারা। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যেও আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। তাঁদের বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে দলে অসন্তোষ আছে। বিশেষ করে, মন্ত্রীদের পরস্পরের প্রতি দায় চাপানোর প্রবণতায় নেতারা বিব্রত। সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কথাও বলছেন তাঁরা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী জনগণের অনুভূতির খবর রাখেন। দল মন্ত্রীদের ব্যর্থতার দায় নেবে না। নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী সময়মতো পদক্ষেপ নেবেন।
একইভাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এই কয়েকজন মন্ত্রীর ব্যর্থতা দল বা মহাজোটের ওপর বর্তায়। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তাঁদের নিজে থেকেই চলে যাওয়া উচিত।’ ক্ষমতাসীন দলের আরও কয়েকজন সাংসদ এ ধরনের মন্তব্য করেছেন। তবে তাঁরা নাম প্রকাশ করতে চাননি।
সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত দেশের যোগাযোগব্যবস্থার বেহাল অবস্থা। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো বাস চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় মানুষ এখন চরম দুর্ভেঅগে রয়েছে। এটি এখন জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকেও যোগাযোগমন্ত্রীর ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সর্বশেষ জাতীয় সংসদে সাংসদদের তোপের মুখে পড়েন যোগাযোগমন্ত্রী।
একইভাবে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান পরীক্ষা ছাড়াই সাড়ে ২৪ হাজার ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। অদক্ষ চালকদের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়লেও নৌমন্ত্রী তাঁর অবস্থানে অনড় রয়েছেন।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের দেশ পরিচালনার মেয়াদ পাঁচ বছর। চলার পথে গতি কখনো শ্লথ হবে, কখনো বাড়বে। একটা ত্রুটি হয়েছে, এটা আমরা কাটিয়ে উঠব।’
মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহাজোটে আমরা রাজনৈতিকভাবে আছি। সরকার পরিচালনায় আমাদের ভূমিকা নেই। এসব ব্যর্থ মন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী দেখেশুনে ব্যবস্থা নেবেন।’
মেনন বলেন, আইনের প্রয়োগ ছাড়া কারও ইচ্ছায় গাড়ি চালানোর পেশাদার লাইসেন্স দেওয়া যায় না। আর সরকার যতই বলুক, পুলিশের বাড়াবাড়ির কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে।
অপর শরিক জাসদের হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘মন্ত্রীদের দুর্নীতি, অদক্ষতা, ব্যর্থতার দায় আমরা নেব না। এ জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকেই জবাবদিহি করতে হবে, কৈফিয়ত দিতে হবে। মহাজোটকে বিব্রত না করে এঁদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা উচিত। তা না হলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দ্রুত ব্যবস্থা চাই।’
মহাজোটের নেতারা জানান, বাণিজ্যমন্ত্রীর ব্যর্থতা ও অদক্ষতায় মজুদদারি ও অতি মুনাফাখোরি চক্রের কাছে সরকার পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়েছে। ফলে দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলছে। ‘ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’ গড়ে তোলার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থাকলেও গত আড়াই বছরেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
বাজার-ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা ও তদারকির অভাব, অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা, বাজারকে প্রতিযোগিতামূলক করতে না পারা এবং সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ বলে মনে করে মহাজোট ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়। পাশাপাশি পরিবহনে চাঁদাবাজি, টিসিবিকে শক্তিশালী করতে না পারায় বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় বাণিজ্যমন্ত্রী জনগণকে কম খাওয়ার পরামর্শ দেওয়ায় সব মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, পুলিশের উপস্থিতিতে গণপিটুনিতে নিরীহ মানুষ হত্যার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতাকে দায়ী করা হচ্ছে। চাঁদাবাজি ও দখলবাজি নিয়ন্ত্রণেও পুলিশ সফলতা পায়নি।
মহাজোটের নেতারা মনে করেন, পুলিশের ওপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি কম থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে।
সম্প্রতি পুলিশের উপস্থিতিতে রাজধানীতে ছয় ছাত্র হত্যার ঘটনা সমাজে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। নোয়াখালীতে পুলিশ মিলন নামের এক তরুণকে গাড়ি থেকে নামিয়ে জনতার হাতে তুলে দেয়। গণপিটুনিতে সে নিহত হলে পুলিশ আবার গাড়িতে তুলে নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরকে অপরাধী বানাতে পুলিশ মিথ্যা গল্প সাজিয়েছে। র‌্যাবের গুলিতে লিমনের পঙ্গু হওয়ার ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের নেতারা মনে করেন, এসব ঘটনা জনগণ ভালোভাবে নেয়নি।
এ ব্যাপারে জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অযোগ্য, ব্যর্থ ও অকর্মণ্য মন্ত্রীদের দায়ভার নেব না। এদের বিদায় দেওয়া না হলে মহাজোট বিপর্যয়ে পড়বে।’
১৪ দলের শরিক কমিউনিস্ট কেন্দ্রের যুগ্ম আহ্বায়ক অসিত বরণ বিশ্বাস বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রী যেদিন কথা বলেন, সেদিনই জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। ১৪ দলের ২৩ দফায় আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের কথা বলা ছিল। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই। কাজেই অযোগ্য মন্ত্রীদের দায়ভার ১৪ দল নেবে না।
মহাজোটের শরিক ও নিজের দলের নেতাদের দাবির মুখে পদত্যাগ করবেন কি না, জানতে চাইলে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা করতে হলে আগে আমাকে ভাবতে হবে। যাঁরা আমাকে ভোট দিয়েছেন, আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষ কী মনে করেন। পাশাপাশি আমার নিয়োগকর্তা কী বলেন।’
আপনার নিজের বিবেচনায় কী মনে হয়, পদত্যাগ করা উচিত? মন্ত্রী বলেন, ‘আমার ত্রুটির কারণে এ সমস্যা দেখা দেয়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বরাদ্দ কম থাকার কারণে রাস্তাঘাটের এ অবস্থা হয়েছে।’
দেশের রাস্তাঘাটের বেহাল দশার কথা শুধু যে এখন বলা হচ্ছে, তা নয়। গত ৪ ফেব্রুয়ারি সংসদে এ নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা হয়। সেদিন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সাংসদ এ প্রসঙ্গ তুলে বলেছিলেন, গত আড়াই বছরে দেশের কোথাও সড়কের উন্নয়নে কাজ হয়নি। রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। এরপর রাশেদ খান মেননও সংসদে এ প্রসঙ্গ নিয়ে বক্তব্য দেন। কিন্তু যোগাযোগমন্ত্রী বা সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

No comments:

Post a Comment