Saturday, August 20, 2011

ঈদে বাড়ি যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় মানুষ by ইফতেখার মাহমুদ ও অনিকা ফারজানা

দূরপাল্লার বাসের অগ্রিম টিকিটের জন্য চলছে হাহাকার। ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হচ্ছে কাল রোববার। বেহাল মহাসড়কের কারণে বাস চলাচলও বিপর্যস্ত। তাই এবার প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপনের জন্য বাড়ি যাওয়া নিয়ে মানুষ এখনো রয়েছে অনিশ্চয়তায়, শঙ্কায়।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর গাবতলী, শ্যামলী, কল্যাণপুর, কলাবাগান ও সায়েদাবাদে অধিকাংশ বাস কাউন্টারের কর্মীরা জানিয়েছেন, তাঁদের অগ্রিম টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। বাসমালিক-শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, বিধ্বস্ত সড়কের কারণে প্রতিদিনই মহাসড়কে বাস বিকল বা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য বাসের ট্রিপ (যাত্রা) কমিয়ে দিতে হয়েছে। ট্রিপ কমে যাওয়ায় টিকিটও কমেছে।
হানিফ পরিবহনের কাউন্টারের কর্মী জামিল জানান, অন্যান্য বছরের মতো এবার ঈদে অতিরিক্ত বাস নামানোর বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ভাঙা রাস্তার কারণে মালিকপক্ষও এ ব্যাপারে আগ্রহী নয়। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ—দুই দিকেই স্বাভাবিক সময়ে হানিফের প্রায় ৬০টি করে বাস চলে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে চলাচল করা এস আলম পরিবহনের ফকিরেরপুল কাউন্টারের মো. মানিক জানান, ২৫ তারিখের পরের কোনো টিকিট নেই। সব বিক্রি হয়ে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে এই পথে ৩৫-৪০টি বাস চলে। ঈদের সময় চার-পাঁচটি অতিরিক্ত বাস নামানো হয়। কিন্তু এবার অতিরিক্ত বাস নামানো হবে কি না, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
কল্যাণপুরে কুষ্টিয়া, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, রাজশাহীসহ উত্তরবঙ্গে চলাচলকারী বাসের টিকিট কাউন্টারগুলোর কর্মীরা দাবি করেন, আগামী ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে।
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে এশিয়া পরিবহনের ব্যবস্থাপক আবদুর রব জানান, দিনে সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে ২০টি পথে প্রায় এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৮০০ বাস ছেড়ে যেত। এক সপ্তাহ ধরে বাসের সংখ্যা এক হাজারে নেমে এসেছে। ঈদ উপলক্ষে যাত্রীর চাপ বাড়তে শুরু করলেও বাসের সংখ্যা বাড়ছে না।
সায়েদাবাদ টার্মিনাল বাস মালিক সমিতি ঘোষণা দিয়েছে, তারা অগ্রিম টিকিট বিক্রি করবে না। কয়েকটি কোম্পানি ২১ আগস্ট থেকে অগ্রিম টিকিট বিক্রির কথা জানিয়েছে। অনেকে গতকাল থেকেই অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু করেছে।
অগ্রিম টিকিটের জন্য যাত্রীদের এক কাউন্টার থেকে আরেক কাউন্টারে হন্যে হয়ে ঘুরতে দেখা গেছে। কিন্তু তাদের অনেককেই ফিরতে হয়েছে খালি হাতে।
সায়েদাবাদে শ্যামলী পরিবহন কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেল, কাউন্টারের ব্যবস্থাপক হেলালউদ্দিন যাত্রীদের অগ্রিম টিকিট নেই বলে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলা শুরু করলে যাত্রীদের কাছে অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু করেন তিনি। তিনি জানান, দিনে বাস ছাড়া যাচ্ছে না। রাতে অল্প কিছু বাস চলায় টিকিট কম।
বাসমালিক ও শ্রমিকেরা জানান, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে যাত্রাবাড়ী অতিক্রম করতে দুই থেকে চার ঘণ্টা লাগছে। চট্টগ্রাম রুটের বাসগুলোকে কুমিল্লার গৌরীপুর থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পর্যন্ত ভাঙাচোরা রাস্তা অতিক্রম করতে লেগে যায় আরও তিন থেকে চার ঘণ্টা। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামে যেতে আগে সময় লাগত ছয় ঘণ্টা, এখন ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টায় গিয়ে ঠেকেছে।
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা গেছে, এই টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া প্রায় আড়াই হাজার বাসে দৈনিক প্রায় আট হাজার চালক ও শ্রমিক কাজ করেন। প্রতি ট্রিপে চালক, সুপারভাইজার ও হেলপার মিলে দূরত্ব বুঝে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা পান। বাসের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এবং যানজটের কারণে তাঁরা আগের মতো ট্রিপ পাচ্ছেন না। অর্ধেক শ্রমিক-চালকের কাজ নেই।
কালোবাজারি: কাউন্টার থেকে টিকিট শেষ বলা হলেও গাবতলী ও শ্যামলীতে কালোবাজারে বেশি দামে বিভিন্ন গন্তব্যের টিকিট বিক্রি হতে দেখা গেছে। গাবতলীতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা রাজশাহীর পাঁচটি টিকিটের খোঁজ করছিলেন সুরুজ মিয়া। দালাল নুরুদ্দিন টিকিটপ্রতি ১৫০ টাকা বেশি চান। দর-কষাকষির একপর্যায়ে টিকিটপ্রতি ১০০ টাকা বেশি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত টিকিটগুলো কেনেন তিনি। রংপুর-ভূরুঙ্গামারী পথের বাসের কাউন্টারে কোনো টিকিট নেই। কিন্তু কাউন্টারের সামনে থাকা আবদুস সালামের কাছে ছিল অনেক টিকিট। এই প্রতিবেদক ক্রেতা সেজে দাম জানতে চাইলে টিকিটপ্রতি ৮০ টাকা বাড়তি চান।
শ্যামলীতে হানিফ পরিবহনের কাউন্টারে গিয়ে জানা গেল, কুষ্টিয়ার কোনো টিকিট নেই। ওই কাউন্টারের ২০-৩০ গজ দূরে একটি চায়ের দোকানে বেশ ভিড় দেখে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ২৮ ও ২৯ আগস্টের টিকিট রয়েছে। তবে ৩০০ টাকার টিকিট ৬০০ টাকা। ওই দামেই টিকিট কিনে লটারি জয়ের মতো খুশি হলেন হাসান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘টাকা দিয়ে কী হবে, টিকিট তো পেলাম। বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতে রান্না খেতে পারব, এর চেয়ে বেশি আর কী চাই।’
মহাখালীতে ভিন্ন চিত্র: মহাখালী আন্তজেলা বাস টার্মিনালে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। যাত্রী প্রায় নেই। কাউন্টারের কর্মীরা কেউ ঘুমাচ্ছেন, কেউ খবরের কাগজ পড়ছেন। যাত্রী নেই কেন—জানতে চাইলে ঢাকা-টাঙ্গাইল পথে চলাচল করা গোপালপুর পরিবহনের কাউন্টারের জহির জানান, একে তো রাস্তা খারাপ, তার ওপর কয়েক দিনের সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যাত্রীরাও আসেন না। যোগাযোগমন্ত্রীর ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে তিনি বলেন, ‘তাঁর কারণে ঈদের বাজারে যাত্রী নাই। আমাগো দিন কাটব কেমনে?’
কমেছে বাসের সংখ্যা: রাজধানী থেকে বরিশাল-বাগেরহাট মহাসড়কের প্রায় ১৬ কিলোমিটার রাস্তা ভাঙাচোরা থাকায় এই পথে বাস চলাচলও কমে গেছে। ফলে এই পথের বাসের টিকিটও কমে গেছে। তাই কাউন্টারে এসে অনেকে টিকিট পাচ্ছেন না। কিশোরগঞ্জ পথের অবস্থাও একই রকম। বরিশাল ও বাগেরহাট পথে স্বাভাবিক সময়ে ১৫০টি ও কিশোরগঞ্জ পথে ২০০টি বাস চলত। এই দুই পথে বাসের সংখ্যা ৫০ থেকে ৭০টি কমে গেছে।
ট্রেনে চাপ বেড়েছে: মহাসড়কের বেহাল অবস্থার কারণে কয়েক দিন ধরে ট্রেনে যাত্রীদের চাপ বেড়েছে। ঈদ উপলক্ষে এই চাপ আরও বাড়বে। গতকালও কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, কাউন্টারের সামনে টিকিটের জন্য আসা মানুষের লম্বা সারি। কেউ কেউ সারিতে আছেন দীর্ঘক্ষণ। কিন্তু কাউন্টারে পৌঁছে শুনলেন, তাঁর গন্তব্যের টিকিট নেই। স্বাভাবিক সময়ে যাত্রার জন্য টিকিট না পেয়ে ফিরতে হচ্ছে অনেককে। রোববার থেকে ঈদ উপলক্ষে অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হলে টিকিটের জন্য হাহাকার আরও বাড়বে বলে জানালেন যাত্রীরা।
কাউন্টার থেকে ‘টিকিট নেই’ বলা হলেও গতকাল কয়েকজন দালালের হাতে টিকিট দেখা গেছে। টিকিটপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশিতে তারা টিকিট বিক্রি করছে। মেরাদিয়া থেকে আসা পোশাককর্মী খলিল টাঙ্গাইলে যাবেন। তিনি জানান, তাঁর মা অসুস্থ। বাড়ি থেকে খবর এসেছে। তাই দালালের সঙ্গে দর-কষাকষি করে ৮০ টাকা দিয়ে শনিবারের একতার একটি টিকিট কিনেছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাহসিন জানান, কাউন্টার থেকে ব্রহ্মপুত্রের টিকিট পাননি। কিন্তু দালাল ১০০ টাকা বেশি নিয়ে টিকিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য স্টেশনমাস্টার কামরুজ্জামানকে পাওয়া যায়নি। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও তাঁর দেখা মেলেনি।
কবে কোন দিনের টিকিট বিক্রি হবে: রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানায়, ঈদের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হবে রোববার থেকে। সেদিন বিক্রি হবে ২৬ আগস্টের টিকিট। ২২ তারিখ বিক্রি হবে ২৭ আগস্টের টিকিট। ২৩ তারিখ বিক্রি হবে ২৮ আগস্টের টিকিট। ২৪ তারিখ বিক্রি হবে ২৯ আগস্টের টিকিট। ২৫ তারিখ বিক্রি হবে ৩০ আগস্টের টিকিট। একসঙ্গে চারটির বেশি টিকিট কেনা যাবে না।

No comments:

Post a Comment