Tuesday, August 16, 2011

সমকালীন অনুরণন by নন্দিনী মুখার্জি

বাংলা বছরের শুরুতে আমাদের লোকশিল্প নিয়ে বিবিধ আয়োজনের সমাগমে সারা দেশ যেন হয়ে ওঠে লোকজ শিল্পের হাট। ঢাকায় দুটি প্রদর্শনীর আয়োজন ছিল ভিন্নধর্মী। একটি সরাচিত্র এবং অপরটি শখের হাঁড়ি নিয়ে। এমন আয়োজন নাগরিক জীবনে এক ব্যতিক্রমী ভাবনাকে সজাগ করে তুলেছে।
ঢাকা আর্ট সেন্টার, ধানমন্ডিতে শেষ হলো শিল্পী সুকুমার পালের ‘ফিরে চল মাটির টানে’ শিরোনামে সরাচিত্র প্রদর্শনী। বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার এক ব্যতিক্রমী প্রয়াস ছিল এখানে। শুধু প্রদর্শনী নয়, এর পাশাপাশি একটি কর্মশালার আয়োজনও করা হয়েছিল। তরুণ শিল্পীদের অংশগ্রহণে শিল্পী সুকুমার পাল এই কর্মশালায় সরাচিত্র অঙ্কন ও সমকালীন চিত্রকলার সঙ্গে আমাদের লোকশিল্পের যোগসূত্র তৈরির চেষ্টা করেছেন। তিনি মনে করেন, দেশজ শিল্পের শক্তি অনুভব না করলে কাজে যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায় না।
এ দেশে ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কিছু সরাচিত্র চোখে পড়লেও ঐতিহ্যবাহী সরাচিত্র এখন বিলুপ্তির পথে। তিনি মূলধারার শিল্পকলার সঙ্গে একাত্ম না হয়ে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী অথচ অবহেলিত শিল্প নিয়ে নিরলস কাজ করে চলেছেন। ‘বিস্তৃত মুখ ঈষৎ গভীর মৃৎপাত্র’কে বাঙালিরা সরা বলে। সাধারণত হাঁড়ি বা কলসি ঢাকার পাত্র হিসেবেই ব্যবহূত হয় সরা। আকৃতি ও ব্যবহারের ভিন্নতায় সরার নানা নামকরণ দেখা যায়; ঢাকনাসরা, এয়োসরা, ফুলসরা, ধূপসরা, আমসরা, লক্ষ্মীসরা প্রভৃতি। সরা বিভিন্ন ধর্মীয় ও পালা-পার্বণে ব্যবহূত হয়। হিন্দুসম্প্রদায়ের বিয়ে এবং মুসলমানদের গাজি বা মহররমের ছবি সরাতে অঙ্কিত হয়।
শিল্পী সুকুমার পাল ঐতিহ্যবাহী সরাচিত্র থেকে রং-রেখা ছাড়াও গোলাকৃতির পটভূমিকেও গ্রহণ করেছেন। তিনি চারুকলা অনুষদ থেকে লেখাপড়া শেষ করে সংস্কৃতির এই শিকড়ে ফিরে গেছেন।
গ্যালারি জলরঙ—এটি একটি অনলাইন গ্যালারি হিসেবে পরিচিত ছিল এত দিন। এখন বনানীতে ছোট পরিসরে অন্যান্য গ্যালারির মতো শুরু হয়েছে তাদের নতুন যাত্রা। সম্প্রতি এই গ্যালারিতে শুরু হয়েছে লোকশিল্পী সুশান্ত পালের একক চিত্র প্রদর্শনী।
সুশান্ত পাল শৈশব থেকেই শখের হাঁড়ির সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠেন। তাঁর রয়েছে বংশানুক্রমিক দক্ষতা। স্বভাবতই ঐতিহ্যবাহী নকশা ব্যবহার করেন সুশান্ত পাল। শখের হাঁড়ির পাশাপাশি ২০০৯ সাল থেকে তিনি কাগজে পেইন্টিং শুরু করেন।
বাংলাদেশের বর্তমান জীবনধারায় মাটির পাত্রের ব্যবহার সীমিত। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ক্যানভাস বা কাগজে সুশান্ত পাল আঁকতে শুরু করেছেন। তবে লক্ষ করলে দেখা যায়, রং, রেখা, বিন্যাস, নকশার প্রবণতা মাটির পাত্রের মতোই। এমনকি প্যানেলও শখের হাঁড়ির মতো। তাই বলা যায়, হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ির রং, রেখা, নকশার এ এক নতুন পদ্ধতি। তাঁর আঁকা সব পেইন্টিংই ট্র্যাডিশনাল মোটিফের পুনরাবৃত্তি নয়। তাঁর কিছু কিছু পেইন্টিং ট্র্যাডিশনাল পেইন্টিং থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা। শুধু তা-ই নয়, তাঁর চিত্রমালা পটুয়া, মালাকার বা আচার্যদের মতো নয়। বাংলাদেশের ভিজুয়াল আর্টে এ এক নতুন মাত্রা তৈরি করেছে। সুশান্ত পালের চিত্রকলাকে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বা রূপান্তর-প্রক্রিয়া বলা যায়। এই প্রদর্শনী আমাদের শিল্প-ঐতিহ্যে স্থান করে নিতে পারবে বলে আশাবাদী হওয়া যায়। ২২ এপ্রিল প্রদর্শনী শেষ হবে।

No comments:

Post a Comment