Sunday, February 13, 2011

তেল নিয়ে তেলেসমাতি

চাল নিয়ে চালবাজি তো চলছেই, এখন শুরু হয়েছে তেল নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ডকারখানা। বাজার থেকে ভোজ্যতেল সয়াবিন প্রায় উধাও হয়ে যাওয়ার পর তা ১২ টাকা বাড়তি দাম নিয়ে ফিরে এসেছে। গত কয়েক দিন বাজারে সয়াবিনের সরবরাহ ছিল না বললেই চলে।

অথচ গতকাল শনিবার বাজার সয়াবিনে সয়লাব। ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর জন্যই কয়েক দিন ধরে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছিল। আর লিটারে ১২ টাকা বাড়ানোর মাধ্যমে সেই সংকট কেটে গেল গতকাল।
সরকার বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অবশ্য এবার আর তেমন কোনো কথা বলছে না। অথচ আড়াই মাস আগে এক দিনে লিটারে ১৩ টাকা বাড়ার ঘটনায় নড়েচড়ে উঠেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত ২৯ নভেম্বর এক দিনে ১৩ টাকা বাড়ানোর কারণে ব্যবসায়ীদের ওপর চটেছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান। সচিবালয়ে ডেকে তিনি তাঁদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এটা মগের মুল্লুক না। ইচ্ছেমতো ভোজ্যতেলের দর বাড়ানো চলবে না। এক দিনের ব্যবধানে ১৩ টাকা বাড়ানো কোনো ব্যবসার লক্ষণ নয়।’
তবে ব্যবসায়ীদের মুখে সেই পুরোনো কথা, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে বলেই তাঁরাও বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। ব্যবসায়ীরা আরও জানান, সরকারই দাম বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছে, তাই তাঁরা বাড়িয়েছেন। আর সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বক্তব্য হচ্ছে, যত টাকা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, তার চেয়েও অনেক বেশি হারে বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বোতলজাত সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) রাখা হয়েছে লিটার ১১৪ টাকা। আবার নজিরবিহীনভাবে খোলা সয়াবিন তেলের দরও বোতলজাতের সমানই। আর পামতেল বিক্রি হচ্ছে বাজারে ১০৫ থেকে ১০৬ টাকা লিটার।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বিভিন্ন দোকান সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ৯ ফেব্রুয়ারি উৎপাদিত রূপচাঁদা পাঁচ লিটারের বোতলের খুচরা মূল্য ৫৭০ টাকা। আগে ছিল তা ৫১০ টাকা। রূপচাঁদার সঙ্গে আগে কয়েক টাকা পার্থক্য থাকলেও পুষ্টি, তীর, ফ্রেশ, দাদা, রুবাইয়া, মোস্তফা ইত্যাদি ব্র্যান্ডের সয়াবিনেরও বর্তমানে একই দর। দোকানদারেরা জানান, এখন সব সমান। গত শুক্রবার থেকে নতুন দর কার্যকর করা হয়েছে।
গত ৫ ডিসেম্বর সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণের বৈঠক শেষে বাণিজ্যসচিব ১৫ দিন পরপর দাম পুনর্নির্ধারণের কথা জানিয়েছিলেন। ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানকে প্রধান করে একটি কমিটিও করে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বৈঠক ঠিকই অনুষ্ঠিত হয় ২২ ডিসেম্বর। দুবারই ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তারপর থেকেই মন্ত্রণালয় নীরব।
তবে সরকার নির্ধারণ করে দিলেও কোনোবারই নির্ধারিত দরে বিক্রি হয়নি ভোজ্যতেল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, ‘ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যৌথ বৈঠক করেও কোনো লাভ হয় না। কারণ, নির্ধারিত দরের কোনো প্রভাব থাকে না বাজারে। ব্যবসায়ীরা যা করার তা-ই করেন।’
বিক্রি না করে কৃত্রিম সংকট: ভোজ্যতেলের বাজারে মেঘনা গ্রুপ একটি সুপরিচিত নাম। ফ্রেশ ব্র্যান্ডের সয়াবিন এ কোম্পানির পণ্য। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোম্পানিটি দিন দিন বাজারে তেল পরিবেশন কমিয়ে এনেছে। অর্থাৎ বিক্রি করা হয়নি। ঢাকা চেম্বারের এক সেমিনারে বাণিজ্যমন্ত্রী এ ধরনের বিষয়কেই কৃত্রিম সংকট বলে অভিহিত করেছেন।
মেঘনা গ্রুপের চার মাসের বিক্রয়চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অক্টোবরে কোম্পানিটি দুই হাজার ৯০০ টন সয়াবিন বিক্রি করে। নভেম্বরে দুই হাজার ৭৬৯ টন, ডিসেম্বরে এক হাজার ৯৩ টন এবং জানুয়ারিতে বিক্রি নামিয়ে আনা হয়েছে মাত্র ২০২ টনে।
এলসি কম খোলা হয়েছে: ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানা সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে ১২ থেকে ১৩ লাখ টনের ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে দেশে। মাসিক চাহিদা এক থেকে সোয়া লাখ টন। এই চাহিদা পূরণ হয় আমদানি করা সয়াবিন ও পামতেলের মাধ্যমে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হওয়া সরিষার মাধ্যমেও কিছুটা চাহিদা পূরণ হয়। আমদানি হয় মূলত মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, সয়াবিন ও পাম মিলিয়ে বর্তমানে এক লাখ ৩০ হাজার টন ভোজ্যতেলের মজুদ রয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেলের লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলা কমিয়ে দিয়েছেন। ডিসেম্বর-জানুয়ারি সময়ে ২৪ হাজার ৫০০ টন অপরিশোধিত সয়াবিন এবং ৩১ হাজার ১৭৬ টন পামতেল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। দাম বাড়ানোর জন্য সরকারকে চাপ দেওয়ার কৌশল হিসেবে ব্যবসায়ীরা এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উদাহরণ দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা জানান, ভোক্তাদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ পামতেল, ৩৪ শতাংশ সয়াবিন তেল এবং ৮ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সরিষা ও অন্যান্য তেল ব্যবহার করে।
বৃহস্পতিবারের বৈঠকে দর নির্ধারণ: জানা গেছে, ভোজ্যতেলের দর নির্ধারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্যারিফ কমিশন কয়েক দফা বৈঠক করেও কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি। ব্যবসায়ীরা চান বেশি বাড়াতে আর কমিশন চায় যথাসম্ভব কম রাখা যায়।
গত বুধবারও এ নিয়ে নিষ্ফল বৈঠক হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ট্যারিফ কমিশনে আবার জরুরি বৈঠকে ডাকা হয় ব্যবসায়ীদের। ওই বৈঠকে নতুন দর নির্ধারিত হয়। এবার জাহাজভাড়া, কর, পরিশোধন ব্যয়, ব্যাংকের সুদ, পরিশোধনজনিত ঘাটতি এবং মুনাফাসহ মিল গেটে খোলা সয়াবিনের নতুন দর নির্ধারণ করা হয় ১০০ টাকা। খুচরা বাজারে চার টাকা করে যোগ হবে। আর বোতলজাত সয়াবিনের ক্ষেত্রে এ মূল্যের সঙ্গে বোতলের দাম যোগ হবে।
যোগাযোগ করলে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সয়াবিনের নতুন দর লিটার ১০০ টাকা সুপারিশ করা হয়েছে। এর সঙ্গে বোতলের দাম যোগ হলেও কোনো অবস্থাতেই তা ১১৪ টাকা লিটার হতে পারে না। কাল রোববারই (আজ) বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’ বাজারে চালু সব ব্র্যান্ডেরই পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেলের এমআরপি ৫৭০ টাকা লেখা রয়েছে জানানো হলে বিস্মিত মজিবুর রহমান বলেন, ‘এটি কীভাবে সম্ভব! একটি পেট বোতলের দাম কি তাহলে ৭০ টাকা!’
পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, বোতলের গায়ে নতুন মূল্য ০৯.০২.১১ তারিখ উল্লেখ রয়েছে। শুভ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম জানান, পরিবেশকদের কাছে মজুদ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা তেল বিক্রি করেন না। আগের কেনা তেলও নতুন দামে বিক্রি করছেন অনেকে।
বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের প্রধান শোয়েব মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক মাস ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে। সরকারই দেশীয় বাজারে বাড়তে দিচ্ছিল না। নতুন দর ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না।
বাংলাদেশ ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম এ হাশেম প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়লেও তাঁদের কোনো লাভ হয় না। কারণ, তাঁরা কেজিতে ৩০ থেকে ৫০ পয়সা করে মুনাফা করেন। আসল মুনাফা করেন পরিশোধনকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।

No comments:

Post a Comment