Sunday, July 31, 2011

তাহের পুত্র বিপ্লবের প্রাণদণ্ড মওকুফঃ নতুন করে দেয়া হচ্ছে ‘লাইসেন্স টু কিল’? by জামশেদ মেহ্দী

য়ান ফেমিংয়ের অসাধারণ জনপ্রিয় স্পাই থ্রিলার ‘জেমস বন্ড’। ৬০ এর দশকের প্রথমার্ধে জেমস বন্ডের চরিত্র রূপায়ণ করে সমগ্র পৃথিবীতে দুর্ধর্ষ গুপ্তচর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন সিনকোনারি সিনকোনারিকে মার্কিন সরকার দিয়েছিল দুটি অবিশ্বাস্য মতা। একটি হলো : দুঃসাহাসিক অভিযানে শরীর-মনকে ঝরঝরে ও প্রফুল্ল রাখার জন্য অবাধ নারী সম্ভোগ। আয়ান ফেমিংয়ের জেমস বন্ড সিরিজে এই যদৃচ্ছ দেহ মিলনের রগরগে বর্ণনা পাওয়া যায় এবং বন্ড সিনেমাসমূহে এসব আদিম ক্রিয়াকলাপের উত্তেজক দৃশ্য দেখা যায়। মার্কিন সরকার তাদেরও এই দুর্ধর্ষ স্পাইকে আরেকটি যে অসাধারণ মতা দিয়েছিল সেটা হলো ‘লাইসেন্স টু কিল’। অর্থাৎ নরহত্যার লাইসেন্স।

‘ডক্টর নো’, ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’সহ একাধিক বন্ড সিরিজে জেমস বন্ড রূপী সিনকোনারি বা রজার মুরকে বেপরোয়া মানুষ খুন করতে দেখা গেছে। সরকারি ছত্রছায়ায় নির্বিচার নরহত্যার অধিকার দেয়া হয়েছিল ‘প্যানিক ইন ব্যাংকক’ ছবিতে সরকারি গোয়েন্দা হিউবার্ট বার্টনকে অথবা ফ্যান্টোমাসকে। এবার গত ২১ এপ্রিল শুক্রবার বাংলাদেশে আওয়ামী লাঠিয়াল বাহিনীকে নরহত্যার আনুষ্ঠানিক সরকারি অধিকার দিলেন আওয়ামী শাহীর প্রধান শেখ হাসিনা। কিন্তু কাদেরকে এই মানুষ খুনের অধিকার দেয়া হলো? নরহত্যা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তারপরও সিনকোনারি, রজার মুর বা হিউবার্ট বার্টনকে সেই লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রুশ সাবভার্সন থেকে রার জন্য। কিন্তু এখানে শেখ হাসিনা ওই ভয়ংকর অধিকার দিচ্ছেন কোনো কর্মটি করার জন্য? উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারকগণকে লাঠিপেটা করার জন্য? আর কাদেরকে দেয়া হচ্ছে সেই অধিকার? ওইসব আওয়ামী মাস্তান এবং রংবাজ, যাদের কাজ হলো হাইকমান্ডের অর্ডারে আওয়ামী লীগের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী হিসেবে কাজ করা। আর আওয়ামী লাঠিয়াল হওয়ার এনাম হিসেবে অন্য সময় ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি ও ধর্ষণ করা। বাংলাদেশের মানুষ বিপন্ন বিস্ময়ে ল্য করছেন যে সরকার চেঙ্গিস খান এবং হালাকু খানের মতো রক্তপিপাসু হতে যাচ্ছেন। তারা বাংলাদেশকে লুটেরা এবং বর্গীর দেশ বানাতে চলেছেন।
এসব কথা এসে যাচ্ছে আজ প্রমাণিত খুনীদের স্বয়ং প্রেসিডেন্ট কর্তৃক অনুকম্পা প্রদর্শনের ফলে। এর সর্বশেষ ঘটনা হলো স্বনামধন্য গডফাদার লক্ষ্মীপুরের তাহের পুত্র বিপ্লবকে মাফ করার পর। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় যে, গত ১৪ জুলাই লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র ও এই এলাকার গডফাদার বলে পরিচিত আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহেরের পুত্র এ এইচ এম বিপ্লবের ফাঁসির দণ্ডাদেশ মওকুফ করেছেন মহামান্য প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান। লক্ষ্মীপুর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং আইনজীবী এডভোকেট নূরুল ইসলাম হত্যা মামলায় দ্রুত বিচার আদালত তাহের পুত্র বিপ্লবের ফাঁসির আদেশ দেয়। আবু তাহেরের অপর পুত্র সালাউদ্দিন টিপু অপর একটি জাতীয় দৈনিককে জানিয়েছেন যে, শুধুমাত্র এডভোকেট নূরুল ইসলাম হত্যা মামলা নয়, ছাত্র লীগ কর্মী কামাল হত্যা মামলায় প্রদত্ত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকেও বিপ্লবকে মাফ করেছেন প্রেসিডেন্ট। টিপুর বক্তব্য মতে, শিবির নেতা মহসিন হত্যা মামলায় প্রদত্ত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও মওকুফ হওয়ার কথা ছিল। তবে নথিতে সামান্য ‘ত্রুটি’ থাকায় এই মওকুফ প্রক্রিয়া কিছুটা পিছিয়ে গেছে। দৈনিক ‘কালের কণ্ঠে’ ২১ জুলাই প্রকাশিত দ্বিতীয় প্রধান সংবাদে সালাউদ্দিন টিপু বলেন, “সাজা মওকুফের নথি আমরা আটকে রেখেছি। ধীরে ধীরে সব নথি পাঠানো হবে। মহসিন হত্যা মামলার নথিতে যে সামান্য ভুল হয়েছিল সেটি সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।” ইচ্ছা করলেই প্রেসিডেন্ট মাফ করতে পারেন না। বলা হয় যে সংবিধানে প্রাণদণ্ড মওকুফের মতা প্রেসিডেন্টকে দেয়া হয়েছে। তিনি সেই মতা প্রয়োগ করেছেন। তাহলে ভুল হলো কোথায়? আসলে প্রেসিডেন্ট নিজের খেয়াল খুশি মাফিক যাকে ইচ্ছা তার প্রাণদণ্ড রহিত করতে পারেন না। তাকেও কতগুলো নৈতিক ও অকথিত বিধি বিধান মেনে চলতে হবে। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমরা জানি, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনে অপরাধীকে মা করে দেয়ার বিশেষ অধিকার দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রপতিকে। এই অধিকার পৃথিবীর প্রায় সব সংবিধানে দেয়া হয়েছে। ইংল্যান্ডে সেই ১৩৭২ সালে তৃতীয় এডওয়ার্ডের অভিষেক উপলে ঢালাও মা করে দেয়া হয়েছিল বহু অপরাধীকে। কিন্তু সেই যুগ এখন আর নেই। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন সংবিধানে (যেমন আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া, দণি অফ্রিকা) রাষ্ট্রপতির মা করার অধিকারকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে বা শর্তারোপ করে। যেখানে সংবিধান এটি করতে পারেনি, সেখানে বিচার বিভাগ (যেমন ব্রিটেন, আমেরিকা, ভারত) এই মতা প্রয়োগে স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করতে বিভিন্ন রায় দিয়েছে। ভারতের সংবিধানে প্রায় অবিকল বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু সেখানে ১৯৮০ সালে ‘মারু রাম বনাম ইন্ডিয়া’ মামলায় বলা হয়, কোনো বিবেচনা বা কাজ সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক, স্বেচ্ছাচার প্রসূত বা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে না। এসব েেত্র আদালত রাষ্ট্রপতির মা প্রদান মতার প্রয়োগের ন্যায্যতা পরীা করে দেখতে পারে। ১৯৮৯ সালে ‘কেহার সিং’ মামলায় ভারতের সুপ্রীমকোর্ট বলেছিলেন, কেবল অসঙ্গত হয়রানি ও প্রতীয়মান ভুলের েেত্র মার্জনা করার মতা প্রয়োগ করা যেতে পারে। ভারতের সংবিধানে এই মতা রাজ্যগুলোতে প্রয়োগের অধিকার রয়েছে গভর্নরের। ২০০০ সালে ‘সাতপাল বনাম হরিয়ানা’ মামলায় সুপ্রিমকোর্ট বলেন, আদালত মার্জনার আদেশ রদ করতে পারেন, যদি গভর্নর রেকর্ডে থাকা তথ্যাবলির দিকে নজর না দিয়ে যান্ত্রিকভাবে আদেশটি প্রদান করে থাকেন।
বারবার প্রেসিডেন্ট কেন
গুরুদণ্ড মওকুফ করছেন?
কথায় বলে কেউ যদি একটি মিথ্যা কথা বলে তাহলে সেই একটি মিথ্যা ঢাকার জন্য তাকে আরো ১০টি মিথ্যা বলতে হয়। আওয়ামী প্রেসিডেন্টেরও হয়েছে সেই একই দশা। নাটোরের বড়াইবাড়ির মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২০ জন আসামির ফাঁসির আদেশ মওকুফ করে প্রেসিডেন্ট ফেঁসে গেছেন। এখন একটির পর একটি গুরুদণ্ড তাকে মওকুফ করতে হচ্ছে। গত বছর জুন মাসে জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের উপনেতা বেগম সাজেদা চৌধুরীর পুত্র লাবুকে কারাদণ্ড দেয় আদালত। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, জ্ঞাত আয়ের চেয়ে তার সম্পদ অনেক বেশি। এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। দণ্ড মওকুফের জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন জানানো হলে প্রেসিডেন্ট লাবুর কারাদণ্ড মওকুফ করেন। দাগী ও প্রমাণিত অপরাধীদের অপরাধ মওকুফের সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনাটি ঘটে গত সেপ্টেম্বর মাসে। তখন সাবেক উপমন্ত্রী নাটোরের রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ভাতিজা সাব্বির আহমদ গামা হত্যা মামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফ হয় প্রেসিডেন্সিয়াল আদেশে। অথচ বিষয়টি তখনও হাইকোর্টে বিচারাধীন ছিল। উচ্চ আদালতকে পাশ কাটিয়ে এক সাথে ২০ জন ফাঁসির আসামির ফাঁসির দণ্ডাদেশ মওকুফ করার বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রচণ্ড সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এর কিছুদিন পরেই নাটোরে প্রকাশ্য দিবালোকে প্রতিপরে একজন নেতাকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে ফাঁসির দণ্ড অনুকম্পাপ্রাপ্তরা জড়িত ছিল বলে অভিযোগ উত্থাপিত হয়।
আওয়ামী লীগের ইতিহাস
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ইতিহাস
আওয়ামী লীগের ইতিহাস রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ইতিহাস। আওয়ামী লীগের ইতিহাস শ্বেত সন্ত্রাসের ইতিহাস। আওয়ামী লীগের ইতিহাস প্রাইভেট বাহিনী পোষার ইতিহাস। আওয়ামী লীগের ইতিহাস রক্ত হিম করা ভয়াল সন্ত্রাসের ইতিহাস। নাটোরে ওরা সাবেক উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর আত্মীয় গামাকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছিল। এই খুনের অভিযোগে দেশের আইন আদালতে তাদের বিচার হয় এবং ২০ ব্যক্তির ফাঁসির আদেশ হয়। এই ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যখন তাদের আপীলের বিচার চলছিল সেই বিচারাধীন মামলাটিকে প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান ঐ ২০ জনেরই মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করেন। ফাঁসির রজ্জু থেকে মুক্তি পেয়ে ওরা আবার শুরু করে হত্যাকাণ্ড। গত বছর হরতালের দিন বিএনপি একটি মিছিল বের করেছিল। মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ছানা উল্লাহ বাবু। এই খুনীরা ১০০ সন্ত্রাসী নিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ঐ মিছিলে হামলা করে এবং শত শত মানুষের সামনে সদর রাস্তায় উপজেলা চেয়ারম্যানকে হত্যা করে। সেই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার তো দূরের কথা, কোনো সিরিয়াস তদন্তও অনুষ্ঠিত হয় নাই। লক্ষ্মীপুরে তাহের পুত্র বিপ্লবের দণ্ড মওকুফের কয়েকদিন পরেই ওরা নিহত এডভোকেট নূরুল ইসলামের স্মৃতিসৌধ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। নূরুল ইসলামকে হত্যা করে তার লাশ কেটে ১১ টুকরা করে মেঘনা বে ছুড়ে ফেলে দেয়ার অভিযোগে বিপ্লবের ফাঁসির আদেশ হয়। বিপ্লবের মুক্তির পর আতঙ্কে এখন সকলেই তটস্থ। কবে কার ওপর না জানি তাহের ও বিপ্লবের গজব নাজিল হয়।
গভীর উৎকণ্ঠায় দেশ
এই সরকার দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটা ভেবে অনেক দেশপ্রেমিক মানুষ উদ্বিগ্ন হচ্ছেন । এসব দণ্ডাদেশ মওকুফ করা ছাড়াও শেখ হাসিনার সরকার গত আড়াই বছরে ৭ হাজারেরও বেশি মামলা প্রত্যাহার করেছেন। রাজনৈতিক বিবেচেনায় এসব মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অথচ বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীর একটি মামলাও তুলে নেয়া হয়নি। এটি সরকারের চরম বৈষম্যমূলক আচরণ। রাজনৈতিক বিবেচনায় যে ৭ হাজার মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে তার মধ্যে হাজার হাজার ক্রিমিনাল কেস রয়েছে। এদের অনেকে হত্যা, খুন ও সন্ত্রাসী ঘটনার সাথে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। আশংকা করা হচ্ছে যে ভবিষ্যতে বিএনপি ও জামায়াত যখন রাজপথে জোরেশোরে নামবে তখন মামলা উঠে যাওয়া খালাসপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বিএনপি ও জামায়াত তথা বিরোধী দলের কর্মীদের সাইজ করবে। এভাবে তারা দেশকে সহিংসতার পথে নিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে বিরোধী দলও ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য হবে। তখন দেশের পরিস্থিতি যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটা ভেবে রাজনৈতিক পর্যবেক মহল টেনশনে অস্থির হয়ে আছেন।

No comments:

Post a Comment