Sunday, July 31, 2011

বৈঠক শেষে দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশাবাদ, সীমান্তের সব সমস্যার সুরাহা হবে অচিরেই

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের আগামী ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সফরের আগেই অচিহ্নিত সীমানা চিহ্নিতকরণ এবং ছিটমহল ও অপদখলীয় ভূমি বিনিময়সহ সীমান্তের সব সমস্যার সমাধান হবে। গতকাল শনিবার ঢাকায় দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন। মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকে ফলপ্রসূ করতে ভারতীয় মন্ত্রীদের ঢাকায় সিরিজ সফরের অংশ হিসেবে প্রায় ২৪ ঘণ্টার সফরে গত শুক্রবার রাতে পি চিদাম্বরম ঢাকায় আসেন। গত ১৪ বছরের মধ্যে ভারতের কোনো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এটিই প্রথম বাংলাদেশ সফর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গতকাল বৈঠক শেষে দুই দেশের যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।


বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) প্রধান নিজ নিজ দেশের পক্ষে স্মারকে সই করেন। নারী ও শিশুপাচার, মাদক চোরাচালানসহ আন্তসীমান্ত অপরাধ দমনে এ পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে উভয় দেশ আশা করছে।
প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পি চিদাম্বরম বলেন, 'আমরা অত্যন্ত গঠনমূলক আলোচনা করেছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রীর (মনমোহন) সফরের আগে সব ইস্যু নিষ্পত্তি হবে।' তিনি বলেন, ছিটমহলগুলোতে জনগণনা সবেমাত্র শেষ হয়েছে। ছিটমহলগুলোতে মোট ৫১ হাজার বাসিন্দা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৪ হাজার ভারতীয় ও ১৭ হাজার বাংলাদেশি।
ছিটমহলের বাসিন্দারা কোন দেশে থাকবেন, সে বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকবে কি না-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে চিদাম্বরম বলেন, ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ড. মনমোহন সিংয়ের বৈঠকেই ছিটমহলবাসীদের ভাগ্য ঠিক হবে।
অপদখলীয় ভূমি বিষয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ ইস্যুটি প্রায় নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। মাত্র দু-একটি পয়েন্ট নিয়ে এখনো কিছুটা মতভেদ আছে, যা নিয়ে আরো কাজ করতে হবে। অন্যদিকে সাড়ে ছয় কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমান্ত ইস্যুটি যৌথ সীমান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ সমাধান করবে।
বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহত হওয়াবিষয়ক এক প্রশ্নের উত্তরে পি চিদাম্বরম বলেন, সীমান্ত পাড়ি দেওয়া ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে যাতে কোনো অবস্থাতেই গুলি ছোড়া না হয় সেজন্য বিএসএফ জওয়ানদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি দাবি করেন, ওই নির্দেশনা দেওয়ার পর থেকে এ বছর সীমান্তে নিহতের সংখ্যা ৭-এ নেমে এসেছে। বিএসএফ জওয়ানরা হামলার শিকার হয়ে আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন। তখন সাংবাদিকরা সম্প্রতি বিএসএফের ছোড়া পাথরের আঘাতে এক বাংলাদেশি নিহত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরলে পি চিদাম্বরম দাবি করেন, বিএসএফ এর সঙ্গে জড়িত নয়। তিনি এ ধরনের হত্যার খবর খতিয়ে দেখার জন্য সাহারা খাতুনকে অনুরোধ জানান। সই হওয়া সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার মান জোরদার হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, 'জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত খুনিদের মধ্যে ক্যাপ্টেন মাজেদ ও রিসালদার মোসলেহউদ্দিন ভারতের কোথাও আত্মগোপন করে আছে কি না, তা খুঁজে দেখার জন্য আমরা অনুরোধ করেছি।' এ প্রসঙ্গে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, 'বলা হচ্ছে, তারা (দুই খুনি) ভারতে থাকতে পারে। এ ব্যাপারে ভারত বাংলাদেশের কাছে আরো তথ্য চেয়েছে। তথ্য পেলে ভারত দণ্ডপ্রাপ্তদের গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করতে কোনো চেষ্টা বাকি রাখবে না।'
বাংলাদেশে ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ড চলছে বলে বিভিন্ন সময় ভারতের অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পি চিদাম্বরম বলেন, 'আমি আড়াই বছর মন্ত্রী হিসেবে এ পদে আছি এবং একবারের জন্যও এ ধরনের অভিযোগ করিনি। বরং ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গ্রেপ্তারে সহযোগিতা করায় আমি প্রকাশ্যে বহুবার বাংলাদেশের প্রশংসা করেছি।' বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ মানুষ ভারতবিদ্বেষী এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই দ্বারা প্রভাবিত_ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের এমন বক্তব্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে চিদাম্বরম বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী এমন বক্তব্য দেননি'।
বাংলাদেশে ভারতের ভিসা কার্যক্রম প্রসঙ্গে পি চিদাম্বরম বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনায় বাংলাদেশের মানুষ অনলাইন ভিসা সুবিধা পাচ্ছে এবং গত এক বছরে পাঁচ লাখ লোককে ভিসা দেওয়া হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরে বিদ্যমান সম্পর্ক আরো জোরদার হবে। সীমান্তে হত্যার ব্যাপারে বৈঠকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে কি না_জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সীমান্তে যখনই কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, বাংলাদেশ তা নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকেও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর এ বিষয়ে আমার আর বলার কিছু নেই।' মাদক পাচারসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অনুরোধে ভারত তার সীমান্তবর্তী এলাকায় ফেনসিডিল কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে।
বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। অন্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক এ করিম, স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুস সোবহান সিকদার, ভূমিসচিব মোখলেছুর রহমান, পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের নেতৃত্বে ভারতীয় প্রতিনিধিদলে ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার রজিত মিত্র, সহকারী হাইকমিশনার সঞ্জয় ভট্টাচার্য, বিএসএফের মহাপরিচালক রমন শ্রীবাস্তব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (সীমান্ত ব্যবস্থাপনা) কে কে মিত্তাল, যুগ্ম-সচিব শম্ভু সিং প্রমুখ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ : পি চিদাম্বরম গতকাল বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানান। দুই দেশের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে সফর বিনিময় প্রক্রিয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, এর মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো জোরদার হবে। তিনি সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান পূণর্ব্যক্ত করে এ ক্ষেত্রে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে জানান।
সফরসূচির অংশ হিসেবে পি চিদাম্বরম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন এবং গতকালই তিনি বিশেষ বিমানে নয়াদিলি্ল ফিরে যান।

No comments:

Post a Comment