Monday, June 13, 2011

ঢাবি শিক্ষক রুমানার ওপর যেভাবে চালানো হয় নির্যাতন

ঢাবি শিক্ষক রুমানা মঞ্জুর কম্পিউটারে কাজ করছিলেন। এ সময় তার স্বামী সাঈদ হাসান রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দেন। রুমানা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাঈদ তার মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। সঙ্গে সঙ্গে রুমানা পড়ে যান। এরপর সাঈদ তার গলা চেপে ধরেন। তার দু’চোখ আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে নষ্ট করে দেন। তাদের সন্তান আনুষার সামনেই ঘটে এ ঘটনা। আনুষা এ সময় মাকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে কান্নাকাটি করেন।

রুমানা ও আনুষার চিৎকারে কাজের মেয়েসহ অন্যরা বাইরে থেকে দরজা খুলে তাকে রক্ষা করেন। ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান স্বজনরা। আর সেখানে বর্তমানে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মঞ্জুর। হাসপাতাল ও পারিবারিক সূত্র জানায়, রুমানার দু’টি চোখেই ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। অপরটিও নষ্টের পথে। মাথা ও সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন অন্তত চোখ রক্ষা করতে। প্রয়োজনে তাকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য বলা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে। শনিবার রুমানার পিতা মেজর (অব.) মঞ্জুর হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিনের কাছে তার মেয়ের ওপর বর্বরোচিত অত্যাচারের বর্ণনা করেছেন। রুমানা এর আগে ২রা জুনও নির্যাতনের শিকার হন। সে সময় রুমানার পিতা মেজর (অব.) মঞ্জুর হোসেন মেয়ের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি নির্যাতনের কথা জানান। বিষয়টি জানতে পেরে ঘরজামাই হাসান সাঈদকে তার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন এবং তার মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখার কথা বলেন। এরপর হাসান সাঈদ তার ভাইয়ের বাসা ১০, পরীবাগের ইস্টার্ন কটেজের (ফ্ল্যাট নম্বর ৬০৩) বাসায় চলে যান। সেখানে সাঈদ ঘুমের বড়ি খেয়ে অচেতন হয়ে পড়লে তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সুস্থ হয়ে তিনি ফের শ্বশুরের বাসায় যান। সেদিন ছিল ৫ই জুন। এরপর ঘটে এক নৃশংস নির্যাতনের ঘটনা। ল্যাবএইড হাসপাতালে গিয়ে কথা হয় রুমানার পিতা মেজর (অব.) মঞ্জুর হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, তার মেয়ের অবস্থা আশঙ্কামুক্ত নয়। ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তাকে সুস্থ করতে। তার সারা শরীরের আঘাতের চিহ্ন। তিনি বলেন, এখনই বিস্তারিত বলতে চাইছি না। পরে বিস্তারিত জানানো হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, রুমানা ২০১০ সালের ১লা আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরের শিক্ষা ছুটি নেন। তিনি কানাডার ইউনিভার্সিটি অব বৃটিশ কলম্বিয়ায় মাস্টার্স করার জন্য এ ছুটি নেন। চলতি বছরের ১লা আগস্ট তার শিক্ষা ছুটি শেষ হওয়ার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেয়া ছুটির আবেদনে লেখা আছে একটি সেমিনারে অংশ নিতে তার আগামীকাল তার ভারতে যাওয়ার কথা ছিল। তার স্বামী সাঈদ হোসেন রুমানার বিদেশ যাওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। রুমানা দেশে আসার পর থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এ নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া হতো। এক বছর ছুটি শেষে তার ফের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে যোগদানের কথা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ বলেন, কি কারণে রুমানার ওপর এ ধরনের নির্যাতন হলো তার সঠিক কারণ জানা যায়নি। তিনি বলেন, রুমানা শিক্ষক হিসেবে অত্যন্ত ভদ্র। তিনি চাপা স্বভাবের মেয়ে। অধ্যাপক ফরিদ বলেন, তার পরিবারের পক্ষ থেকে যে কোন ধরনের সাহায্য চাওয়া হলে তা করা হবে। আমি বিষয়টি তার পিতাকে বলেছি। তার পিতা মেয়ের ওপর নির্যাতনের ঘটনা আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন। রুমানার স্বামী সাঈদ হোসেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পড়ালেখা করেছেন। তিনি বর্তমানে বেকার। থাকেন শ্বশুর বাড়িতেই। রুমানা ১২ই মে কানাডা থেকে দেশে আসে। একটি অসমর্থিত সূত্র জানায়, স্বামী বেকার আর স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ নিয়ে তাদের পারিবারিক কলহ লেগেই থাকত। এছাড়া রুমানা কানাডা যাওয়ার পর থেকে সাঈদ হোসেন তাকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। এ সন্দেহ থেকেও বর্বরোচিত ঘটনা ঘটতে পারে এমনটাও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। রুমানার গ্রামের বাড়ি মাগুরা জেলার শালিখা থানার গজদুর্বা গ্রামে। তিনি ঢাকাতেই পড়ালেখা করেছেন।
ধানমন্ডি ১০ নম্বর রোডের ৩/১ নম্বর বাসার (টাইহাট ভবন) ৪ তলার সি/১ নম্বর ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছেন রুমানার পিতা মঞ্জুর হোসেন। রুমানা তার স্বামী হাসান সাঈদকে নিয়ে এ বাসাতেই থাকতেন। একই বাসায় থাকতেন রুমানার বাবা-মা। ঘটনার দিন রুমানার মা ছিলেন গ্রামের বাড়িতে। পিতা ছিলেন বাসার বাইরে। বাসায় ছিলেন রুমানা, ৫ বছর বয়সী তাদের একমাত্র কন্যা শিশু আনুষা এবং ৩ গৃহপরিচারিকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসান সাঈদ ছিলেন অটোরিকশা ‘মিশুক’ ব্যবসায়ী। ৪-৫টি গাড়ি ছিল তার। বছর দেড়েক আগে সব ক’টি গাড়ি বিক্রি করে টাকা বিনিয়োগ করেন শেয়ার ব্যবসায়। শেয়ার ব্যবসায় লোকসানে পড়ে তিনি বেশ কিছুদিন ধরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন, তার চোখেও রয়েছে সমস্যা। চশমা ছাড়া তিনি কিছু দেখেন না।
মঞ্জুর হোসেনের এক ছেলে এবং এক মেয়ে। রুমানাই বড়। তার ভাই দেশের বাইরে থাকেন। তাই হাসান সাঈদকে ঘরজামাই রাখেন তিনি। নির্যাতন শুরুর আগে রুমের ভেতর থেকে লক করে দেয়া হয়েছিল। ছোট্ট ফুটফুটে শিশুর সামনেই নির্মম নির্যাতন চালানো হয় রুমানার ওপর। শিশুটি তার মাকে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। অনেক অনুনয়, বিনয়, কান্নাকাটি, চিৎকার চেঁচামেচি করেছে আনুষা। কোন কিছুতেই পিতার হৃদয় গলাতে পারেনি ওই শিশু। রুমানার নাকের বাম পাশের অংশ কামড়িয়ে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। নাখ, মুখ, কানসহ শরীরের অনেক জায়গায় মাংস ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। রুমানাকে বাসার নিচে নামানোর পর যারা তাকে দেখেছে তাদের একজন বলেন, রুমানা ম্যাডামের অবস্থা দেখে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছি। তার চোখ, মুখ, গাল, নাখ এবং কপাল বেয়ে অঝোরে রক্ত ঝরছিল।
গতকাল টাইহাট ভবনে গেলে রুমানার পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ-ই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। সূত্র জানায়, রুমানা এবং তার মেয়ের আর্তচিৎকারে কাজের মহিলারা বাইরে থেকে রুমটি খোলে। রুম খোলার সঙ্গে সঙ্গেই হাসান সাঈদ পালানোর চেষ্টা করে। কাজের মহিলারা তাকে জাপটে ধরে। তিনি ঝাঁকি দিয়ে কাজের মহিলাদের সরিয়ে দিয়ে বলেন, আমি যাচ্ছি। আপনারা রুমানাকে দেখেন। বিকাল ৫টার দিকে বাসা থেকে চলে গিয়ে সন্ধ্যার দিকে হাসান সাইদ আবার বাসায় আসেন। মঞ্জুর হোসেনের নিষেধাজ্ঞার কারণে তাকে বাসায় প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। পরে তিনি বাসার ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। পরে তার ভাই এসে তাকে অনেক বুঝিয়ে ছাদ থেকে নামান। এরপর থেকে সাঈদ পলাতক। তবে তিনি বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য মঞ্জুর হোসেনকে ফোন করাচ্ছেন বলে সূত্র জানায়। মঞ্জুর হোসেন বলেছেন, রুমানার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। আমার মানসিক অবস্থাও খুব খারাপ। দোয়া করুন যাতে রুমানা সুস্থ হয়। রুমানা সুস্থ হলে অনেক কথা আপনাদের বলা হবে।
রুমানা মঞ্জুর ১৯৯৩ সালে রাজধানীর আজিমপুরের অগ্রণী স্কুল থেকে স্টার মার্ক নিয়ে এসএসসি ও ১৯৯৩ সালে ভিকারুন নূন নিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে স্টার মার্ক নিয়ে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। ২০০২ সালে বিভাগ থেকে সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হয়ে অনার্স ও ২০০৪ সালে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ২০০৪ সালের ৩রা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ২০০৯ সালে ২৫শে অক্টোবর সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগদানপত্রে তিনি বিবাহিত উল্লেখ করেছেন। স্বামীর নাম লিখেছেন মোঃ হাসান সাঈদ। তাদের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। রুমানার আহত হওয়ার খবর শুনে শনিবার রাতেই ল্যাবএইড হাসপাতালে ছুটে যান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। তিনি রুমানার পিতার সঙ্গে কথা বলে একটি অভিযোগ মানবাধিকার কমিশনে দেয়ার অনুরোধ করেন। অধ্যাপক মিজানুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, এটি অত্যন্ত বর্বরোচিত ঘটনা। আমাদের সমাজে এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকও আজ নিরাপদ নন। আমি তার ওপর নির্যাতনের ঘটনা শুনে বিস্মিত হয়েছি। এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হওয়া উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে। ভিসি বলেন, আমরা কোন জগতে বাস করছি একটি ঘটনাই তার প্রমাণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের ওপর যে ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে তা না দেখে বিশ্বাস করা যাবে না। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। এদিকে রুমানা মঞ্জুরের পিতা মেজর (অব.) মঞ্জুর হোসেন বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা করেন। মামলা নম্বর ৫। মামলাটির তদন্ত করছেন এসআই মকবুল হোসেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মকবুল হোসেন বলেন, ঘটনার পর থেকেই সাঈদ পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র মেহেদী হাসান বলেন, রুমানা ম্যাডাম অত্যন্ত ভদ্র । তিনি ছাত্রদের প্রচণ্ড ভালবাসেন। আমরা তার সুস্থতা কামনা করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান বলেন, আমরা বিষয়টি জানতে পেরেছি। তার পিতা একটি মামলা করেছেন। আমাদের পক্ষ থেকে সহায়তা চাওয়া হলে সব ধরনের সহায়তা করা হবে।
টাইহাট ভবন পরিচালনা পরিষদ সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান খান জানান, ৫ই জুন বিকালে কান্নাকাটি এবং চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমি রোমানার বাসায় যাই। দেখি, কাজের বুয়ারা রুমানার রক্তাক্ত শরীর জড়িয়ে ধরে আছে। সঙ্গে সঙ্গেই রুমানার বাবাকে ফোন করি। কালবিলম্ব না করে আমার গাড়ি দিয়েই ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি করি। তার বাবা আমার পুরনো বন্ধু। আমি মিডিয়ায় বিষয়টি জানাতে চেয়েছিলাম। তার বাবা আমাকে জানাতে দেয়নি। এ রকম লোমহর্ষক ঘটনা আমি নিজ দায়িত্বে মিডিয়াকে জানাবো কি জানাবো না তা নিয়ে ছিলাম দোদুল্যমানতায়। এ দোদুল্যমানতায় আমি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ি। তিনি জানান, এত নম্র-ভদ্র এবং ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে আমি খুব একটা দেখি না। ৬-৭ বছর ধরে রুমানা এ বাসায় থাকেন। তার জীবনে এ রকম দুর্বিষহ যন্ত্রণা নেমে আসবে- কল্পনা করতে পারিনি। তিনি জানান, অনেকদিন ধরেই আমার একটি প্রশ্ন ছিল, বুয়েট থেকে পাস করা রুমানার স্বামী সাঈদ কেন ঘর জামাই থাকেন? কেন তিনি কোন চাকরি করেন না?  শাহজাহান খান জানান, এক সময় তার কয়েকটি মিশুক গাড়ি থাকলেও এখন আর নেই।

No comments:

Post a Comment