Monday, June 13, 2011

স্থানীয় উদ্যোগও হতে পারে আলোকবর্তিকা by আবু সাঈদ খান

জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন ক্ষমতাবাজির নীতিহীন খেলায় মত্ত, তখন জনগণই ভরসাস্থল। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকা আশা করি। হয়তো প্রত্যুত্তরে তাদের কাছ থেকে শুনতে হবে যে, ইচ্ছা থাকলেও সীমাবদ্ধতা আছে, লোকবলের অভাব আছে। কথাটি সত্য। তা সত্ত্বেও মানবাধিকার সংগঠন, কমিউনিটি নেতা ও স্থানীয় সচেতন মানুষের সহায়তায় প্রার্থীদের জনতার মুখোমুখি করার কার্যক্রম প্রসারের বিষয়টি কঠিন কিছু নয়।

কেবল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেই নয়_ পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, উপজেলা, সর্বোপরি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটি মডেল হতে পারে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অসহিষুষ্ণতা এখন চরমে। বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধী দল_ একে অপরকে ঘায়েল করতে মরিয়া। কেবল কাদা ছোড়াছুড়ি করেই ক্ষান্ত নয়, পরিস্থিতি দেখে মনে হয় সরকার ও বিরোধী দল শক্তি পরীক্ষায় নেমেছে। দেশের বুদ্ধিজীবী, সচেতন নাগরিক সমাজের প্রবল সমালোচনার মুখেও নেতা-নেত্রীরা সমঝোতার নীতি গ্রহণ করছেন না, আলোচনার টেবিলে বসছেন না। অথচ আলোচনার টেবিল ছাড়া সমাধানের কোনো পথ নেই। দেশের রাজনীতির যখন এমনই হতাশাব্যঞ্জক হাল, তখন আশার আলোকচ্ছটা অনুভব করলাম রাজধানী থেকে দূরে, ময়মনসিংহ জেলার শম্ভুগঞ্জের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে।
৯ জুন, সকাল ১১টা। শম্ভুগঞ্জ হাইস্কুলের মাঠে মুক্তমঞ্চ; হাজির হয়েছেন চরনিলক্ষিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সাত চেয়ারম্যান প্রার্থী। উপস্থিত কয়েক হাজার নর-নারী। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রতি 'জনতার প্রশ্ন' শিরোনামে আয়োজিত অনুষ্ঠানের শুরুতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতির ওপর একটি নাটক প্রদর্শিত হলো। এ নাটকে কেবল জনপ্রতিনিধিদের অনিয়ম-দুর্নীতির কথাই বলা হলো না, ভোটারদের দায়িত্বহীনতা ও অর্থের বিনিময়ে ভোট দেওয়ার মানসিকতার জন্য কঠোর ভর্ৎসনা করা হলো। তারপর শুরু হলো জনগণের মধ্য থেকে উত্থাপিত লিখিত প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পালা।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আবদুল হক মণ্ডল, নূর মোহাম্মদ মীর, ফারুকুল ইসলাম রতন, ইঞ্জিনিয়ার মজিবুর রহমান, মাহবুবুর রহমান ফকির, রফিকুল ইসলাম ও মানিক মিয়া_ প্রত্যেকেই একে একে জনতার কাছ থেকে আসা প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলেন। যখন এক প্রার্থী জবাব দিচ্ছিলেন, তখন অন্য প্রার্থীরাও মাথা নেড়ে তার কথার সঙ্গে একাত্ম হচ্ছিলেন। ভিন্ন মত থাকলে সম্পূরক উত্তরও দেওয়ার সুযোগ ছিল। কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তর সবাই যার যার মতো করে দিলেন।
এরপর সমবেত জনতার সরাসরি প্রশ্ন। এ পর্যায়ে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যে কিছুটা বাকবিতণ্ডাও হলো। তবে অনুষ্ঠানের সমন্বয়ক বাংলাদেশ মানবাধিকার নাট্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোতাহার আখন্দ ভালোভাবেই পরিস্থিতি সামাল দিলেন। উপস্থিত নর-নারীর স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। সমন্বয়কের অনুরোধে তারা হাততালি দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। মনে হচ্ছিল, তারা ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্য, প্রার্থীদের বাজিয়ে নিচ্ছেন। মতামত দেবেন ব্যালটের মাধ্যমে।
প্রশ্নগুলো ছিল এলাকার উন্নয়ন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মানবাধিকার_ পরিবেশ এবং পরিষদের কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে। বেশিরভাগ উত্তরই ছিল অভিন্ন। তবে ক্ষেত্রবিশেষ মতদ্বৈধতা ছিল। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, সন্ত্রাস-মাদক-জুয়া-ফতোয়া-যৌতুক-বাল্যবিবাহ-নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করা, রাস্তাঘাট-পয়ঃনিষ্কাশন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, শিক্ষার প্রসার, পাঠাগার নির্মাণ ইত্যাদি নিয়ে আশার কথা সবাই বলেছেন। বেআইনিভাবে দখলকৃত খাসজমি উদ্ধার করার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছেন। শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা এবং মর্যাদা রক্ষায়ও প্রার্থীরা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন। বলা হলো, একাত্তরের চার শহীদের নামে চারটি রাস্তার নামকরণ করা হবে। সংস্কৃতিকর্মীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তমঞ্চ তৈরি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার ওয়াদাও করা হলো।
সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার এখতিয়ার তাদের ছিল না। স্থানীয় কার্পেট ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের মানবেতর অবস্থার বর্ণনা দিয়ে জানতে চাওয়া হলো, তাদের বেতন বৃদ্ধির ব্যাপারে কী করা হবে। প্রার্থীরা এক বাক্যে বললেন, বিষয়টি নিয়ে তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে অভিন্ন মত পোষণ করলেন প্রার্থীরা। সব পরিকল্পনা জনগণের মতামত নিয়ে করা হবে, সরকারি বরাদ্দের অঙ্ক যথাযথভাবে জানানো হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো। গ্রাম বা ওয়ার্ড সভা করে তথ্য জানানো ও জনগণের মতামত গ্রহণ করার ব্যবস্থা হবে। দুস্থ, প্রতিবন্ধী, বিধবা ও বয়স্ক ভাতার কার্ড দেওয়া হবে যোগ্য প্রাপকদের। বিজয়ী হলে কোনো প্রার্থীই দলীয়করণ-আত্মীয়করণ করবেন না। কারও কাছ থেকেও অর্থ নেবেন না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হচ্ছে_ যিনি নির্বাচিত হবেন অন্যরা তাকে স্বাগত জানাবেন এবং সহযোগিতা করবেন।
এসব বক্তব্য রেকর্ড করার এক পর্যায়ে উদ্যোক্তারা স্মরণ করিয়ে দেন, আপনাদের সব প্রতিশ্রুতির কথা আমাদের কাছে রেকর্ডবন্দি হয়ে থাকল। অর্থাৎ কথার ব্যত্যয় হলে তাদের নতুন করে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। জনগণ প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিয়ে দাবি তুলতে বা আন্দোলন করতে পারবে।
আমাকে অভিভূত করেছে যে, আয়োজকরা সবাই অনূর্ধ্ব ২৫ বছরের তরুণ; বাংলাদেশ মানবাধিকার নাট্য পরিষদ, শম্ভুগঞ্জ শাখার সদস্য। মনে পড়ছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-উত্তর পরিস্থিতির কথা। তখন সর্বক্ষেত্রেই তরুণদের নেতৃত্ব ছিল সমাদৃত। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান সেই পটভূমি রচনা করেছিল। আজ কোনো ঊনসত্তর ঘটেনি সত্য, তবে আজকের তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পুনর্পাঠ তরুণ সমাজকে উদ্বেলিত করেছে, নতুন এক জাগরণ এনেছে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, আমরা সংবাদপত্রে যে তরুণদের লেজুড়বৃত্তি, লাঠালাঠি বা বন্দুক লড়াই করতে দেখি, তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য। এর বাইরে ব্যাপক তরুণ সমাজ স্বাধীন চিন্তায় বেড়ে উঠছে। তারা পথনির্দেশ পেলে অসাধ্য সাধন করতে পারে, শক্ত হাতে নেতৃত্বের হাল ধরতে পারে।
এই তরুণরা আমাদের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। তাদের সম্পৃক্ত করেই আমাদের জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে। আর যত দ্রুত তরুণ নেতৃত্বকে পথ করে দেওয়া হবে, ততই দেশের জন্য তা মঙ্গলজনক।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শম্ভুগঞ্জে যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো তা কি কেবল ওই এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকবে, না ছড়িয়ে দিতে হবে? ইতিমধ্যে এমন আরও উদ্যোগের কথা আমরা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছি। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সূত্রাপুর ইউনিয়নের চার প্রার্থী একযোগে আচরণবিধি ও ফলাফল মেনে নেওয়ার শপথ নিয়েছেন। জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার মেরুরচর ইউনিয়নে সুজনের (সুশাসনের জন্য নাগরিক) উদ্যোগে প্রার্থীরা এক অনুষ্ঠানে জনতার মুখোমুখি হয়েছেন।
এসব অনুষ্ঠান গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় আলোকবর্তিকা। এটি যেমনি নির্বাচনের আচরণবিধি অনুসরণে সহায়তা দেবে, তেমনি ইউনিয়ন পরিষদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। সঙ্গত কারণে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ হিসেবেই এমন উদ্যোগকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এটি সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে তা সৃষ্টি করবে নতুন গণজাগরণ। বলা আবশ্যক, রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন দু'ভাবেই হওয়া সম্ভব। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ইতিবাচক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের ধারা সূচনা করতে পারে, অপরদিকে তৃণমূলের জাগরণও রাজনীতিতে নতুন উপাদান যুক্ত করতে পারে, বদলে দিতে পারে রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন ক্ষমতাবাজির নীতিহীন খেলায় মত্ত, তখন জনগণই ভরসাস্থল। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকা আশা করি। হয়তো প্রত্যুত্তরে তাদের কাছ থেকে শুনতে হবে যে, ইচ্ছা থাকলেও সীমাবদ্ধতা আছে, লোকবলের অভাব আছে। কথাটি সত্য। তা সত্ত্বেও মানবাধিকার সংগঠন, কমিউনিটি নেতা ও স্থানীয় সচেতন মানুষের সহায়তায় প্রার্থীদের জনতার মুখোমুখি করার কার্যক্রম প্রসারের বিষয়টি কঠিন কিছু নয়।
কেবল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেই নয়_ পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, উপজেলা, সর্বোপরি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটি মডেল হতে পারে। সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমকেও এমন বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। শম্ভুগঞ্জের ওই অনুষ্ঠান থেকে আমার বারবার মনে হচ্ছিল, কোনো টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি প্রদর্শিত হলে তা হতো বড় কাজ। এ দৃষ্টান্ত দেখে অন্য এলাকার মানুষও উদ্বুদ্ধ হতো।
স্বাধীনতার ৪০ বছরে আমরা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়েছি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়েছিও। তবে জাতির মনোভূমি যে সচেতনতার বীজ ধারণ করে আছে তা অনন্য। সেই চেতনার বীজ অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছে, যা সব আগাছা ছাপিয়ে ফসলের নতুন বান ডেকে আনতে পারে।

No comments:

Post a Comment