Monday, June 13, 2011

নৈরাজ্যের অচলায়তন by রাশেদ মেহেদী

রাজধানীতে বাস সংকটে পরিবহন মালিকদের, নেতাদের লাভ-ক্ষতি নেই। ক্ষতি হবে সরকারের এবং রাজধানীর এমপিদের। সামনের নির্বাচনে এই বাস সংকটের জন্যই হয়তো তাদের অনেক বড় মূল্য দিতে হবে। গণপরিবহন নিয়ে দুর্ভোগ সরকারের নীরব রক্তক্ষরণ। জরুরি ভিত্তিতে এই রক্তক্ষরণ বন্ধ হতে পারে মধ্যবর্তী দূরত্বের শত শত যাত্রীর জন্য বিআরটিসির সার্কুলার বাস চালু হলে।

রাজধানীর গণপরিবহনে বর্তমানে চলা চরম নৈরাজ্য বন্ধে এই মুহূর্তে এর বিকল্প আছে বলে মনে হয় না ভালো বাস আমদানির কথা উঠলেই এখনকার প্রভাবশালী পরিবহন নেতারা হায় হায় করে ওঠেন। কী বলেন! উন্নত, ভালো বাস নিয়ে আসতে গেলে বাসপ্রতি দেড়-দুই কোটি টাকা দাম পড়বে। সেক্ষেত্রে মতিঝিল-উত্তরার ভাড়া নিতে হবে দেড়শ' টাকা। এটা কি সম্ভব? পরিবহন নেতাদের এই যুক্তি আরও একটি বড় প্রতারণা। কারণ বড় বড় পরিবহন নেতারা ঢাকার রাস্তায় উন্নত বাস সার্ভিস চান না। এ কারণে কম দামের উন্নত বাস সার্ভিস হাতের কাছে থাকলেও তাদের চোখে পড়ে না। গণপরিবহনের জন্য এশিয়ার অধিকাংশ দেশসহ নিউজিল্যান্ড, ইউরোপের ফ্রান্স, চেক, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আমদানি করা হয় জাপানের উন্নতমানের রিকন্ডিশন্ড গাড়ি। এই গাড়িগুলো জাপানের রাস্তায় দশ বছর চলার পরও কমপক্ষে ত্রিশ বছর চলার নিশ্চয়তা থাকে। আরামদায়ক, উন্নতমানের এই গাড়িগুলো এখনও সর্বোচ্চ দাম গড়ে ২৫-৩০ লাখ টাকায় পাওয়া সম্ভব। যদি ২৫ লাখ টাকা দিয়ে নিম্নমানের নতুন বাস কিনে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২৫ টাকা ভাড়া হয়, তাহলে জাপানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত উন্নতমানের বাস ২৫ লাখ টাকায় আমদানি করলে সেই ২৫ টাকা ভাড়াতেই পোষাবে। চীনের নিম্নমানের নতুন বাসের যেখানে একশ' বছর সুস্থভাবে চলার নিশ্চয়তা নেই, সেখানে জাপানি রিকন্ডিশন্ড শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস ৩০ বছর পর্যন্ত চলার নিশ্চয়তা আছে। তাহলে এসব বাস গণপরিবহনের জন্য আমদানি করতে বাধা কোথায়? এক সময় কিন্তু ঢাকার রাস্তায় রিকন্ডিশন্ড উন্নতমানের গাড়ি চলত। নিরাপদ এবং রোড স্টার সার্ভিসের কথা অনেকেরই মনে আছে। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় নেমেছিল প্রিমিয়াম বাস, ২০০০ সালে নিরাপদ এবং ২০০২ সালে রোড স্টার। এর পাশাপাশি বিআরটিসির ভলভো দোতলা বাস। মানুষ এসব বাসে অনেক নিরাপদে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারত। এসব উন্নত বাস চলার সময় মূল সমস্যা দেখা দেয় তথাকথিত প্রভাবশালী শ্রমিক নেতাদের। নামে শ্রমিক নেতা হলেও তারা রীতিমতো বড় বড় মালিক। পুরনো গাড়ি দফায় দফায় ৮-১০ লাখ টাকার মধ্যে হাত বদল করে ভালোই চালাচ্ছেন তারা। এই নেতাদের মূল ব্যবসা অবশ্য চাঁদাবাজি। উন্নত বাসের মালিকরা চাঁদা দিতে চান না, আবার উন্নত বাস চলার কারণে লোকাল বাস, সিটিং বাস এবং অন্যান্য কাউন্টার সার্ভিসের বাসে যাত্রী পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করতে হয়। ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ানো সহজ হয় না। এই নেতাদের ইশারাতেই বিআরটিএ নিরাপদ পরিবহন ও প্রিমিয়াম সার্ভিসের রুট পারমিট নবায়ন করেনি।
রাজধানীতে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য শুরু হয় কিন্তু এ বছরের জানুয়ারি মাসে। এ সময় গুলিস্তান-গাজীপুর রুটের মুড়ির টিন বলাকাসহ উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর রুটের সব ঝরঝরা লোকাল বাস সিটিং সার্ভিস হয়ে যায়। দশ টাকার নিচে ভাড়া নেওয়া হয় না তখন থেকেই। মুড়ির টিনের মতো এসব বাসে ত্রিশ আসনের জায়গায় বিয়ালি্লশ আসন বসিয়ে গরু-ছাগলের মতো যাত্রীদের বসানো হয়। তখন থেকেই রাস্তায় বাস সংকটেরও সৃষ্টি হয়। পত্রপত্রিকায় ছোটখাটো সংবাদ হয়েছে। বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে কেউ দেখেনি। সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে কর্তা-ব্যক্তিরা সেটা কোনোমতেই বুঝতে চাচ্ছেন না। গণহারে ডাইরেক্ট আর সিটিং হওয়ার কারণে বিপাকে পড়ছেন রাজধানীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বাস করা মানুষ। যে যাত্রী ফার্মগেট থেকে শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া কিংবা মোহাম্মদপুর যাবেন কিংবা মহাখালী থেকে এমইএস, বিশ্বরোড, খিলক্ষেত কিংবা উত্তরা যাবেন, তারাই বিপদে পড়ছেন। তাদের জন্য এখন কোনো বাস নেই। মগবাজার থেকে মহাখালী যাওয়ার বাস কিংবা অন্য কোনো যানবাহন নেই। এসব জায়গার যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর অসংখ্য গাড়িতে উঠতে গিয়ে তথাকথিত সিটিং সার্ভিসের কন্ডাক্টর-হেলপারের গলাধাক্কা খান। সরকারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে মন্ত্রীদের গালাগাল করেন। শেষ পর্যন্ত ৭ টাকার ভাড়া ১৫-২০ টাকা দিয়ে যেতে বাধ্য হন। কখনও কখনও মহাখালী থেকে বিশ্বরোড যেতে হচ্ছে ৩০ টাকাতেও। অথচ বাস সেই মুড়ির টিন। এই মধ্যবর্তী যাত্রীদের জন্য বিআরটিসি কি পারে না সার্কুলার বাস চালু করতে? কিছু বাস তো শাহবাগ থেকে ফার্মগেট হয়ে মিরপুর-১০ পর্যন্ত চলতেই পারে। কিংবা কিছু বাস তো মগবাজার থেকে মহাখালী হয়ে উত্তরা পর্যন্ত চলতেই পারে। এসব বাসে ৫ টাকা এবং ১০ টাকার দু'ধরনের টিকিট থাকবে। যেমন শাহবাগ থেকে ফার্মগেট ৫ টাকা, শাহবাগ থেকে মিরপুর-১০ পর্যন্ত ১০ টাকা। মগবাজার থেকে বনানী ৫ টাকা, উত্তরা পর্যন্ত ১০ টাকা_ এই ভাড়াতেই কিন্তু দিব্যি সার্কুলার বাস চলতে পারে অফিস সময় এবং বিকেলে অফিস ছুটির পর। না পোষালে আরও ৫ টাকা ভাড়া বেশি নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মানুষকে অফিসে যাওয়ার সময় এবং ঘরে ফেরার সময় বাস পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে। অথচ বিআরটিসির বাসও বেসরকারি পরিবহন মালিকদের মতো করেই চালানো হচ্ছে। যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে যদি বিআরটিসির ভূমিকা না থাকে তাহলে সরকারি মালিকানাধীন এই পরিবহন সার্ভিসের গুরুত্ব কোথায়? ২০০৪ সালে কিন্তু ঢাকার বিআরটিসির বেশ কিছু এ ধরনের সার্কুলার বাস চালু হয়েছিল। দুই-তিন মাস চলার পর সেই বেসরকারি পরিবহন মালিকদের চাপেই এসব বাস বন্ধ করা হয়। কারণ তাদের কম দূরত্বে বেশি ভাড়া নেওয়ার কৌশল মার খায়। রাজধানীতে বাস সংকটে পরিবহন মালিকদের, নেতাদের লাভ-ক্ষতি নেই। ক্ষতি হবে সরকারের এবং রাজধানীর এমপিদের। সামনের নির্বাচনে এই বাস সংকটের জন্যই হয়তো তাদের অনেক বড় মূল্য দিতে হবে। গণপরিবহন নিয়ে দুর্ভোগ সরকারের নীরব রক্তক্ষরণ। জরুরি ভিত্তিতে এই রক্তক্ষরণ বন্ধ হতে পারে মধ্যবর্তী দূরত্বের শত শত যাত্রীর জন্য বিআরটিসির সার্কুলার বাস চালু হলে। রাজধানীর গণপরিবহনে বর্তমানে চলা চরম নৈরাজ্য বন্ধে এই মুহূর্তে এর বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।
ঢাকার বাস সার্ভিসকে উন্নত করার জন্য বিআরটিসিকে কাজে লাগাতে পারে সরকার। ঢাকার প্রধান দশ-বারোটি রুটের পুরো দায়িত্ব বিআরটিসিকে দিলে কেমন হয়? এক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পরিবহন নেতাদেরও বিআরটিসির পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বিআরটিসি দশ-বারোটি রুটে তিন ধরনের বাস সার্ভিস রাখবে। একটি হবে ডবল ডেকার লোকাল সার্ভিস স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য, একটি হবে মধ্যআয়ের মানুষের জন্য নন-এসি কাউন্টার সার্ভিস এবং আর একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সার্ভিস। নির্দিষ্ট মডেলের বাস নির্দিষ্ট রুটে চলবে। বেসরকারি মালিকরা বিআরটিসি অনুমোদিত মডেলের বাস কিনে বিআরটিসির মাধ্যমে চালাতে পারবেন। বিআরটিসি তাদের লাভ বুঝে দেবে। বেসরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের পরিচালনায় কোনো বাস সার্ভিস প্রধান দশ-বারোটি রুটে চলবে না। বিআরটিসির চুরি বন্ধে একটি শক্তিশালী মনিটরিং টিম থাকবে, প্রয়োজনে গোপন টিম রাখা হোক। এর ফলে সরকার অনেক ঝামেলা থেকে বেঁচে যাবে। একই মডেলের বাস একটি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে চলার কারণে যানজট কমবে। পরিবহনে শ্রমিক সংগঠন, মালিক সংগঠন এবং পুলিশ, বিআরটিএর চাঁদাবাজি বন্ধ হবে। যখন-তখন পরিবহন মালিকরা ভাড়া নৈরাজ্য সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারবে না। একই কর্তৃপক্ষের বাস হওয়ার কারণে বেপরোয়া বাস চালানো, রাস্তার মাঝখানে যাত্রী ওঠানামা বন্ধ হবে, ফলে দূর্ঘটনাও কমবে। সবচেয়ে বড় কথা, রাজধানীর সাধারণ মানুষ কম খরচে উন্নত বাসসেবা পাবে। সিএনজির দাম বাড়ানোর পর বাস ভাড়া নিয়ে বেসরকারি মালিকরা যে নৈরাজ্য এবং ভাড়ার নামে গণডাকাতির নজির স্থাপন করেছেন, তাতে আজ না হলেও অদূর ভবিষ্যতে প্রধান দশ-বারোটি রুটে সরকারের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিকল্প থাকবে না।

No comments:

Post a Comment