Saturday, September 24, 2011

আ. লীগ-বিএনপির নয়, দ্বন্দ্ব শুধু দুই নেত্রীর

ওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বন্দ্ব শুধু ব্যক্তির মধ্যে। নীতি কিংবা কৌশলগত কোনো পার্থক্য নেই। দুই দলের নীতিগত অবস্থান প্রায় একই রকম। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষণা করা দুই দলের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রায় সব বিষয়েই সাদৃশ্য ছিল।
২০০৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে পাঠানো এক তারবার্তায় এ তথ্য জানিয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি। গত ৩০ আগস্ট বিকল্প ধারার গণমাধ্যম উইকিলিকসের ফাঁস করা অনেক নথির সঙ্গে এ তারবার্তাটিও রয়েছে।
বার্তায় বলা হয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে দারিদ্র্য, দুর্নীতি, প্রশাসনের অচলাবস্থা ও জ্বালানি সমস্যার মতো কঠিন বিষয়গুলো রয়েছে। ইতিমধ্যেই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছে। তবে যারাই নির্বাচনে ক্ষমতায় যাক না কেন, তারা ক্ষমতায় গিয়ে ইশতেহারে উলি্লখিত বিষয়গুলো ঠিক ঠিকভাবে পালন করবে কি না, তা নিয়ে এখানকার শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আওয়ামী লীগের ইশতেহার তৈরি, ঘোষণা ও বিতরণের প্রক্রিয়া বিএনপির তুলনায় ভালো হয়েছে।
বার্তায় মরিয়ার্টি বলেন, গত ১২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে। দলের প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'দিনবদলের সনদ' স্লোগানে এ ইশতেহার ঘোষণা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নির্বাচনী স্লোগান 'চেঞ্জ'-এর সঙ্গে এ স্লোগানটির অনেকটা মিল রয়েছে। ইশতেহারে পাঁচটি বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো ১. দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ ও বিশ্বমন্দা মোকাবিলায় সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, ২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা, ৩. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, ৪. দারিদ্র্য ঘোচাও, বৈষ্যম রুখো এবং ৫. সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।
এখানে শেখ হাসিনার অঙ্গীকার, তিনি দ্রব্যমূল্য কমিয়ে মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসবেন; দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করবেন; পাঁচ বছরে জ্বালানি খাতে দ্বিগুণ উৎপাদন বাড়াবেন; দরিদ্রের সংখ্যা দুই কোটিতে নামিয়ে আনবেন, বর্তমানে এর সংখ্যা ৬ দশমিক ৫ কোটি; এবং সন্ত্রাস ও ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের অর্থাৎ জঙ্গিদের দমন করবেন। এ ছাড়া তিনি সংসদ সদস্যদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অর্থবহ সংবিধানের আলোকে জাতীয় সংসদকে কার্যকর করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
ইশতেহারে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সমস্যার জন্য বিএনপি ও জামায়াতকে দায়ী করেছেন। হাসিনা জোট সরকারের পাঁচ বছরের উল্লেখ করে বলেন, তারা ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও জাতীয় অর্থসম্পদ লুটপাট করে দেশের অর্থনীতি নিচে নামিয়ে এনেছে। ইশতেহারে হাসিনার যে বিষয়টি আলাদা গুরুত্ব রাখে, তা হলো অসাম্প্রদায়িক ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে যুবক ও তরুণ ভোটারদের সহায়তা কামনা। এ ছাড়া প্রতিটি ঘরে ঘরে অন্তত একজন বেকার যুবকের চাকরি দেওয়া হবে বলে অঙ্গীকার করেছেন শেখ হাসিনা।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণার পরদিন ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে। 'দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও' স্লোগানে দলের প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ইশতেহারটি ঘোষণা করেন। আমরা বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একজন নেতার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কার কাছ থেকে দেশ ও মানুষকে বাঁচাতে আহ্বান করছে বিএনপি? তিনি উত্তর দিয়েছেন, দারিদ্র্যের হাত থেকে। বিএনপি তার নির্বাচনী ইশতেহারে যে বিষয়গুলোকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে উল্লেখ করেছে, সেগুলোর প্রায় সবই আওয়ামী লীগের ইশতেহারেও রয়েছে। বিএনপি তার ইশতেহারে উল্লেখ করেছে, তারা সরকার গঠন করার সুযোগ পেলে সংসদে ডেপুটি স্পিকার নেবেন বিরোধী দল থেকে। দেশকে শোচনীয় অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ তার ইশতেহারে বিএনপিকে দায়ী করলেও বিএনপি দায়ী করছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে।
প্রধান দুই দলের পরের দল জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে। উভয়ের ইশতেহারে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বড় চারটি দলই তাদের ইশতেহারে ইসলাম ধর্মকে সমুন্নত রাখার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
এসব ইশতেহার ঘোষণার পর স্থানীয় শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, নির্বাচনের আগে ইশতেহারে অনেক বিষয়ের উল্লেখ করা হয়। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর দ্রুত সেগুলো বদলেও যায়। একজন ব্যবসায়ী বলেছেন, আওয়ামী লীগের ইশতেহারে উল্লেখিত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে অন্তত ২০০ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের বার্ষিক জিডিপি ৭০ বিলিয়ন ডলার। আর বিএনপি তার ইশতেহারে যেসব বিষয় উল্লেখ করেছে, সেগুলো তারা ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার আগেও বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু করেনি।
১২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণা উপলক্ষে বাংলা ও ইংরেজিতে নিমন্ত্রণপত্র তৈরি করেছিল। বাংলা ও ইংরেজিতে মুদ্রিত ইশতেহার ও শেখ হাসিনার বক্তব্যসহ এর ইলেকট্রনিক সংস্করণ বিভিন্নজনকে বিলি করা হয়। শেখ হাসিনা ইশতেহার উপস্থাপনের পর কূটনীতিক ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের তাঁর সঙ্গে চা পানের নিমন্ত্রণ করেন। কিন্তু বিএনপির ইশতেহার ঘোষণার প্রক্রিয়াটি ছিল বেশ অগোছালো। তারা এ উপলক্ষে কোনো নিমন্ত্রণপত্র দেয়নি। মুখে মুখে ও মিডিয়ার মাধ্যমে খবর জানিয়েছিল তারা। খালেদা জিয়ার বক্তব্য ও ইশতেহার কোনোটিই ইংরেজিতে পাইনি আমরা। আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণার প্রক্রিয়া বিএনপির চেয়ে অনেক বেশি গোছালো ছিল।

No comments:

Post a Comment