Saturday, September 24, 2011

বীরকন্যা প্রীতিলতা by শরীফা বুলবুল ও আবদুল হাকিম

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অনন্য অধ্যায় বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আত্মোৎসর্গ। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা থেকেই অনেক নারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত হন। অনুশীলন, যুগান্তর প্রভৃতি বিপ্লবী দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন অনেক নারী। অগি্নযুগের প্রথম পর্বে স্বর্ণ কুমারী দেবী, সরলা দেবী, আশালতা সেন, সরোজিনী নাইডু, ননী বালা, দুকড়ি বালা; পরবর্তীকালে ইন্দুমতি দেবী (অনন্ত সিংহের দিদি), লীলা রায়, পটিয়া ধলঘাটের সাবিত্রী দেবী প্রমুখ নারী ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শামিল হন।
এরই ধারাবাহিকতায় বিপ্লবী আন্দোলনে শামিল হন বীরকন্যা প্রীতিলতা। ব্রিটিশ নাগপাশ থেকে দেশকে স্বাধীন করার জন্য নিজেকে গড়ে তোলার পাশাপাশি অসংখ্য বিপ্লবীকে প্রশিক্ষিত, অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করে গেছেন তিনি। আজ তাঁর আত্মাহুতি দিবস।
অগি্নযুগের এই বিপ্লবী ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ইউরোপিয়ান ক্লাবে হামলার নেতৃত্ব দেন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেপ্তার এড়াতে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন।
প্রীতিলতার জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে ১৯১১ সালের ৫ মে। বাবা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার মিউনিসিপ্যাল অফিসের কেরানি ও মা প্রতিভা ওয়াদ্দেদার একজন গৃহিণী ছিলেন। এক ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর ডাক নাম ছিল রানী।
প্রীতিলতার পড়াশোনার হাতেখড়ি মা-বাবার কাছে। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার মেয়েকে ডা. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করান। অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পান প্রীতিলতা। ওই স্কুল থেকে তিনি ১৯২৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকার ইডেন কলেজে। থাকতেন কলেজের ছাত্রীনিবাসে। এ সময় প্রীতিলতা বিপ্লবী
লীলা নাগের সংস্পর্শে আসেন। লীলা নাগ ওই সময় দীপালী সংঘের নেতৃত্বে ছিলেন। দীপালী সংঘ ছিল ঢাকার বিপ্লবী দল শ্রীসংঘের নারী শাখা। ১৯৩০ সালে তিনি আইএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে পঞ্চম হন। এরপর কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩২ সালের ডিসটিঙ্কশনসহ তিনি বিএ পাস করেন।
সংগ্রামী জীবন : ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল বিপ্লবী নেতা মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে অস্ত্র লুট, রেললাইন উপড়ে ফেলা, টেলিগ্রাফ-টেলিফোন বিকল করে দেওয়াসহ ব্যাপক আক্রমণ হয়। এটি চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ নামে পরিচিতি পায়। এই আন্দোলন সারা দেশের ছাত্র সমাজকে উদ্দীপ্ত করে। ১৯ এপ্রিল প্রীতিলতা ঢাকা থেকে ফিরে আগের রাতে বীর যোদ্ধাদের এই মহান কর্মকাণ্ডের খবর পান। প্রীতিলতার ভাষায়, 'ওই সব বীরের জন্য আমার হৃদয় গভীর শ্রদ্ধায় আপ্লুত হলো। কিন্তু ওই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে অংশ নিতে না পেরে এবং নাম শোনার পর থেকেই যে মাস্টারদাকে গভীর শ্রদ্ধা করেছি, তাঁকে একটু দেখতে না পেয়ে আমি বেদনাহত হলাম।'
কলকাতা বেথুন কলেজে পড়ার সময় একটু একটু করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে যান প্রীতিলতা। চাঁদপুরে হামলার ঘটনায় বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির আদেশ হয়। তিনি আলীপুর জেলে বন্দি ছিলেন। প্রীতিলতা বোন পরিচয়ে অনেকবার রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর প্রেরণায় প্রীতিলতা বিপ্লবী কাজে আরো বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তিনি গোপনে বিপ্লবীদের জন্য অর্থ, গোলাবারুদ সংগ্রহ করে কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম আনাসহ বিভিন্ন তৎপরতায় যুক্ত হন। ১৯৩১ সালের ৪ আগস্ট রামকৃষ্ণের ফাঁসি কার্যকর হয়। প্রীতিলতা লিখেছেন, 'রামকৃষ্ণ দার ফাঁসির পর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার অনেক বেড়ে গেল।'
বিএ পরীক্ষা শেষে প্রীতিলতা স্থায়ীভাবে চলে আসেন চট্টগ্রামে। এখানে তিনি নন্দনকানন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে (বর্তমান অপর্ণাচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়) প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
ওই সময় আরেক বীরকন্যা কল্পনা দত্তের মাধ্যমে মাস্টারদার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন প্রীতিলতা। এর মধ্যে যোগাযোগ ঘটে বিপ্লবী নির্মল সেনের সঙ্গে। ১৯৩২ সালের মে মাসে মাস্টারদার সঙ্গে প্রীতিলতার প্রতীক্ষিত সাক্ষাৎ ঘটে এবং দুই ঘণ্টা ধরে কথা হয়। এরপর তিন দিন অস্ত্র প্রশিক্ষণ লাভ করেন তিনি।
জুন মাসে বিপ্লবীদের শক্ত আস্তানা প্রীতিলতার জন্মস্থান ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে মাস্টারদা তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করার সময় ব্রিটিশ সৈন্যরা তাঁদের ঘিরে ফেলেন। বিপ্লবীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। যুদ্ধে প্রাণ দেন বিপ্লবী নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন। অন্যদিকে ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ক্যামেরুন নিহত হন। এ ঘটনার পর পুলিশ সাবিত্রী দেবীর বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। মাস্টারদা প্রীতিলতাকে বাড়ি ফিরে গিয়ে স্কুলের কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন। পরে পুলিশের নজরদারি বাড়ায় জুলাই মাসের দিকে তাঁকে আত্মগোপনে যাওয়ার নির্দেশ দেন মাস্টারদা।
দুই বছর আগে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল যুব বিদ্রোহের সময় অন্যতম পরিকল্পনা ছিল পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ। কিন্তু ওইদিন গুড ফ্রাইডে থাকায় সে পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছিল। ১৯৩২ সালে আবারও এই ক্লাবে আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করেন বিপ্লবীরা। ওই বছরের ১০ আগস্ট আক্রমণের দিন ধার্য করা হয়। পরিকল্পনা হয়, সেপ্টেম্বর মাসে নারী বিপ্লবীদের নেতৃত্বে আক্রমণ হবে। এর আগেই কল্পনা দত্ত পুলিশের হাতে ধরার পড়ার পর আক্রমণের নেতৃত্ব দেওয়া হয় প্রীতিলতাকে। আক্রমণের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য কাট্টলীর সাগরতীরে প্রীতিলতা ও তাঁর সাথীদের অস্ত্র শিক্ষা শুরু হয়। ওই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে সফল হন বিপ্লবীরা। পুরুষের ছদ্মবেশে আক্রমণে নেতৃত্ব দেন প্রীতিলতা। পরে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। এ অবস্থায় ধরা পড়ার আগে সঙ্গে রাখা সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দেন এই বীরকন্যা।
বিপ্লবী আন্দোলনের পাশাপাশি প্রীতিলতা নারীদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন।
কর্মসূচি : প্রীতিলতার মহান আত্মত্যাগ স্মরণে আজ ২৪ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা ট্রাস্টের উদ্যোগে চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে প্রীতিলতা প্রাথমিক বিদ্যালয় মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন চট্টগ্রামস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের সহকারী হাইকমিশনার সোমনাথ ঘোষ।

No comments:

Post a Comment