Sunday, January 16, 2011

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা by আকবর আলি খান

৯৬০-এর দশকে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দেয়া হয় তখন পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়, বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতা অর্থনীতির দিক থেকে আত্মঘাতী হবে। তারা এমন একটি ধারণা দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সেই অর্থনীতি টিকে থাকতে পারবে না।

তার সাথে সাথে আরো দুটি ধারণার সৃষ্টি করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব হবে না। ফলে জনসংখ্যার চাপে ক্ষুদ্র ভূ-খণ্ডে বাংলাদেশের অর্থনীতির মুখ থুবড়ে পড়বে। সবশেষে পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদরা ও তাদের পশ্চিমা দোসররা প্রচার করেন, বাংলাদেশের পক্ষে বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া আদৌ টিকে থাকা সম্ভব হবে না।

দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় চলিস্নশ বছর পূর্ণ হতে চলছে। এই চার দশকের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে আমরা তখনকার পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ ও তাদের দোসরদের বক্তব্যের যথার্থতা বিচার করতে পারি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত সে সময়কার পূর্ব-পাকিস্তান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল, এই সময়ে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত সময়কালে সাবেক পূর্ব-পাকিস্তানে মাথাপিছু স্থূল জাতীয় উৎপাদের হিসাব রয়েছে। প্রায়ত স্বদেশ বোসের হিসাব অনুসারে ১৯৮৯-৫০ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে মাথাপিছু স্থূল জাতীয় উৎপাদ ছিল ৩১০ রুপি। ১৯৫৪-৫৫ সালে এই মাথাপিছু আয় কমে ৩০০ রুপিতে দাঁড়ায়। ১৯৫৪-৫৫ সময়কাল হতে ১৯৫৯-৬০ সময়কালে মাথাপিছু উৎপাদ আরো কমে ২৬৯ রুপিতে দাঁড়ায়। ১৯৬০ সাল থেকে অর্থাৎ আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের পর মাথাপিছু স্থূল জাতীয় উৎপাদ পরিমাণ বাড়তে থাকে। এ সংখ্যা ১৯৬৪-৬৫ সালে ২৮৩ রুপিতে উন্নীত হয়। ১৯৬৯-৭০ সালে এই সংখ্যা ৩১৪ রুপিতে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ২০ বছর সময়কালে বাংলাদেশে মাথাপিছু উৎপাদ ৩২০ রুপি হতে ৩১৪ রুপিতে উন্নীত হয়। অর্থাৎ সংখ্যাতত্ত্বের ভাষায় এই ২০ বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় প্রায় স্থির ছিল। পক্ষান্তরে বর্তমান পাকিস্তানে (যা তখন পশ্চিম পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল) ১৯৪৯-৫০ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৩২৪ রুপি। ২০ বছর পর অর্থাৎ ১৯৬৯-৭০ সালে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল ৫০৪ রুপি। অর্থাৎ পাকিস্তানে গড়ে তিন শতাংশ হারে মাথাপিছু আয় বেড়েছিল। অথচ বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের অগ্রগতি ঘটে এবং পরবর্তী সময়ে কোনোক্রমে ১৯৪৯-৫০-এ মাথাপিছু আয় সমান হওয়া সম্ভব হয়।

স্বাধীনতা পূর্ববতর্ী ২০ বছরের সাথে যদি আমরা বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা তুলনা করি তাহলে নিম্নলিখিত প্রবণতাগুলো দেখতে পাই :

ক) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি : ১৯৭৫ সাল থেকে ২০০৫ সময়কালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। হিসাব করলে দেখা যাবে, স্বাধীনতা পূর্বকালে সাবেক পূর্ব-পাকিস্তানে ২০ বছরে যে পরিমাণ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে প্রতি বছরেই হয়েছে। ত্রিশ বছরে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হওয়া নেহাৎ অকিঞ্চিতকর নয়। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, শিল্প-বিপস্নবের সময় যুক্তরাজ্যে প্রথমবার মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হতে ৫৭ বছর সময় লেগেছিল।

খ) গড় আয়ুর প্রত্যাশা বৃদ্ধি : বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুসারে ১৯৬০ সালে বাংলাদেশের গড় আয়ুর প্রত্যাশা ছিল ৪২ বছর। সেই সময়ে পাকিস্তানে গড় আয়ু ছিল ৪৪ বছর। সর্বশেষ হিসাব অনুসারে পাকিস্তানের গড় আয়ু ৬৫ বছর। আর বাংলাদেশের গড় আয়ুর প্রত্যাশা ৬৪ বছর। (২০০৯ সালে বিশ্বব্যাংকের দেয়া হিসাব অনুযায়ী)।

গ) জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি : গড় আয়ুর প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার কমে এসেছে। অথচ সত্তরের দশকে অনুমান করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান অনুন্নত দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধি কমানো সম্ভব হবে না। ১৯৬৯-৭০ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে মোট জনসংখ্যা ছিল ছয় কোটি ছিয়ানব্বই লক্ষ আর পশ্চিম পাকিস্তানে জনসংখ্যা ছিল পাঁচ কোটি আটাশি লক্ষ। ২০০৭ সালে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ষোল কোটি বিশ লক্ষ। অন্যদিকে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ছিল পনের কোটি নব্বই লক্ষ। অর্থাৎ যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো তাহলে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের একটি সংখ্যালঘু প্রদেশে পরিণত হতো। শুধু জনসংখ্যার দিক দিয়েই নয়, খাদ্য উৎপাদনেও বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। ১৯৬৪-৬৫ সালে সাবেক পূর্ব-পাকিস্তানে মোট খাদ্য উৎপাদন ছিল এক কোটি চার লক্ষ টন। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত এই সময়ের পরে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ হলো ২.৬৫ কোটি টন। একই সময়ে পাকিস্তানে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ২.৬৪ কোটি টন।

বাংলাদেশ সম্বন্ধে সবচেয়ে অপপ্রচার করা হয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক সাহায্যের নির্ভরশীলতা প্রসঙ্গে। এ কথা সত্য, স্বাধীনতার ঊষালগ্নে যখন পাকিস্তান সকল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কুক্ষিগত করে নেয় তখন বাধ্য হয়ে বাংলাদেশকে বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। আজকে এই পরিস্থিতি নেই। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে মাথাপিছু বৈদেশিক সাহায্য ছিল নয় ডলার। এই সময়ে পাকিস্তানে মাথাপিছু বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তি ছিল চৌদ্দ ডলার। একই সময়ে উন্নয়নশীল দেশসমূহে মাথাপিছু বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল একত্রিশ ডলার।

পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোর শতকরা আশিভাগ দেশ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি বৈদেশিক সাহায্য পেয়ে থাকে।

উপরের আলোচনা হতে এ কথা সুস্পষ্ট যে, স্বাধীনতার পূর্বকারে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক ব্যাপক ও আশাব্যঞ্জক। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক কাঠামোতে এ ধরনের প্রবৃদ্ধি আদৌ সম্ভব হতো না। যদিও সম্পদের সুষম বণ্টনের সমস্যা বাংলাদেশে রয়েছে তবুও এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, প্রবৃদ্ধির সোনার ফসল সাধারণ মানুষের কাছেও পেঁৗছেছে। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতো। এখন এই হার ৪০ শতাংশে নেমে এসেেছ। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় এসব অর্জন অবশ্যই ঈর্ষণীয়।

গত চার দশকের এসব লক্ষণীয় অর্জন সত্ত্বেও এখনো অনেকগুলো সমস্যা রয়ে গিয়েছে। বিশ্বের মাথাপিছু আয়ের তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ এখনো অনেক কম। বাংলাদেশে ভূমিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ অত্যন্ত অপ্রতুল। এখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর প্রচণ্ড ঘাটতি রয়েছে। উন্নত দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশ আদৌ উন্নত দেশের কাতারে উঠে আসতে পারবে কি না? আমি অবশ্য এ বিষয়ে আশাবাদী। আমার আশাবাদের কারণ দুটি_একটি হলো, তাত্তি্বক, আরেকটি হলো ঐতিহাসিক।

তাত্তি্বক ব্যাখ্যাটি উপস্থাপন করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক আলেকজান্ডার গ্রাসচেনক্রনে, তার বক্তব্য হলো যে, শিল্প-বিপস্নবের প্রথম পর্যায়ে যেসব রাষ্ট্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছেন তাদের প্রবৃদ্ধি ছিল শস্নথ। উন্নয়নের অগ্রপথিক হিসাবে তাদেরকে ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন করে অগ্রগতির পথে এগোতে হয়েছে। কিন্তু যেসব দেশ পরবর্তী পর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাদের পক্ষে নতুন করে নিজেদের ভুল থেকে শিখতে হবে না। তারা অন্যদের ভুলের ইতিহাস মনে রেখে এবং সর্বশেষ কারিগরি জ্ঞান প্রয়োগ করে উন্নতি করতে পারবেন।

ষাটের দশকে যখন এই তথ্য উপস্থাপন করা হয় তখন অনেকেই এর যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বিগত পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে এই অনুমানই সঠিক। অন্যথায় ভারত ও চীনের পক্ষে এত বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হতো না। আমরা ইতিহাসে যাকে প্রথম শিল্প-বিপস্নব বলি সেটি ঘটেছিল যুক্তরাজ্যে। সেই সময়ে যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি। এই জনসংখ্যার মাথাপিছু আয় ৫৭ বছর সময়ের মধ্যে দ্বিগুণ করা হয়। এতেই সারা বিশ্বে হৈ চৈ পড়ে যায়। অথচ আমাদের চোখের সামনে প্রায় ১৩০ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে দশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ দ্বিগুণ করেছে প্রায় ১২০ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে ভারতেও আমরা একই ধরনের পরিস্থিতি দেখেছি। ভারত ও চীন যা করতে পারে বাংলাদেশের পক্ষেও সেটা করতে পারা উচিত। তবে তার জন্য প্রয়োজন সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সুষ্ঠু অর্থনৈতিক নীতিমালা। এই দুটির সমন্বয় করতে পারলে বাংলাদেশের সৃজনশীল মানুষ একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারবে।

No comments:

Post a Comment