Sunday, January 16, 2011

সংস্কৃতির বিভিন্ন কণ্ঠের কোরাস by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

থাটা ফ্রেড জেমিসনের: ইতিহাস তা-ই যা ব্যথা দেয়। ইতিহাস পপুলার মাইণ্ড থেকে গরহাজির, এই বিলাপ উচ্চতর একাডেমিগুলিতে, এই বিলাপ বুর্জোয়া রাজনীতিবিদদের এবং তাদের নির্মিত রাষ্ট্রে। ডান রাজনীতিতে এই বিলাপের শেষ নেই, বাম রাজনীতিতে আছে এই বিলাপের ধ্বনি।

এই অর্থে কি ইতিহাস ব্যথা দেয়? না বোধ হয়। বাংলাদেশে পপুলার সংস্কৃতি একদিকে ডান প্রভাবিত এবং বাম প্রভাবিত সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করছে, অন্যদিকে প্রান্তিক সংস্কৃতিগুলো আত্মস্থ করে শক্তিশালী হচ্ছে। ডান সংস্কৃতি মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে মতাদর্শিক সাহায্য পাচ্ছে এবং ধর্মজ বোধের মাধ্যমে এই সংস্কৃতি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। রক্ষণশীলতা কিংবা নব্য রক্ষণশীলতা ধর্মজ আখ্যান দিয়ে দেশের অভিজ্ঞতা এবং সংস্কৃতিগুলির সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। দেশের অভিজ্ঞতা হচ্ছে রাষ্ট্র হওয়ার অভিজ্ঞতা এবং সংস্কৃতিগুলি হচ্ছে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের স্মৃতি : তেভাগা থেকে হাজং, নানকার থেকে জিরাটিয়াসহ বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনের স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে একই সঙ্গে রাষ্ট্র হওয়ার অভিজ্ঞতা এবং কৃষক আন্দোলনের লড়াইয়ের ডকুমেন্টেশন। এ সকল অভিজ্ঞতাকে পেছনে ফেলার চেষ্টা করেছে ধর্মজ বোধের মাধ্যমে ধর্মজ আখ্যান দিয়ে নব্য রক্ষণশীলতা। মুক্তিযুদ্ধ কি ধর্মজ আখ্যান? মুক্তিযুদ্ধ কি সেকু্যলার সমাজতান্ত্রিক আখ্যান? মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দুই বিরোধী সমাজতান্ত্রিক আদর্শের যে-লড়াই হয়েছে (সোভিয়েত মতাদর্শ বনাম চিনা মতাদর্শ), তার স্থান কি যুদ্ধের মধ্যে এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ে পড়েনি? যেসব কৃষক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, যারা ডানপক্ষভুক্ত নন কিংবা বামপক্ষভুক্ত নন, কিংবা বাম প্রভাবিত সোভিয়েতপন্থী অথবা চিনাপন্থী নন, যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তি সম্বন্ধে সচেতন হয়েছেন, তাঁরা বর্িিভন্ন ধরনের পপুলার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে সমাজ পরিব্রাজন করেছেন, তাঁরা কিন্তু ফর্মাল পলিটেক্সে অংশগ্রহণ করেননি। তাদের অংশগ্রহণ এক ধরনের টেক্স যুদ্ধ নামক অ-বিদ্যায়নিক টেক্সটের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের প্রকাশ করেছেন পূর্বপুরুষের লড়াইয়ের স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে। এসব স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতা একদিকে পাকিস্তান কলোনিয়াল রাষ্ট্র অবদমিত করেছে, এবং অন্যদিকে যুদ্ধ নামক ফর্মাল পলিটিক্স ব্যক্তিগত এবং পাবলিক জীবনাচরণ সামনে আসতে দেয়নি। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে শ্রেণী এবং সংস্কৃতি উদ্ভাসিত হয়েছে, গণসংস্কৃতি সম্পাদিত হয়েছে ফর্মাল পলিটিক্স একপাশে ঠেলে, এভাবেই ডানের সংস্কৃতি কোণঠাসা হয়েছে। সে জন্য মুক্তিযুদ্ধ, বিভিন্ন যোদ্ধার নিজস্ব জীবনচালিত, ফর্মাল পলিটিক্সের বাইরে প্রতিরোধের জটিল উৎস।

পপুলার সংস্কৃতির মধ্যে একটা ইউটোপিয়ান ডিমেনশন আছে। এই ডিমেনশন আছে বলেই পপুলার সংস্কৃতির পক্ষে সমকালীন ক্ষমতা সম্পর্কের ক্রিটিক করা সম্ভব। পপুলার সংস্কৃতি, এদিক থেকে, সমকালীন ক্ষমতা সম্পর্ক ছিঁড়েখুঁড়ে খায়, কংক্রিট আকার দেয় পলিটিক্সকে (যেমন, পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা এই কাজটা করে চলেছেন সাহসের সঙ্গে)। এটাই হচ্ছে ঐতিহাসিক আখ্যান, ফর্মাল পলিটিক্সের বাইরে তারা ভবিষ্যতের ইতিহাস এবং রাজনীতি সফল করে চলেছেন।

একে কি অর্জিত ইউটোপিয়া বলা যাবে? অর্জিত বিপস্নব? আমার তো মনে হয় এভাবে আমরা ইউটোপিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছি, এক পা দুই পা করে বিপস্নবের ভূমি দখল করে নিচ্ছি। এখানেই বামের অন্তদর্ৃষ্টি লুকানো, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়া। যে দেশ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে (যেমন, রাশিয়া সমাজতন্ত্র বিট্রে করছে কিংবা চিন ধনতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছে), সে দেশ সমাজতন্ত্রের মনোপলি তৈরি করে সমাজতন্ত্র থেকে সরে আছে। পপুলার সংস্কৃতি এদিকটা সম্বন্ধে সজাগ।

পপুলার সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, এভাবে প্রান্তিক সেনসিবিলিটি কাজ করে চলেছে। বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে সংস্কৃতির বিভিন্ন কণ্ঠের কোরাস এবং সংস্কৃতিক সাহস পরীক্ষার ভূমি। বিভিন্ন কণ্ঠ এবং বিভিন্ন পরীক্ষা মানুষকে সহনশীল করে তুলেছে, যারা গতকাল প্রান্তিক ছিলেন, তারা আগামীকাল কেন্দ্রে এসে যাচ্ছেন। মার্জিনাল সংস্কৃতি এই প্রক্রিয়ায় পপুলার সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে, স্টাবলিশমেন্টের রাজনীতি (বাম এবং ডান) ভয় পাচ্ছে। এই ভয় পাওয়া বৈধতা দিচ্ছে প্রান্তিক সেনসিবিলিটিকে, শক্তিশালী করে তুলছে প্রান্তিক মানুষগুলোর ক্ষমতাকে, (পোশাক শিল্পের কর্মীদের, ফুটপাতের ফেরিওয়ালাদের, নিঃস্ব কৃষকদের কিছুতেই হটানো যাচ্ছে না), তারা নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন, তারা ইতিহাসের দিক থেকে কমিউনিটির বীর। তাদের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে কবর দেয়া, গ্রুপ আইডেন্টিটির আখ্যান প্রতিরোধের সংস্কৃতি ফিরে এসেছে। ধানের লড়াই, ভাতের লড়াই, বাসস্থানের লড়াই, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখার লড়াই_এ সবই পপুলার সংস্কৃতির ইতিহাস, বিভিন্ন কণ্ঠের কোরাস। সাধারণ মানুষ এভাবেই নিজেদের মবিলাইজ করছে বিপস্নবের জন্য।

No comments:

Post a Comment