Sunday, January 16, 2011

লাশের পকেটে বেজে উঠল ফোন

রসিংদী জেলা হাসপাতালের লাশঘরে গতকাল সারি সারি রাখা নিহত পুলিশ সদস্যদের লাশ। হঠাৎ বেজে ওঠে মোবাইল ফোন। শব্দ আসছিল নিহত কনস্টেবল রেজাউল করিমের পোশাকের ভেতর থেকে। একজন কনস্টেবল মোবাইল ফোনটি বের করে কল ধরেন।

ও প্রান্তের কথা শুনে বলেন, ‘আমি রেজাউল না। আপনারা দ্রুত জেলা হাসপাতালে আসেন।’ ফোনের লাইন কাটার পর কারো সঙ্গে কথা না বলেই নীরবে কাঁদতে থাকেন ওই কনস্টেবল। হাসপাতালে একইভাবে আরো দুজন নিহত কনস্টেবলের পকেটে মোবাইলের রিং বেজে ওঠে। কনস্টেবল মঞ্জুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “নিহতের স্বজনরা ফোন করে দুর্ঘটনার খবর জানতে চেয়েছেন। কেউ বলেন, ‘আমার ছেলে এখন কেমন আছে?’ কেউ বলেন, ‘অজয়ের বাবার কী অবস্থা?’ কিন্তু আমি কিভাবে বলব, দুর্ঘটনায় সব শেষ হয়ে গেছে! ”
সকালেও কথা হয়েছিল : ‘পৌরসভা নির্বাচনের কারণে খুব ব্যস্ত থাকতে হবে।
মেয়েদের বলবা, ঠিক সময়ে খাওয়া-দাওয়া করতে।’ স্ত্রী জয়নবুন্নেসা স্মৃতিকে সকালে মোবাইল ফোনে বলেছিলেন নরসিংদীর বেলাব থানার ওসি ফারুক আহমেদ খান। এর দুই ঘণ্টা পর স্ত্রী খবর পান, তাঁর স্বামী সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার থেকে তিন মেয়ে অনিকা (৯), অর্ণা (৭) ও প্রিয়ন্তিকে (৪) নিয়ে নরসিংদী ছুটে যান স্মৃতি। গিয়ে পান স্বামীর নিথর দেহ।
‘ও দাদা, আমার বাবা কথা বলে না কেন, কী হয়েছে আমার বাবার? গায়ে এত রক্ত কেন?’ দাদা আলী আহাম্মদ খানকে প্রশ্ন করে অনিকা। কী জবাব দেবেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক আলী আহাম্মদ খান? বুকচাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ওরা আমার সোনারে কাইড়া নিছে!’ ওদিকে স্বামীর লাশ দেখে স্মৃতি বিলাপ করছিলেন, ‘তোমাকে ছাড়া ওরা কিভাবে বাঁচবে? কাকে বাবা বলে ডাকবে?’ মায়ের কান্না দেখে প্রিয়ন্তিও কাঁদতে থাকে। বাবাকে হারিয়ে কাঁদছিল অর্ণাও।
রিক্তর কী থাকল? : কনস্টেবল নারায়ণচন্দ্র দাস স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে বেলাব থানার পাশেই ভাড়া বাসায় থাকতেন। ছেলে অজয় প্রসাদ রিক্ত (৭) স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনে প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। ছোট মেয়ে সমিতা রানী চন্দ্রের বয়স চার বছর। সংবাদ পেয়ে বেলাব থেকে দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে নরসিংদী জেলা হাসপাতালে ছুটে এসেছেন নারায়ণচন্দ্র দাসের স্ত্রী সুবর্ণা রানী চন্দ্র।
সহ্য করতে পারবেন না ভয়ে সুবর্ণাকে স্বামীর লাশের সামনে যেতে দিচ্ছিলেন না নারায়ণের সহকর্মীরা। সুবর্ণা হাসপাতালের বারান্দায় ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বসে বিলাপ করতে থাকেন। মায়ের কান্না দেখে দুই পাশে অবুঝ দুই সন্তান নির্বাক হয়ে যায়। রিক্ত সাংবাদিকদের জানায়, ‘সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বাবা বাড়ি থেকে বের হন। যাওয়ার সময় বলেন দুষ্টুমি না করতে। আমি কথা দিয়েছি, দুষ্টুমি করব না। কিন্তু এখন আংকেলরা বলছেন, বাবা নাকি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাহলে কি বাবা আর ফিরে আসবেন না!’
কাঁদতে কাঁদতে সুবর্ণা রানী চন্দ্র বলেন, ‘রাতে নারায়ণের ডিউটি ছিল। ভোর ৫টার দিকে বাড়ি ফেরেন তিনি। আবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে পুলিশ লাইনের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন।’ সকাল ১১টায় আসে দুর্ঘটনার সংবাদ। কাঁদতে কাঁদতে একসময় মূর্ছা যান সুবর্ণা। জ্ঞান ফেরার পর বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘দুটি ছোট ছেলে-মেয়েকে এখন কিভাবে আমি মানুষ করব?’
সহকর্মীদের কান্না : সহকর্মীদের লাশ নিজ হাতে ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে লাশঘরে নিয়ে যাচ্ছেন অন্য কনস্টেবলরা। আবার সেই লাশ তাঁরাই নিয়ে যাচ্ছেন পুলিশ লাইনে। লাশ বহনের সময় প্রতিটি সহকর্মীর চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ছিল। কনস্টেবল মোস্তফা বলেন, ‘মাসুদ পারভেজ ভাই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। দেখা হলেই বাড়ির খোঁজ নিতেন। গতকালও আমাদের কথা হয়। আজ তাঁর লাশ বহন করতে হচ্ছে।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক এখন মৃত্যুফাঁদ। প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে।’
সহকর্মীদের মরদেহ গাড়িতে তোলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় বসাকও। এ সময় উপস্থিত অন্যরাও অশ্র“ সংবরণ করতে পারছিলেন না। বিজয় বসাক সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকালেও তাঁরা সবাই ছিলেন সহকর্মী। আর এখন তাঁরা আমাদের মধ্যে নেই, আছে তাঁদের নিথর দেহ। এটা কোনো পুলিশের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।’ নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাস উদ্দিন দুর্ঘটনার পর থেকে ছোটাছুটি করছেন। তিনি বলেন, ‘নরসিংদী পৌরসভার আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সভায় আসতে গিয়ে এভাবে প্রাণ হারাতে হবে আমার লোকজনকে, ভাবতেই পারছি না।’
নিহত পুলিশ সদস্যদের মরদেহ দেখে নির্বাক হয়ে পড়েন পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার। নিহতদের পরিবারের স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজের চোখই ছলছল করে ওঠে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশে এমন দুর্ঘটনা কখনো দেখিনি।’ তিনি নিহতের পরিবারকে সরকার থেকে বিশেষভাবে সহায়তা করা হবে বলে আশ্বাস দেন। তিনি সনাতন ট্রাফিক আইন পরিবর্তন করে তা যুগোপযোগী করার ব্যাপারেও মত দেন।
আনোয়ার হোসেন নামের একজন সহকর্মী বলেন, ‘বিশ্বাসই করতে পারছি না। গাড়িতে ওঠার আগেও একসঙ্গে চা খেলাম, গল্প করেছি, সেই মানুষগুলো এখন লাশ!’

No comments:

Post a Comment