Sunday, January 16, 2011

সীমান্তে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করবে বিএসএফ! by মেহেদী হাসান

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। কূটনৈতিক সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তবে আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, আগামী ফেব্র“য়ারি মাসের মধ্যে ত্রিপুরা সীমান্তে বিএসএফ পরীক্ষামূলক রাবার বুলেটের ব্যবহার শুরু করবে।

ভারতে অনুপ্রবেশ রোধে এ ব্যবস্থা সফল হলে আগামী দিনগুলোতে মারণাস্ত্রর ব্যবহারের বদলে বিকল্প অস্ত্র ব্যবহার করা হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে শুধু কাশ্মীর সীমান্তে নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী প্রাণঘাতী নয় (নন-লিথাল) এমন অস্ত্র ব্যবহার করে। এদিকে ঢাকায় স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুস সোবহান শিকদার ভারতের এ উদ্যোগের কথা অনানুষ্ঠানিকভাবে জানার কথা স্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ অনেক আগেই ভারতের কাছে এ দাবি জানিয়েছিল। ভারত এ ধরনের উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশ অবশ্যই একে সাধুবাদ জানাবে।
গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ঘোষিত ৫১ দফা যৌথ ইশতেহারের ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীই তাঁদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এর পরও বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে বাংলাদেশিদের মৃত্যু হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাবে গত বছর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ৭৪ জন বাংলাদেশি নিহত হয়। তাদের মধ্যে ২৪ জনকে নির্যাতন ও ৫০ জনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া গত বছর ৪৩ বাংলাদেশিকে বিএসএফ অপহরণ করেছে বলে সংগঠনটির বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন দীর্ঘদিন সীমান্তে বিএসএফের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও দৃশ্যত দায়মুক্তিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এমনকি বিশ্লেষকরা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
গত ডিসেম্বর মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রকাশিত ‘ট্রিগার হ্যাপি : অ্যাক্সেসিভ ইউজ অব ফোর্স বাই ইন্ডিয়ান ট্র–পস অ্যাট দ্য বাংলাদেশ বর্ডার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সীমান্তে বিএসএফ
জওয়ানদের দ্বারা নির্বিচার হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণের অসংখ্য প্রমাণ মিলেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সংগঠনটির পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেছেন, বিএসএফকে বেপরোয়া মনে হয়েছে। সন্দেহভাজন মনে হলেই যে কাউকে গুলি করার নির্দেশ তাদের দেওয়া আছে। সীমান্ত এলাকায় মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর অধিকাংশই অনুপস্থিত। এর আগে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে বৈঠক শেষে বিএসএফের মহাপরিচালক (ডিজি) শ্রী রমন শ্রীবাস্তব সীমান্তে গুলি বন্ধের আশ্বাস না দিয়ে বলেছিলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে সীমান্তের ভারতীয় অংশে সান্ধ্য আইন (কারফিউ) চলছে। এই কারফিউ ভেঙে রাতের আঁধারে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া ব্যক্তিদের অপরাধী বলেও তিনি আখ্যায়িত করেছিলেন। সম্প্রতি বিএসএফের গুলিতে ফেলানির নির্মম মৃত্যুতে আবারও সীমান্ত পরিস্থিতির ভয়াবহতা উন্মোচিত হয়েছে।
গত শুক্রবার নয়াদিল্লির একটি সূত্র জানায়, ভারতের সেনাবাহিনীতে যখন স্মরণকালের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন চলছে, তখন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মারণাস্ত্র ব্যবহার বন্ধের কথা ভাবছে বিএসএফ। ঢাকায় কূটনৈতিক সূত্র কালের কণ্ঠকে জানিয়েছে, পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন সীমান্তে প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসএফ। এ প্রচেষ্টা সফল হলে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ হবে। জানা গেছে, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আগামী মাস থেকেই ত্রিপুরা সীমান্তে রাবার বুলেট ব্যবহার করা হবে। এতে অনুপ্রবেশকারীরা আহত হলেও নিহত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না।
সূত্রে জানা যায়, সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায়ও পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে বিএসএফ। শিগগিরই বিএসএফের ত্রিপুরা ডিভিশন সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদারে হেলিকপ্টার পাবে। এই হেলিকপ্টার প্রায় ৮৫৬ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার ও রসদ সরবরাহ কাজে বিএসএফকে সহযোগিতা করবে। এ ছাড়া সীমান্তে বিএসএফ সদস্যদের দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে নাইট ভিশন চশমা ও আগাম সতর্ক ব্যবস্থা চালু হবে।
সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজ আগামী বছরের মার্চ মাসের দিকে শেষ হওয়ার কথা। সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীরা বেড়া নেই এমন স্থানগুলো ব্যবহার করছে বলে বিএসএফ মনে করে। তাই সীমান্তরক্ষী বাহিনী ওই স্থানগুলোর দিকে বেশি নজরদারি করবে।
বিএসএফের মারণাস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুস সোবহান শিকদার গতকাল দুপুরে কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনিও অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন সূত্রে এ বিষয়ে জেনেছেন। সীমান্তে দায়িত্ব পালনকারী নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষ করে বিএসএফের গুলিতে যাতে কেউ মারা না যায় সে জন্য বাংলাদেশ বেশ আগেই প্রাণঘাতী গুলির বিকল্প ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত এখনো এ বিষয়ে কিছু জানায়নি। ভারত এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিলে বাংলাদেশ অবশ্যই একে স্বাগত জানাবে।
স্বরাষ্ট্রসচিব আরো বলেন, সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছে। নিহতদের সবাই চোরাকারবারি নয়।
ফেলানির মর্মান্তিক মৃত্যুর বিষয়ে স্বরাষ্ট্রসচিব বলেছেন, ওই মৃত্যুর ব্যাপারে ভারত এখনো কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। এ সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি তোলা হবে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির (সাবেক বিডিআর) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যম সূত্রে সীমান্তে বিএসএফের মারণাস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘গত এক বছরে সীমান্তে সব হত্যাকাণ্ড গুলির কারণে হয়নি। বাংলাদেশিদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করেও হত্যা করা হয়েছে। বিএসএফ পাকিস্তান সীমান্তে দায়িত্ব পালন করলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাদের হত্যার হার অনেক বেশি। বিডিআর-বিএসএফ পর্যায়ের বৈঠকেও আমরা তাদের মারণাস্ত্র ব্যবহার না করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভুটানের থিম্পু সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকেও এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্তে হত্যা বন্ধের আশ্বাস দিয়েও ভারত তা রক্ষা করেনি। তা ছাড়া অনেক স্থানে পিলারগুলো দৃশ্যমান না থাকায় সীমান্ত চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। এর পরও আমাদের জেলেদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যার পর বলা হয় আÍরক্ষার্থে বিএসএফ গুলি ছুড়েছে। অসমর্থিত সূত্রে আমি মারণাস্ত্র ব্যবহার না করার কথা জেনেছি। আমি এ ব্যাপারে খুব একটা আশ্বস্ত নই।’
এদিকে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সেক্রেটারি আদিলুর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, এ মাসেই বিএসএফের গুলিতে চার বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তার নিজ দেশের জনগণ ও বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেছে। আগে বিএসএফ মারণাস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করুক, এরপর তাঁরা তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানাবেন। ফেলানি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে অধিকার আজ একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবে বলে তিনি জানান।

No comments:

Post a Comment