Sunday, January 16, 2011

বাংলাদেশে সরকার ও জনপ্রশাসন by হাসনাত আবদুল হাই

রাষ্ট্রের যে তিনটি স্তম্ভ সকল দেশের সংবিধানে দেখা যায় বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নেই। যদিও এই তিনটি স্তম্ভ (ক) সংসদ, (খ) বিচার বিভাগ এবং (গ) নির্বাহী বিভাগ বা সরকারের সঙ্গে স্থানীয় সরকার যোগ করা উচিত, কেননা স্থানীয় সরকার নির্বাহী বিভাগের মতোই প্রশাসনিক এবং উন্নয়নমূলক কাজ করে থাকে।

কোনো দেশে স্থানীয় সরকারকে রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না বলেই বাংলাদেশের সংবিধানে এর ব্যতিক্রম করা হয়নি, এমন ভাবা যায়। এখন দেখা যাক গত ঊনচলিস্নশ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার বা নির্বাহী বিভাগ কিভাবে পরিচালিত হয়েছে এবং এই ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন দেখা দিয়েছে কি না, পরিবর্তন হয়ে থাকলে তা কাদের স্বার্থে বা কিসের জন্য হয়েছে এবং তার পরিণতিতে কী পাওয়া গেছে। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং প্রয়োজনের নিরিখে বলা যাবে ভবিষ্যতে আগামী দশ কি বিশ বছরে সরকার পরিচালনায় কেমন হবে এবং আদর্শগতভাবে কী হওয়া উচিত।

দুই.


বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পাকিস্তান আমলে যেসব কেন্দ্রীয় সার্ভিসের আমলা ছিলেন তারা দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে সরকারের বিভিন্ন স্তরে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান। এদের তুলনায় প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা এই সুযোগ কমই পেয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় সার্ভিস ক্যাডারের মধ্যে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি) শীর্ষে থাকায় বাংলাদেশ সরকারে বাঙালি সিএসপি অফিসাররাই প্রায় একচেটিয়া উচ্চতম পদগুলোতে নিয়োজিত হন। তবে এখানে প্রথম দিকে সিএসপিদের মধ্যেও বয়োজ্যেষ্ঠতা মানা হয়নি। যেসব সিএসপি (এবং অন্যান্য ক্যাডারের সদস্য) মুজিবনগর সরকারে কাজ করেছিলেন তারা সবাই বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে নিয়োজিত হন। এতে তাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা ক্ষুব্ধ হলেও কিছু বলতে পারেননি। ১৯৭৫-এর আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মুজিবনগরের সচিবদের বদলে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সাবেক কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব এবং অন্যান্য উচ্চতর প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দেয়া শুরু হলো। ১৯৭৫ সালের আগে ও পরে রাজনৈতিক ও সামরিক সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট কিছু আমলা (আমলাতন্ত্রের বাইরের ব্যক্তিও) সরকারের উচ্চতর পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের সদস্যরা এসব সুযোগ না পাওয়ার ফলে ক্ষুব্ধ হলেন এবং শক্ত লবিং (তদবির) করে তাদের কেউ কেউ উচ্চতর পদে নিয়োগ পেয়ে যান। এ উদ্দেশ্যে প্রাদেশিক জুনিয়র ও সিনিয়র সিভিল সার্ভিস একীভূত করা হয়।

পাকিস্তান আমলেই সিএসপি ক্যাডার এবং অন্যান্য ক্যাডারের সদস্যদের মধ্যে প্রশাসনে উচ্চতর পদে নিয়োগ পাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। অন্য সার্ভিস ক্যাডারের সদস্যরা সিএসপিদের দ্রুত পদোন্নতি এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের বিরোধিতা করে আসছিল। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পালাবদলের পর সামরিক কতর্ৃপক্ষের সমর্থন পেয়ে যায় এই নন-সিএসপি ক্যাডারের সদস্যরা। তারা সংখ্যায় বেশি ছিল, সামরিক কতর্ৃপক্ষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। সামরিক কতর্ৃপক্ষও সিএসপিদের একাধিপত্য ও প্রাধান্যকে সুনজরে দেখেনি। এই কারণে অন্যান্য ক্যাডারের সদস্যদেরও সরকারের উচ্চতর পদে, বিশেষ করে সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং যুগ্ম সচিব পর্যায়ে নিয়োগের সুযোগ করে প্রশাসনিক পরিবর্তন আনা হয়। প্রথমে যোগ্যতার ভিত্তিতে অন্যান্য সার্ভিস ক্যাডারের সদস্যরা এই সব পদে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োজিত হন। পরে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) নামে একটি অভিন্ন ক্যাডার সৃষ্টি করে এর অধীনে ২৯টি সাব-ক্যাডার সৃষ্টি করা হয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভিত্তিতে এইসব সাব-ক্যাডারে অন্তভর্ুক্তির বিধান রাখা হয়। এই পদক্ষেপ প্রশাসনে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বেশ স্বচ্ছতা নিয়ে আসে। সাবেক পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের বিভিন্ন ক্যাডারের সদস্যরা এইসব সাব-ক্যাডারের অন্তভর্ুক্ত হয়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ পদে এবং পদোন্নতি পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা সমতা এসে যায়। এ সত্ত্বেও কোনো সাব-ক্যাডারের কত জন সদস্য সচিব, অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্ম সচিব হবেন, এই বিষয় নিয়ে কলহ এবং মতদ্বৈততা অব্যাহত থাকে।

তিন.

রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভের মধ্যে অবশ্যই সংসদ ওপরে; কেননা সেখানে জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করেন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। সরকারের জবাবদিহিতা এই সংসদের কাছেই। আর আইনের শাসন নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখে বিচার বিভাগ। যেহেতু সংসদে জনপ্রতিনিধিরাই নির্বাচিত হয়ে আসন গ্রহণ এবং সরকার গঠন করেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যরা সেই জন্য রাষ্ট্রের সার্বিক পরিচালনার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের ওপরই বর্তায়। তারাই আইন প্রণয়ন করেন এবং দৈনন্দিন জীবনের নানা বিষয়সহ উন্নয়নের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। কিন্তু এই কাজে তাদের সহায়তা করে আমলারা। রাজনীতিবিদরা যত অভিজ্ঞ হবেন, সরকার পরিচালনার বিষয়ে যত বেশি সময় দিতে পারবেন আমলাদের ওপর কতর্ৃত্ব সেই পরিমাণে বেশি হবে। নীতিনির্ধারণে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের ভূমিকাই হবে প্রধান। এর ব্যত্যয় ঘটলে আমলাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং প্রকারান্তরে তারাই সরকার পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা নিয়ে নেবে। পাকিস্তানে এমন হয়েছে। বাংলাদেশেও এমন হয়েছে কয়েকটি কারণে। প্রথমত, দেশ স্বাধীন হবার পরপর পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের জন্য রাজনীতিবিদদের এত ব্যস্ত থাকতে হয়েছে যে, তারা দৈনন্দিন ভিত্তিতে সরকার পরিচালনার বিষয়ে বেশি সময় দিতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতায় বহু বছর না থাকায় এবং সরকার পরিচালনায় কৌশল ও দক্ষতা না থাকার জন্য তাদেরকে আমলাদের ওপরই নির্ভরশীল হতে হয়েছে। তৃতীয়ত, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জনের আগেই রাজনীতিবিদদের ক্ষমতাচু্যত করেছে সামরিক বাহিনীর উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তারা। তাদের সঙ্গে কিছু আমলাও ক্ষমতাচু্যতির ক্ষেত্রে জড়িত ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সামরিক শাসন একবার নয়, দুইবার এসেছে বাংলাদেশে_১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত এবং ১৯৮২ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ স্বাধীনতার ঊনচলিস্নশ বছরের মধ্যে ষোল বছরই বাংলাদেশ রাষ্ট্র ছিল সামরিক শাসনের অধীন। এই সময় শুধু সামরিক কর্মকর্তারা নয়, আমলারাও সরকার পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা তাদের করার কথা ছিল না। যেহেতু সামরিক কর্মকর্তারাও একশ্রেণীর আমলা সেই জন্য সিভিলিয়ান আমলারা তাদের সঙ্গে অথবা অধীনে কাজ করে স্বস্তি পেয়েছে এমন মনে করা যায়।

প্রশ্ন হলো, সরকার যদি জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা দক্ষতার সঙ্গে সঠিকভাবে পরিচালিত হতো, তাহলে কি সামরিক হস্তক্ষেপ ও তাদের ক্ষমতা গ্রহণ সম্ভব হতো? এর সোজাসুজি উত্তর দেয়া কঠিন। রাজনীতিবিদদের অধীনে সরকার পরিচালনায় অস্থিরতা ছিল, বিভিন্ন স্বার্থবিশিষ্ট শ্রেণীর মধ্যে তারা আপোসের ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি বরং কোনো কোনো শ্রেণীর বিরাগভাজন হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সূচনা করেছে। এই সব জটিলতা ও দুনর্ীতির অভিযোগ এনে সামরিক শাসন প্রবর্তন করা হয়েছে। বিচারপতি সাত্তার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হয়েও পদত্যাগ করে ক্ষমতা তুলে দেন সামরিক কতর্ৃপক্ষের কাছে। যদি আমলারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক সরকারকে সমর্থন করার জন্য সঠিক পরামর্শ দিত এবং রাজনীতিবিদদের সময়মতো অবহিত করতো তাহলে রাজনীতিবিদদের যত দুর্বলতা আর ত্রুটিই থাক না, তারা এভাবে ক্ষমতাচু্যত হতেন না। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারের হত্যার কথাটি ধরা যাক। এত বড় একটা ষড়যন্ত্র হলো, এতজন সামরিক কর্মকর্তা ও সদস্য এবং কিছু বেসামরিক ব্যক্তি (রাজনীতিবিদসহ) এত দীর্ঘ সময় ধরে এই হত্যার পরিকল্পনা করল সে সম্বন্ধে দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাদের (এনএসআই, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত সংস্থা) কেউই কিছু বলতে পারল না। এটা তাদের অদক্ষতা ছাড়া আর কিছু না। অন্যদিকে বিদেশ থেকে যে কোটি কোটি ডলারের ত্রাণসামগ্রী এল সেসব যে যোগ্য লোকের কাছে পেঁৗছাল না, তার দায়ভারও অনেকটা আমলাদের ওপরে পড়ে। আসলে সেই প্রথম কয়েক বছর যা হয়েছে তা হলো_স্বাধীন দেশে উন্নতির সুযোগ খুলে যাওয়ায় আমলারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েই বেশি ভেবেছেন এবং দৌড়াদৌড়ি করেছেন। কে কোন মন্ত্রণালয়ের সচিব হবেন, কে রাষ্ট্রদূত হবেন, কে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ যাবেন, কে পদোন্নতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত হবেন, এসব চিন্তাতেই মগ্ন ছিলেন অধিকাংশ আমলা। তারা রাজনীতিবিদদের পেছনে ও আশপাশে ঘুরেছেন নিজেদের স্বার্থে, রাষ্ট্রের বা সে সময়ের সরকারের স্বার্থে অতটা নয়, এই উপসংহারে এলে ভুল হবে না।

সরকারের পক্ষ থেকে একটা দক্ষ, অনুগত (দেশের প্রতি নয়, রাষ্ট্রের প্রতি) এবং ঐক্যবদ্ধ সিভিল সার্ভিস গড়ে তোলা হলে সরকার পরিচালনায় (রাষ্ট্র পরিচালনায়ও বটে) এমন বিপর্যয় ঘটত না।

চার.

১৯৭৫ সালের আগে সরকারকে শক্তিশালী করার জন্য প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি তা নয়। তবে সেসব খুব ফলপ্রসূ হয়নি। নিচে সেইসব উদ্যোগের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে (২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১) সিভিল প্রশাসন পুনর্গঠন কমিটি গঠন করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল মাঠপর্যায়ে ভেঙে-পড়া প্রশাসন পুনর্গঠনের সুপারিশ দেয়া, পাকিস্তান সরকারের অধীনে কর্মরত সিভিল অফিসারদের বাংলাদেশ সরকারের কাঠামোতে আত্মীকৃত করা, প্রশাসনিক পুনর্গঠনের জন্য অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা। এই কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে ২০টি মন্ত্রণালয় এবং তাদের অধীনে ডিভিশন সৃষ্টি করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি গঠিত হয় এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে, কেননা তখন সংবিধান প্রণীত হয়নি।

১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যকে সভাপতি করে গঠন করা হয় চার সদস্যের প্রশাসনিক ও সার্ভিস পুনর্গঠন কমিটি। এই কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয় বিদ্যমান সিভিল পরীক্ষা করে সুপারিশ রাখা, সকল সিভিল সার্ভিসকে একটি অভিন্ন সার্ভিসে একীভূত করা যায় কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা এবং বিভিন্ন সার্ভিসের কর্মকর্তাদের পারস্পরিক জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা, বিভিন্ন পর্যায়ে ও বিভাগে সরকার কর্মকর্তা রিক্রুটের নীতিমালা ও পদ্ধতি নির্ধারণ করা ইত্যাদি। এই সব বিষয়ে কমিটি যথাসময়ে সুপারিশ দিলেও সেসবের মধ্যে অনেকই বাস্তবায়িত হয়নি। সার্ভিস ক্যাডারগুলোর মধ্যে কলহ ও বিরোধিতার জন্যই এমন হয়েছিল বলে অনেকের ধারণা। তা ছাড়া ১৯৭৪ সালের পর থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে ঠাণ্ডা মাথায় প্রশাসনিক সংস্কার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব ছিল না।

১৯৭৫ সালের আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক শাসক হয়ে পে অ্যান্ড সার্ভিসের কমিশন গঠন করেন ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। কমিশনকে সিভিল প্রশাসনের কাঠামো এবং সেখানে যে বেতন-ভাতা দেয়ার নিয়ম রয়েছে, তা পরীক্ষা করে দেখে সুপারিশ রাখতে বলা হয়। সাবেক কেন্দ্রীয় সরকারের এবং প্রাদেশিক সরকারের আমলাদের একীভূত করা এবং নতুন কর্মকর্তাদের নিয়োগের জন্য পদ্ধতি নির্ধারণের দায়িত্বও দেয়া হয় এই কমিশনকে। কমিশন এই সব বিষয়ে যে সুপারিশ রাখে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণগুলো বাস্তবায়ন করতে দুই বছরের বেশি সময় নেয়। পাঁচটি মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়, যা ছিল সময়সাপেক্ষ। সুপারিশের ভিত্তিতে ১৪টি মূল ক্যাডারের অধীনে ২৮টি সার্ভিস ক্যাডার সৃষ্টি করা হয়। বেতন-ভাতা সম্পর্কে সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার ২১টি পে-স্কেল অনুমোদন করে। এই সিদ্ধান্ত বেশির ভাগ আমলারাই মনোপূত হয়নি এবং তারা নানাভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। কমিশন সিনিয়র সার্ভিস পুল সৃষ্টির যে সুপারিশ করে, সরকার তা গ্রহণ করে। কিন্তু এর বাস্তবায়নে জটিলতা দেখা দেয় এবং সিদ্ধান্তটি প্রায় অবাস্তবায়িত থেকে যায়।

উপরে যেসব প্রশাসনিক সংস্কারের উলেস্নখ করা হলো, তাদের প্রধান উদ্দেশ্যেই ছিল সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের জন্য একটি উপযোগী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা এবং আমলাদের মধ্যে রেষারেষি ও কলহ বন্ধ করে সংহতি সৃষ্টি করা। এই উদ্দেশ্য আংশিক সফল হয়েছিল_এ কথা বলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, সার্ভিস কাঠামো, বেতন-ভাতা, মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা নির্ধারণ_এইসব বিষয়ের বাইরে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল জনসাধারণের কল্যাণ বৃদ্ধির সার্ভিস ডেলিভারি উন্নত করা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করা, সেদিকে তেমন মনোযোগ দেয়া হয়নি। ফলে গতানুগতিকভাবেই সরকার পরিচালিত হয়েছে। দ্বিতীয়, সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এসে সরকারের কার্যক্রম বিকেন্দ্রীভূত করে উপজেলা পদ্ধতির প্রচলন করলেন, যা সরকার পরিচালনায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। সরকারের অনেক দফতরের অনেক কার্যক্রম মাঠপর্যায়ে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল, যা সাধারণ মানুষের উপকারে এসেছিল। দুঃখের বিষয় জেনারেল এরশাদ নিজেই রাজনৈতিক স্বার্থে উপজেলা পদ্ধতিতে বড় পরিবর্তন আনেন, যা একে দুর্বল করে দেয়। জেনারেল এরশাদের সময় প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিল সরকারকে সংকুচিত করে আনা এবং পাবলিক সেক্টরে অপ্রয়োজনীয় জনবল হ্রাস করা। এটিও প্রশংসনীয় উদ্যোগ ছিল।

১৯৮৪ সালে একজন ভাইস চ্যান্সেলরের সভাপতিত্বে একটি পে কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন তাদের সুপারিশে আমলাদের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন বেতন উলেস্নখ করে ২০টি গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করে। সরকার কিছুটা সংশোধন করে কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে। ১৯৮৯ সালে আবার আর একটি পে কমিশন গঠন করে সকল পর্যায়ে এবং পাবলিক সেক্টরের সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বাস্তবানুগ বেতন কাঠামো সুপারিশ করতে বলা হয়। এবারো কমিশন ২০টি গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করে সুপারিশ করে। প্রেসিডেন্ট এরশাদের সময়ে প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটি কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে ছিল সেক্রেটারি কমিটি, স্পেশাল কমিটি, কেবিনেট সাব কমিটি, কাউন্সিল কমিটি ইত্যাদি। প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের জন্য জাতীয় পর্যায়ের বাস্তবায়ন কমিটি (নিকার)। সামরিক শাসক হলেও প্রেসিডেন্ট এরশাদই প্রশাসনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংস্কার আনার উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি কমিশন ও কমিটি গঠন করেন। এদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়নি।

বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৩ সালে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস কমিটি গঠন করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল মন্ত্রণালয় পর্যায়ে প্রশাসনিক কাঠামো এবং জনবল নিয়োগ নির্ধারণ এবং প্রশাসনের ওপর সেসব নতুন দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তার প্রেক্ষিতে প্রশাসনিক কাঠামোর পুনর্গঠন বিষয়ে সুপারিশ রাখা। এই কমিটি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস গঠন করে ২৯টি সাব ক্যাডার গঠনের সুপারিশ করে এবং বিদ্যমান কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিধিবিধান নির্ধারণ করে। কমিটির সুপারিশে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা হ্রাস করে জনবল কমিয়ে আনার প্রস্তাবও ছিল। একজন গবেষকের মতে, খালেদা জিয়া প্রশাসনিক সংস্কারে আগ্রহী ছিলেন না। তার সময়ে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় যেসব পদোন্নতি দেয় তার অনেকগুলিই বিতর্কিত ছিল। জনপ্রশাসনে রাজনৈতিক আনুগত্য প্রাধান্য পেতে শুরু করে (মোহাম্মদ মোহাব্বত খান : বাংলাদেশে প্রশাসনিক সংস্কার, ১৯৯৮)।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার জাতীয় পে কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন আগের ২০ গ্রেডের বেতন-ভাতা অক্ষুণ্ন রাখে তবে বেতনে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে জীবনধারণের মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগের শাসনকালেও (১৯৯৫-২০০১) একটি প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিশনকে পরবতর্ী সকল কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা করে সমন্বিত সুপারিশ রাখতে বলা হয়। এই কমিশন প্রথাগতভাবে প্রশাসনিক কাঠামো ও সার্ভিস ক্যাডার নির্ধারণ করে নিয়োগ পদোন্নতি ইত্যাদি বিষয়ে সুপারিশ রাখা ছাড়াও জনসেবার মান উন্নত করার জন্য সুপারিশ রাখে। এইসব সুপারিশ খুব বেশি বাস্তবায়িত হয়নি। এই সময়ে প্রশাসনে রাজনীতির অনুপ্রবেশ আরো স্পষ্ট হয়। জনতার মঞ্চে অংশগ্রহণকারী আমলারা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত হন। তবে এই সময় বিরোধীদলীয় মনোভাবাপন্ন বলে কোনো আমলাকে অবসরে পাঠানো অথবা ওএসডি করার ঘটনা তেমন ঘটেনি। ২০০১ সালে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসার পর (২০০১-২০০৬) প্রায় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েই প্রশাসনে আওয়ামী লীগ মনোভাবাপন্নদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং নিজেদের অনুগত আমলাদের দ্রুত পদোন্নতি দেয়া থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করে। এই সময় পাবলিক সার্ভিস কমিশনও তার স্বাধীনতা হারায় এবং দলীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্যরা দলের সমর্থক প্রাথর্ীদের বেশি করে নিয়োগদান করে। ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ প্রশাসনে রাজনীতিকরণ আরো ব্যাপক ও তীব্র করে। তারাও পাবলিক সার্ভিস কমিশনে নিজেদের সমর্থকদের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দলীয় প্রাথর্ীদের বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেয়।



ভবিষ্যতে কী হবে?

ভবিষ্যতে প্রশাসনের রাজনীতিকরণ অব্যাহত থাকবে বলে ধরে নেয়া যায়। এর ফলে যখন যে দল ক্ষমতায় আসবে তাদের সমর্থক আমলারা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাবে এবং তাদের দ্রুত পদোন্নতি হবে। ফলে যোগ্যতা, দক্ষতা এবং সাধুতা খুব একটা বিবেচনায় নেয়া হবে না। এর ফলে সরকারের দক্ষতা হ্রাস পাবে। আমলারা দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজ করবে। এই কারণে দুর্নীতি ও অনিয়ম আরো তীব্র হবার সম্ভাবনা থাকবে। কেননা রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক স্তরের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা, নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করতে উদ্বুদ্ধ করবে। জনসেবার সিংহভাগ যাবে দলীয় সমর্থক এবং কর্মী-নেতাদের ভোগে। আইনের শাসন আরো দুর্বল হয়ে আসবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় আমলাদের দোষ-ত্রুটি হবে। এক কথায় ভবিষ্যতে প্রশাসনে নিরপেক্ষ এবং আগত উৎকর্ষ ক্ষুণ্ন হবে এবং প্রশাসনের মাধ্যমে জনসেবা প্রদানের মানে অবনতি দেখা যাবে। স্থানীয় সরকার আরো দুর্বল হয়ে পড়বে এবং সংসদে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

প্রশাসন সরকার পরিচালনার চালিকাশক্তি। রাজনীতিকরণ হয়ে গেলে প্রশাসন শুধু দুর্বল হয়ে পড়বে না, জনস্বার্থও বিঘি্নত হবে। জনস্বার্থের কথা ভেবে যদি সকল রাজনৈতিক দল ঐকমত্যে পেঁৗছায় এবং প্রশাসনকে রাজনীতির ঊধের্্ব রাখে তাহলে ভবিষ্যতের যে অন্ধকার চিত্র দেয়া হলো তার পরিবর্তন হতে পারে। যদি ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব হয় তাহলে প্রশাসনে যোগ্য ও দক্ষ আমলারা যোগ দেবে এবং তাদের মাধ্যমে জনস্বার্থ শুধু রক্ষা না, এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হবে। এই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন সম্পূর্ণই নির্ভর করছে রাজনৈতিক ইচ্ছার ওপর।

No comments:

Post a Comment