Sunday, January 16, 2011

বিশ্বজুড়ে খাদ্যমন্দা, দেশে দ্রুত আমদানির পরামর্শ

বিশ্ববাজারে আবারও খাদ্যমন্দার পদধ্বনি। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সম্প্রতি ‘খাদ্য পূর্বাভাস’ নামের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় এবার ৬ শতাংশ কম খাদ্যপণ্য বিশ্ববাজারে আসবে। আর সরবরাহ কমায় এরই মধ্যে খাদ্যের দাম ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে।

এফএও প্রতিবেদনে আরও বলেছে, খাদ্যমূল্য বাড়ায় বাংলাদেশসহ ৭৭টি খাদ্য ভর্তুকির দেশকে অতিরিক্ত ১২ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা গুনতে হবে। বাংলাদেশের খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এবার খাদ্য ভর্তুকিতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আরও এক হাজার কোটি টাকার বেশি প্রয়োজন হবে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে সরকারকে খাদ্য মজুদ দ্রুত বাড়াতে হবে। নয়তো তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি প্রায় ৩০ ডলার বৃদ্ধির প্রভাবে পর্যায়ক্রমে সার ও খাদ্যের দাম আরও বাড়বে। তখন আমদানি করা আরও কঠিন হয়ে যাবে।
খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ধাক্কা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লাগতেও শুরু করেছে। আলজেরিয়া, মোজাম্বিক, হাইতি, তিউনিসিয়াসহ বিশ্বের আটটি দেশে খাদ্য নিয়ে দাঙ্গা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট জয়নুল আবেদিন বেন আলী জনবিক্ষোভের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে সৌদি আরবে আশ্রয় নিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক এক বিবৃতিতে হঠাৎ করে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এ পরিস্থিতি বিশ্বের স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির জন্য হুমকি।
এফএওর প্রতিবেদনে বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে চাল-গম উৎপাদন প্রায় ৪ শতাংশ বাড়বে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, উৎপাদন বাড়লেও বাংলাদেশসহ বিশ্বের স্বল্পোন্নত ৭০টি দেশকে খাদ্য আমদানি করতে হয়। এই দেশগুলোর বেশির ভাগ মানুষ তাদের আয়ের ৭০ শতাংশ খাদ্য কিনতে ব্যয় করে। দাম বাড়ায় এই গরিব মানুষগুলোই সবচেয়ে সমস্যার মধ্যে পড়বে।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ মাহবুব হোসেন এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ দেখা দেবে। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম সামনের দিনে আরও বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে দ্রুত মজুদ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ২০০৭-০৮-এর খাদ্যসংকট পরিস্থিতির যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে জন্য এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি আমদানিকারকেরা খাদ্য আমদানি করতে রাজি হবেন না মন্তব্য করে মাহবুব হোসেন বলেন, সে ক্ষেত্রে সরকারকে আমদানি বাড়াতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে খাদ্য আনতে হবে।
সরকারের খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন ইউনিটের (এফপিএমইউ) হিসাবে আমন, আউশ ও বোরো মৌসুমে তিন কোটি ৪০ লাখ টন চাল ও ১০ লাখ টন গম উৎপাদিত হবে। এপ্রিল পর্যন্ত দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ৬০ লাখ মানুষের জন্য কম দামে খাদ্য সরবরাহ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
খাদ্য আমদানি পরিস্থিতি: চলতি বছরের বাজেটে মোট ২৮ লাখ টন খাদ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে সরকার। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১২ লাখ টন চাল সংগ্রহ ও ১৬ লাখ টন আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ পরবর্তী দফায় আমদানি লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ২০ লাখ টন করা হয়। সম্প্রতি তা আরও বাড়িয়ে ২২ লাখ টন করা হয়েছে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ১২ লাখ ৭০ হাজার টন চাল-গম আমদানির চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে তিন লাখ টন চাল ও দুই লাখ টন গম সরকারি গুদামে এসেছে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে বর্তমানে আরও আড়াই লাখ টন চাল-গম খালাস হচ্ছে। ভিয়েতনামের সঙ্গে আড়াই লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত হওয়ার পর তার প্রায় অর্ধেক বাংলাদেশে চলে এসেছে।
গত নভেম্বর মাসে খাদ্যসচিব বরুন দেব মিত্রের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ভারত সরকারের সঙ্গে পাঁচ লাখ টন চাল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কেনার জন্য সমঝোতা চুক্তি করে। এই চাল গত ডিসেম্বরের মধ্যেই দেশে আসার কথা ছিল। খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ভারত প্রতি টন চালের দাম বাংলাদেশি টাকায় ৩২ হাজার টাকা চাইছে। কিন্তু শর্ত দিচ্ছে, সেখানকার গুদাম থেকে চাল নিজ দায়িত্বে বাংলাদেশে আনতে হবে। অনেক দেনদরবারের পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভারত যদি সেখানকার বন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, তাতে বাংলাদেশ রাজি আছে। এই শর্তেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ রাজি না হওয়ায় এখনো আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে।
খাদ্য বিভাগের মহাপরিচালক আহমদ হোসেন এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ভারত থেকে কেনার পাশাপাশি বাংলাদেশ ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চাল আমদানির ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে। সময়মতো চাল আসার ব্যাপারে নিশ্চয়তাও পাওয়া গেছে।
এদিকে, লন্ডনভিত্তিক সংস্থা জ্যাকসন সন অ্যান্ড কোং এবং থাই ডিপার্টমেন্ট অব ফরেইন ট্রেডের হিসাবে, বাংলাদেশে প্রধান চাল রপ্তানিকারক দেশ থাইল্যান্ডে চালের দাম তিন মাস ধরে স্থিতিশীল আছে। আগামী চার মাসের মধ্যে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই বলেও সংস্থা দুটি মনে করছে।
গত চার মাসে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে চালের দাম প্রতি টন ৪২৫ থেকে ৪৭৫ ডলারে ওঠানামা করছে। পরিবহন খরচ যোগ হওয়ায় বাংলাদেশে প্রতি কেজি চালের দাম পড়ছে ৩৭ থেকে ৩৮ টাকা। চলতি জানুয়ারি মাসে তা প্রায় ২০ থেকে ৪০ ডলার পর্যন্ত বেড়েছে। এখন আমদানি করলে চালের কেজি ৪০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। দেশে মোটা চালের দাম এখনো ৪০ টাকার নিচে থাকায় আমদানি কমে গেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে চালের দাম ৪৫০ ডলার থেকে বেড়ে ৯০০ ডলার হয়েছে। তবে এই চালের বেশির ভাগ ক্রেতা ইউরোপের দেশগুলো।
বেসরকারি আমদানি কমেছে: এফপিএমইউ সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে আমদানি কমে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে বছরে ১০ থেকে ১৫ লাখ টন এবং দুর্যোগের বছর ২০ থেকে ৩০ লাখ টন আমদানি হয়ে থাকে। গত ডিসেম্বরে দেশে পাঁচ লাখ ৬৭ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে, যার ৬৫ শতাংশ সরকার আমদানি করেছে। গম আমদানি হয়েছে ১৭ লাখ ৪৮ হাজার টন। বেসরকারি খাত থেকে এসেছে এর ৮৪ শতাংশ। রাশিয়ায় খরার কারণে গম রপ্তানি নিষিদ্ধ ও দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার বুলগেরিয়া ও ইরান থেকে গম আমদানি শুরু করেছে।
জানা গেছে, পূবালী, দেশবন্ধু, সানফ্লাওয়ার, হানিবি, এস আলম, এল এম জে ও মাহবুব ব্রাদার্স নামের ১০টি প্রতিষ্ঠান সরকারকে নয় লাখ টন গম সরবরাহ করবে বলে চুক্তিবদ্ধ হয়। কিন্তু বিশ্ববাজারে গমের দাম ৬০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে গম দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে খাদ্য বিভাগ ওই ১০ প্রতিষ্ঠানের ৫৩ কোটি টাকার পিজি ও বিডবন্ড বাজেয়াপ্ত করেছে।
তেলের প্রভাব খাদ্যে: জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বিশ্বের ৫৫টি খাদ্যপণ্যের দাম পর্যবেক্ষণ করে গত ৬ জানুয়ারি পূর্বাভাস দিয়ে বলছে, গত জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্বে খাদ্যের দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে। চীনের খাদ্য চাহিদা বেড়ে যাওয়া ও রাশিয়ায় স্মরণকালের ভয়াবহতম দাবানলের কারণে খাদ্যের দাম বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের পণ্যমূল্য পর্যবেক্ষণ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সারের দাম আবারও বাড়তে শুরু করেছে। গত এক বছরের মধ্যে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৬১ ডলার থেকে বেড়ে ৯০ ডলার হয়েছে। এর প্রভাবে সারের দামও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। যেমন, ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সারের দাম গত এক বছরের মধ্যে ৩১৬ ডলার থেকে বেড়ে ৫৯৩ ডলার, ট্রিপল সুপার ফসফেট ২৩৫ ডলার থেকে বেড়ে ৪৭২ ডলার ও ইউরিয়া ২৪৮ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৭৫ ডলার হয়েছে।
৭০ শতাংশ উৎপাদন বাড়াতে হবে: এফএওর প্রতিবেদনে সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ আবদলরেজা আব্বাসিয়ান বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে উল্লেখ করে বলেছেন, সংকট বাড়ায় ২০০৮ সালে বাংলাদেশ, মিসর ও হাইতির মতো বিশ্বের ৩০টি দেশ হুমকির মুখে পড়েছিল। খাদ্যপণ্যের বাজার আগের মতো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
খাদ্যপণ্যের সংকট মোকাবিলায় এফএও বলেছে, বিশ্বের বর্তমান জনসংখ্যা ৬৮০ কোটি ২০৫০ সাল নাগাদ ৯১০ কোটিতে পরিণত হবে। বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে খাদ্য উৎপাদন বর্তমান সময়ের তুলনায় ৭০ শতাংশ বাড়াতে হবে।

No comments:

Post a Comment