Sunday, January 30, 2011

শেয়ারবাজার ধসের সংকেত দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক

দেশের শেয়ারবাজারে বড় বিপর্যয়ের সংকেত দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রায় এক বছর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের কাছে তাদের একটি প্রতিবেদন তুলে ধরে পরিষ্কার করে যে, বাজার কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট এসইসি, ডিএসই ও গবেষকদের কয়েকজনকে ডেকে এনে একটি নির্বাহী সেমিনারে গবেষণা সমীক্ষাপত্রের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে। এ সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজার বিপর্যয় পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের বাজার বিশ্লেষণ করা হয়। এর পরপরই ব্যাংক খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি, মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে।
গবেষণায় বিশ্বের উন্নত কয়েকটি দেশের শেয়ারবাজার, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বাজার এবং বাংলাদেশে ’৯৬ সালে বাজার বিপর্যয়ের সঙ্গে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত ও পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখানো হয়, পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগকারীর লভ্যাংশ আয় ও মূল্য পরিস্থিতির মধ্যে যে ব্যবধান তা কতটা বেড়েছে এবং ব্যবধানের কোন পর্যায়ে বিভিন্ন দেশে ও বাংলাদেশে ’৯৬ সালে বাজার পতন হয়েছে।
সেমিনারে এসইসি ও ডিএসইর দিক থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি বলতে চাইছে যে, দেশের শেয়ারবাজার বিপর্যয়ের পর্যায়ে (বাবলস) উপনীত হয়েছে। জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর (ডিজি) জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা বাবলস আছে কি না সেটা বলছি না, এটা বলবেন বাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আমরা শুধু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজার যে পর্যায়ে বাবলস তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে ডিএসইর পরিস্থিতি লেখচিত্রে উপস্থাপন করেছি।’
গবেষকদের কাছে প্রশ্ন তোলা হয়, ’৯৬ আর আজকের বাজার তো এক নয়। জবাবে গবেষকদের তত্ত্বাবধায়ক আহসান হাবীব মনসুর বলেন, ‘বাজারের কতগুলো মৌলিক দিক (মার্কেট ফান্ডামেন্টাল) বিশ্বের সব দেশে এবং সব সময়ের জন্য একই।’
গবেষণা অনুযায়ী, প্রদর্শিত সব কটি দেশ ও ’৯৬ সালে বাংলাদেশে বাজার ধসের পরিস্থিতির তুলনায় ২০০৯ সালের নভেম্বরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্য পরিস্থিতি অনেক বেশি তীক্ষভাবে বাড়তে শুরু করে এবং এ সময় শেয়ারের বিপরীতে লভ্যাংশ আয় ও মূল্য আয় অনুপাত (পিই) এবং মূল্যসূচকের ব্যবধান ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি গভর্নর আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সেমিনারে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি), ডিএসই, সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি অংশ নেয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাসিরউদ্দিন আহমেদ, এসইসির তৎকালীন সদস্য মনসুর আলম, নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ আহমেদ, পরিচালক হাসান মাহমুদ, ডিএসইর তৎকালীন সহসভাপতি ও বর্তমান সভাপতি শাকিল রিজভী, নির্বাহী আফজালুর রহমান, সিপিডির তারিকুল ইসলাম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণাসহ নীতিনির্ধারণী কয়েকটি বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান হাবীব মনসুরের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক আবদুল ওয়াহাব ও সহকারী পরিচালক ওমর ফারুক এই গবেষণা সমীক্ষাটি তৈরি করেন।
এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি শুধু বলব গবেষণাপত্রে পরিষ্কার একটা দিকনির্দেশনা ছিল। আর বাংলাদেশ ব্যাংক সেই বার্তাটি এসইসি ও ডিএসইর কাছে পৌঁছে দিয়েছে।’ কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই গবেষণার দিকনির্দেশনাটি পরবর্তী সময়ে অনুসরণ করেছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপগুলো দেখলেই তার মধ্যে পরিষ্কার জবাব পাওয়া যাবে।’
এ বিষয়ে এসইসি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের এই গবেষণা ধরে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপও নিয়েছি।’ তবে তিনি বলেন, এর আগ থেকেই বাজার সামাল দিতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জানুয়ারি মাসে এসে এসইসি বিনিয়োগকারীদের সচেতন বা সতর্ক করতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনও ছাপে বলে জানান চেয়ারম্যান।
গবেষণার কিছু দিক: গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজার বিপর্যয়ের আগে একটা বড় উত্থান হয়। যেমনটি হয়েছে ’৯৬ সালে বাংলাদেশের বাজারে। একই পরিস্থিতি পাওয়া যায় জাপানের নিক্কি, চীনের সাংহাই, আমেরিকার ন্যাসডাক, ভারতের বোম্বে-সেনসেক্স, হংকংয়ের হ্যাংসেং, শ্রীলঙ্কার কলম্বো ও সৌদি আরবের তাসি মূল্যসূচকে। বাংলাদেশে ডিএসইর ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সূচক উত্থানকে গবেষণায় বিবেচনা করা হয়। তার আগের দুই বছরের সূচক পর্যালোচনাও ছিল এতে।
২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ৫৭৪৫ দশমিক ৭৮, ডিএসআই সূচক ছিল ৪৭০০ দশমিক ৮৭ আর ডিএসই-২০ সূচক ছিল ৩১৩৪ দশমিক ৩৫। এ সময় বাজারের মূল্য আয় অনুপাত ছিল ৩০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। অন্যদিকে লভ্যাংশ আয় ছিল ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজার ধসে পড়ার সময় লভ্যাংশ আয় ও বাজারের মূল্যস্তরের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হওয়ার উপাত্ত মেলে। এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের উত্থানের হার বেশি থাকায় বড় ঝুঁকির সংকেত পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০০৯ সালের আগস্ট থেকে একটা বড় ধরনের উত্থান ছিল বাজারে। এ সময় বাজারের উত্থান সামলে নেওয়া হয় গ্রামীণফোনের বড় একটা আইপিও দিয়ে। ওই সময় বাজার থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বের হয়ে পড়ে। আবার নতুন শেয়ার যুক্ত হলে সামলে ওঠে বাজার। কিন্তু ডিএসই ভুলভাবে সূচক হিসাব করায় প্রকৃত বাজারের চিত্র এতে প্রকাশ পায়নি।
গ্রামীণফোনের শেয়ার লেনদেন শুরু হওয়ার পর বাজারে আবারও একটা দ্রুত বৃদ্ধি দেখা যায়। গবেষণায় দেখানো হয়, এমনকি ডিএসই সঠিকভাবে সূচক হিসাব করলেও উত্থান ছিল দ্রুত ও তীক্ষ। এই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। এ সময় বাজারের মৌলশক্তি ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ে এবং লভ্যাংশ আয়ের সঙ্গে মূল্য পরিস্থিতির মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হয়।
বিভিন্ন দেশে বাজার বিপর্যয়ের সময় সেখানে বাজার পিইর সঙ্গে লভ্যাংশ আয়ের তুলনা করা হয় গবেষণায়। এতে দেখা যায়, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডিএসইর পিই সর্বাধিক ৩০ দশমিক ৬-তে ওঠে। তখন লভ্যাংশ আয়ের হার হয় ১ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে বাজার বিপর্যয়ের সময় বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের পিই ছিল ২০ দশমিক ৩ (জানুযারি ’০৮) ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল ১ দশমিক ৩ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় (সেপ্টেম্বর ’০৭) পিই ছিল ১৪ দশমিক ৪৪ ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ। জাপানে বাজার (ডিসেম্বর ’৮৯) বিপর্যয়ের সময় পিই ছিল ৩৯ দশমিক ৮ ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। চীনে (অক্টোবর ’০৭) পিই ছিল ১৮ দশমিক ৩ ও লভ্যাংশ আয় ছিল ২ দশমিক ৭ শতাংশ, সৌদি আরবের (ফেব্রুয়ারি ’০৬) পিই ৪৭ দশমিক ৩ ও আয় ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ইউএসএর ন্যাসডাক (মার্চ ২০০০) স্টক এক্সচেঞ্জের পিই ছিল ৩৫ দশমিক ৪ ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।
পরবর্তী পরিস্থিতি: ডিএসইর বাজারে ফেব্রুয়ারির শেষে এসে লভ্যাংশ আয় কমে ও পিই বাড়ে। তবে জুনে গ্রামীণফোন লভ্যাংশ দিলে পিই কিছুটা কমে আসে। মার্চ-এপ্রিল মাসে মূল্যসূচক কিছুটা সংশোধনের মধ্যে ছিল। মধ্য মে পর্যন্ত ৫৫০০ সূচকের মধ্যে ওঠানামা করে বাজার। তারপর থেকে ওঠানামার মধ্য দিয়ে দ্রুত বেড়ে চলে বাজার। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে সূচক ৭৫০০ ছাড়িয়ে যায়। এ পর্যায়ে আবার তীক্ষ উত্থান শুরু হয়ে ৫ ডিসেম্বর ডিএসইর সাধারণ সূচক গিয়ে ঠেকে ৮৯১৮ দশমিক ৫১-তে। এরপরই ধসের কবলে পড়ে বাজার।
এ পরিস্থিতি সম্পর্কে গবেষক আবদুল ওয়াহাব বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ডিএসইর সূচকে এই বৃদ্ধি বাজারে মৌলশক্তির সঙ্গে যায় না। ফলে বাজারের উত্থানপ্রবণতা জানুয়ারির প্রথমভাগে বা ডিসেম্বরের শেষ সময়ে আর টেকসই হয়নি।’
আহসান হাবীব মনসুর গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুঁজি ও মুদ্রাবাজারের সব দিক নিয়েই এ গবেষণা করা হয়। আমরা এর মাধ্যমে পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়েছি বাজারে। বলেছি, “বাজার অতি মূল্যয়িত।” ধারণা করি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরবর্তী সময়ে তাদের দিক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।’
গবেষণা ধরে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে মতামত চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘গবেষণার ভিত্তিতে আমি তো মনে করি এখনো বাজার অতি মূল্যায়িত। কৃত্রিমভাবে বাজারকে সহায়তা দেওয়া কারও জন্যই শুভ হবে না।’

No comments:

Post a Comment