Sunday, January 30, 2011

বিক্ষোভে জ্বলছে মিসর, সংঘর্ষে নিহত ৭৪

প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে অব্যাহত বিক্ষোভে টালমাটাল হয়ে পড়েছে মিসর। গতকাল শনিবার বিক্ষোভের পঞ্চম দিনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছে। এ নিয়ে গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভে ৭৪ জন নিহত হলো।

গণবিক্ষোভের মুখে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়েছেন হোসনি মোবারক। গত শুক্রবার মধ্যরাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গতকাল মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন তিনি। তবে নিজে পদত্যাগ না করার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন মোবারক। বিক্ষোভকারীরা তাঁর এই উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, মোবারককে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। এই দাবিতে তারা গতকাল কারফিউ ভেঙে ব্যাপক বিক্ষোভ করে। এতে করে আরও বিপাকে পড়েছেন মোবারক।
বিক্ষোভের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট মোবারক (৮২) গতকাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে তিনি গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ওমর সুলাইমানের (৭৫) নাম ঘোষণা করেন। এরপর একটি নতুন সরকার গঠনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী আহমেদ শফিকের নাম ঘোষণা করেন। ১৯৮১ সালে মিসরের ক্ষমতা নেওয়ার পর এই প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে কাউকে নিয়োগ দিলেন মোবারক। ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করায় অনেকে ধারণা করছেন, মোবারক হয়তো ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এর আগে শুক্রবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট মোবারক বলেন, জ্বালাও-পোড়াও করে, ব্যক্তিগত বা সরকারি সম্পদ ধ্বংস করে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না। আলোচনা, সচেতনতা ও বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিক্ষোভকারীদের কষ্টের কারণ বুঝতে পারছি। কিন্তু কোনোভাবেই দেশকে অস্থিতিশীল হতে দিতে পারি না।’ বক্তব্যে তিনি মিসরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারেরও প্রতিশ্রুতি দেন।
মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারে গতকাল ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবনে ভাঙচুর চালাতে গেলে সেনারা বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় উভয় পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এর আগে রাফার সিনাই শহরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে তিনজন পুলিশ নিহত হয়। এ নিয়ে গত মঙ্গলবার থেকে মোট ৭৪ জন নিহত হলো। বিক্ষোভে আহত হয়েছে এক হাজারেরও বেশি মানুষ। কায়রো, আলেক্সান্দ্রিয়া ও সুয়েজ শহরে কারফিউয়ের সময় বাড়ানো হয়েছে।
এর আগে শুক্রবার বিক্ষোভ দমনে রাজপথে সেনাবাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট মোবারক। সেনাসদস্যরা ট্যাংক নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। প্রথমে বিক্ষোভকারীরা সেনাদের স্বাগত জানালেও পরে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারী মারজুক বলেন, ‘সেনাবাহিনী জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেনাসদস্যরা তাহরির স্কয়ারে এলে আমরা তাঁদের স্বাগত জানাই। কিন্তু খুব দ্রুতই তাঁরা দাঙ্গা পুলিশের মতো আচরণ করতে থাকেন। আমরা বাধ্য হয়ে তাঁদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ি।’
মধ্যরাতে প্রেসিডেন্ট মোবারকের সরকার ভেঙে দেওয়ার ঘোষণার পরও তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভ চলতে থাকে। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণাকে তামাশা বলে উল্লেখ করেন। একজন বিক্ষোভকারী বলেন, ‘শুধু সরকার ভেঙে দেওয়া নয়, প্রেসিডেন্ট মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছি আমরা।’ বিক্ষোভকারীদের স্লোগান ছিল, জনগণ প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ চায়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে টিয়ার গ্যাস শেল ও জলকামান ব্যবহার করে। বন্দরনগর ইসমাইলিয়াসহ বেশ কিছু এলাকায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
কায়রোতে গত শুক্রবার বিক্ষোভকারীদের দেওয়া আগুনে ক্ষমতাসীন দলের সদর দপ্তর গতকালও জ্বলতে দেখা যায়। কায়রোর মোহান্দিসেন জেলায় একটি স্বর্ণালংকারের দোকান ও একটি ব্যাংকে লুটপাট চালানোরও খবর পাওয়া গেছে। বিক্ষোভকারীরা মিসরের প্রায় ৬০ শতাংশ থানায় হামলা চালিয়েছে বলে জানা গেছে।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এক বিবৃতিতে গতকাল জানানো হয়, কায়রো, আলেক্সান্দ্রিয়া ও সুয়েজ শহরে স্থানীয় সময় বিকেল চারটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ করা হয়েছে। এর আগে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ ছিল।
প্রেসিডেন্ট মোবারকের ভাষণকে ‘হতাশাজনক’ উল্লেখ করেছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সাবেক প্রধান এলবারাদি। ফ্রান্স ২৪ টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শুধু ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা যথেষ্ট নয়। এতে করে বিক্ষোভ থামবে না। এলবারাদি বলেন, বিক্ষোভের মাধ্যমে দেওয়া জনগণের বার্তা প্রেসিডেন্ট মোবারক বুঝতে পারছেন না। মোবারকের পতন না হওয়া পর্যন্ত বিক্ষোভ চলবে। তিনি আরও বলেন, সরকার ভেঙে দেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য দায়িত্ব নিতে তিনি প্রস্তুত আছেন। এদিকে এলবারাদিকে গৃহবন্দী করা হয়েছে বলে একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
দেশটিতে নিষিদ্ধঘোষিত বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুড শান্তিপূর্ণভাবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
মিসরের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংস আচরণ না করতে মিসরের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। প্রেসিডেন্ট মোবারকের সঙ্গে টেলিফোনে ৩০ মিনিট কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তিনি রাজনৈতিক সংস্কারের পদক্ষেপ নিতেও প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। মিসরের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে একটি পক্ষ দেশটিতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে।
প্রেসিডেন্ট মোবারক প্রায় ৩০ বছর ধরে মিসরের ক্ষমতায় রয়েছেন। ‘এপ্রিল ৬ মুভমেন্ট’ নামের একটি সংগঠন দুর্নীতি, বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি।

No comments:

Post a Comment