Sunday, January 30, 2011

নতুন বিমানবন্দর কেন

দেশে বর্তমানে তিনটি আন্তর্জাতিক ও পাঁচটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর আছে। এসব বিমানবন্দরের কোনোটারই ধারণক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করা হয় না। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের বাইরে এখন কক্সবাজার বিমানবন্দরকেও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি দেশের প্রধান বিমানবন্দর। বছরে ৮০ লাখ যাত্রী পরিচালনক্ষমতা রয়েছে এই বিমানবন্দরের। তবে এখন ক্ষমতার অর্ধেকসংখ্যক যাত্রী এ বিমানবন্দর দিয়ে আসা-যাওয়া করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্যস্ত সময়ে ঘণ্টায় গড়ে ৬০টির মতো বিমান ওঠানামা করলে সেটি স্বাভাবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলা যায়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বর্তমানে ব্যস্ত সময়ে প্রতি ঘণ্টায় (পিক আওয়ারে) সর্বোচ্চ ১০টি বিমান ওঠানামা করে। এর মধ্যে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের ওঠানামাও যুক্ত। অর্থাৎ ঢাকায় বর্তমানের পাঁচ গুণ বিমান ওঠানামা এবং যাত্রীর পরিমাণ দ্বিগুণ হলেও এর জন্য হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরই যথেষ্ট। তা ছাড়া আধুনিকায়নের মাধ্যমে এ বিমানবন্দরের ক্ষমতা-দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ তো রয়েছেই।
এ অবস্থায় সরকার আরেকটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে এ বিমানবন্দর করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি তার জন্য আড়িয়ল বিলের মতো স্থানকে নির্বাচন করা নিয়েও সমালোচনা আছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও এমন কোনো অগ্রাধিকার প্রকল্পের অঙ্গীকার ছিল না।
অবশ্য বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, নতুন বিমানবন্দরটিকে সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ের মতো দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় বিমান চলাচলের পথে কেন্দ্রস্থলে (হাব) পরিণত করার চিন্তা আছে। এতে এ খাত থেকে দেশে প্রচুর রাজস্ব আসবে।
সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই-সমীক্ষা করা হয়নি। এর সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে সেখানে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সিটি’ নামের একটি উপশহর গড়ারও সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। প্রস্তাবিত এই বিমানবন্দর ও সিটির জন্য আড়িয়ল বিলের ২৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এই অধিগ্রহণের ফলে ঢাকা ও মুন্সিগঞ্জ জেলার তিন উপজেলায় বিস্তৃত মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় জলাধারটির প্রায় পুরোটা শেষ হয়ে যাবে। এর ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত কী ক্ষতি হবে, তা নিয়েও কোনো সমীক্ষা হয়নি।
পরিবেশবিদদের মতে, মিঠাপানি ও জীববৈচিত্র্যের বড় আধার এই বিল ধ্বংস করা হলে পরিবেশগত ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ঢাকার আশপাশে বন্যার প্রকোপও বাড়বে।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ সেলের প্রধান (যুগ্ম সচিব) জয়নাল আবেদীন তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ হবে। প্রথম পর্যায়ে এখন ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। পরবর্তী পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সব সমীক্ষা করা হবে।
নতুন বিমানবন্দরের সিদ্ধান্ত: সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। গত বছরের ২৯ আগস্ট প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলা হয়, প্রকল্পটি সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা কমিটি সাতটি স্থান সরেজমিনে পরিদর্শন করে তিনটি স্থানের নাম প্রস্তাব করে। এক. ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ত্রিশাল, আমিরাবাড়ী, মোক্ষপুর ও মঠবাড়ী ইউনিয়ন। দুই. ত্রিশাল উপজেলার রামপাল, কানহর, কাঁঠাল ও বৈলর ইউনিয়ন। তিন. টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর। এই তিনের মধ্যে প্রথম প্রস্তাবের পক্ষে (ময়মনসিংহের ত্রিশাল) গত বছরের ৭ এপ্রিলের বেসরকারি বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভায় সুপারিশ করা হয়।
এরপর কমিটি ১৫ নভেম্বর আবার বিমানবন্দরের স্থান নির্বাচনের জন্য ফরিদপুরের ভাঙ্গা, মাদারীপুরের শিবচর ও রাজৈর, শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরের আড়িয়ল বিল এলাকা পরিদর্শন করে। ৩০ নভেম্বর বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব সাংবাদিকদের জানান, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের স্থান হিসেবে আড়িয়ল বিলকেই চূড়ান্ত করার সুপারিশ করেছে এ-সংক্রান্ত কমিটি।
গত ১২ ডিসেম্বর আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর এবং পাশেই বঙ্গবন্ধু সিটি নির্মাণের বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আড়িয়ল বিলের ২৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
নতুন বিমানবন্দরের পক্ষে যুক্তি: মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ সেলের প্রধান (যুগ্ম সচিব) জয়নাল আবেদীন তালুকদার গত ৬ ডিসেম্বর স্থান নির্বাচন-সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠান বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে। প্রতিবেদনে নতুন বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলা হয়, দেশে এখন ১৭টি বিমান সংস্থা ফ্লাইট পরিচালনা করছে। ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান চলাচল বাড়ছে। ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে এর বর্তমান অবকাঠামো যথেষ্ট নয়। ক্ষমতার ৮০ শতাংশ এখন ব্যবহূত হচ্ছে। এ বিমানবন্দরের একটি রানওয়ে এবং বছরে ৮০ লাখ যাত্রী পরিচালনক্ষমতা রয়েছে। ক্রমবর্ধমান বিমানযাত্রীর তুলনায় তা অপ্রতুল। এই বিমানবন্দরের চারদিকে আবাসিক এলাকা ও সেনানিবাস থাকায় ভবিষ্যতে সম্প্রসারণ করা সম্ভব নয়। এর যাত্রী টার্মিনাল ভবন অপ্রশস্ত এবং পাঁচ স্তরের আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থার ধারণা বাস্তবায়নের যথেষ্ট সুযোগ নেই। এ ছাড়া বর্তমান বিমানবন্দরে সর্বশেষ প্রযুক্তির সুপরিসর উড়োজাহাজ এয়ারবাস এ-৩৮০ পরিচালনের ক্ষমতা নেই। এ অবস্থায় আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ এবং এর সঙ্গে রাজধানীর সংযোগ সড়ক এক্সপ্রেসওয়ে জরুরি।
পাল্টা যুক্তি: সরকারের এসব যুক্তি সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ বিমানের সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এয়ারবাস কোম্পানির সর্বশেষ সংযোজন এ-৩৮০ উড়োজাহাজ এখন পর্যন্ত খুব কম এয়ারলাইনসই ব্যবহার করছে। ঢাকা থেকে যেসব গন্তব্যে সরাসরি ফ্লাইট আছে, তাতে উড্ডয়ন ঘণ্টা ও যাত্রীর চাপ বিবেচনায় এখানে এ-৩৮০ উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনার সম্ভাবনা নেই। কারণ উড্ডয়ন ঘণ্টা বিবেচনা রেখে এয়ারলাইনসগুলো ফ্লাইট পরিকল্পনা করে। কম দূরত্বে সুপরিসর উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করলে লাভ হয় না।
আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থার ধারণা বাস্তবায়নের জন্য জরুরি প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও দক্ষ জনবল। এখানে বিশাল জায়গা বা অবকাঠামো মুখ্য নয়। ভবিষ্যতের প্রয়োজন মেটাতে টার্মিনাল ভবন আরও প্রশস্ত করা দরকার। সে জন্য বর্তমান বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত জমি আছে বলে সিভিল এভিয়েশন-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। এর পরও যদি স্থানসংকুলান না হয়, তাহলে বিমানবন্দরসংলগ্ন ১৩০ একর জমি কেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়া হলো, সে প্রশ্ন উঠছে। বিগত আওয়ামী লীগের আমলে এটা ইজারা দেওয়া হয়। পরে তা বাতিলও করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আবার তা ইজারা দেয় কান্ট্রি ক্লাব, গলফ ক্লাব, পাঁচ তারকা, তিন তারকা হোটেল ইত্যাদি করার নামে। কিন্তু গত ১০ বছরে কিছুই করা হয়নি। বর্তমান সরকারের সময় বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি ওই জমির ইজারা চুক্তি বাতিল করার প্রস্তাব করে। বিমানমন্ত্রী জি এম কাদের ওই সব জমি ফেরত নেওয়ার উদ্যোগ নেন। কিন্তু পরে সংসদীয় কমিটি ইজারাদারের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়। তখন বিমানমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সরকারি জমি ফেরত নিতে মন্ত্রণালয় আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে। ভবিষ্যতে বিমানবন্দর সম্প্রসারণে এই জমি দরকার হবে। কিন্তু এখন নতুন বিমানবন্দরের জন্য আড়িয়ল বিলের জমি অধিগ্রহণ করতে যাচ্ছে সরকার।
আরেকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, নতুন বিমানবন্দরকে এ অঞ্চলের বিমান চলাচলের কেন্দ্র করার কথা বলছে সরকার। কিন্তু কোন নিশ্চয়তা বা সমীক্ষার ভিত্তিতে এ সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে? দুবাই ও সিঙ্গাপুর হাব হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা দেশ দুটির বিমান সংস্থা এমিরেটস ও সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের। এ দুটি এয়ারলাইনস এখন বিশ্বের শীর্ষপর্যায়ের বিমান সংস্থা এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দেশে ও গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে। তারা প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে বিমান চলাচলে নিজ দেশের বিমানবন্দরকে মূল কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছে। দুবাই ও সিঙ্গাপুর এমনিতে বড় ব্যবসায়িক কেন্দ্র। তাদের রয়েছে আনুষঙ্গিক এমন সব সুবিধা, যা তাদের নগর পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত। ঢাকাকে দুবাই বা সিঙ্গাপুরের মতো বিমান চলাচলের আঞ্চলিক কেন্দ্র করতে হলে তার জন্য পুরো রাজধানীকে ওই রকম পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ঢাকাকে ঘিরে সরকারের এখন পর্যন্ত তেমন চিন্তা-পরিকল্পনার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
বিমান চলাচল বৃদ্ধির চিত্র: জানা গেছে, কুর্মিটোলায় বর্তমান বিমানবন্দরটির জমির পরিমাণ দুই হাজার একর এবং রানওয়ের দৈর্ঘ্য ১০ হাজার ৫০০ ফুট। রয়েছে পরিমিত প্রয়োজনীয় সুবিধাদি। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার সঙ্গে আন্তর্জাতিক গন্তব্যে বিমান চলাচল বৃদ্ধির যে প্রবণতা, তাতে ২০২৫ সালে এখানে মোট ৫৭ হাজার ফ্লাইট পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার। ২০১৫ সালে এটা ৩২ হাজার এবং ২০২০ সালে ৪২ হাজার হতে পারে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ব্যস্ত সময়ে ঘণ্টায় ঢাকায় বিমান ওঠানামা করবে ১৪টি। ২০২০ সালে তা ২০ ও ২০২৫ সালে ২৯টিতে উন্নীত হতে পারে।
এই সমীক্ষা অনুযায়ী আগামী ২০ বছরে যাত্রীসংখ্যা তিন গুণ হতে পারে। বর্তমান সুবিধাদি ও রানওয়ে দিয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত চলবে। তবে কিছু আধুনিকায়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির দরকার হবে এবং তা বর্তমান বিমানবন্দরেই করা সম্ভব।
বিমানসচিবের যুক্তি: আরেকটি বিমানবন্দর নির্মাণ কেন দরকার, এ প্রশ্নের জবাবে বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শাহজালালে একটিমাত্র রানওয়ে, যদি কোনো কারণে কোনো প্লেন দুর্ঘটনায় পড়ে রানওয়েতে বসে পড়ে, সেটা সরানো না যায়, তখন তো পুরো বিমানবন্দর অচল হয়ে পড়বে। আর এখানে আগামী ১০ বছরে বিমান চলাচল ও কার্গো বহন দ্বিগুণ হয়ে পড়বে। তা ছাড়া আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থাসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা এখানে নেই।
তুলনামূলক পর্যালোচনা: দেশে-বিদেশে বিমান পরিবহন-বাণিজ্যে জড়িত একজন পরামর্শক একটি রানওয়ের কারণে নতুন বিমানবন্দর করার যৌক্তিকতার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি জানান, যুক্তরাজ্যের গেটউইক বিমানবন্দরে একটি রানওয়ে ছিল। সম্প্রতি তারা দুটি করেছে। কিন্তু একটি রানওয়ে থাকা অবস্থায় সেখানে বছরে সাড়ে তিন কোটি যাত্রী পরিচালন করা হতো। আর ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের এখন পরিচালনক্ষমতা ৮০ লাখ, গত বছর প্রায় ৪০ লাখ যাত্রী এখানে আসা-যাওয়া করেছে। তাঁর মতে, এখানে ক্রমবর্ধমান যাত্রীর চাহিদা মেটাতে আরেকটি বিমানবন্দর বা রানওয়ে নির্মাণ সমাধান নয়। এখানে জরুরি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এবং এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট উন্নত করা দরকার। পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে টারমাক ও টার্মিনাল ভবন সম্প্রসারণ করতে হবে। এ জন্য পর্যাপ্ত জমি শাহজালালেই আছে।
সিভিল এভিয়েশনের একজন কর্মকর্তা জানান, শাহজালালে বর্তমান রানওয়ের ব্যবহারযোগ্য ক্ষমতার ৪০ শতাংশ ব্যবহূত হয়। জাপানের নারিতা বিমানবন্দরও একটি রানওয়ে দিয়ে চলছে। সেখানে ঢাকার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিমান ওঠানামা করে।
বিকল্প হিসেবে আরেকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরকে পুনরুদ্ধার করে অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে এবং শাহজালাল বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ওড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া যেতে পারে।
সাবেক বিমান প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নানের মতে, ‘প্রয়োজন হলে শাহজালাল বিমানবন্দরের ট্যাক্সিওয়েকে দ্বিতীয় রানওয়েতে পরিবর্তন করার (পরীক্ষা সাপেক্ষে) সুযোগ আছে। এ ছাড়া রানওয়ের পশ্চিম দিকে কিছু কিছু স্থাপনার যুক্তিসংগত পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে দ্বিতীয় রানওয়েও নির্মাণ করা যেতে পারে।’ তিনি বলেন, বর্তমান রানওয়ের লাইটিং সিস্টেম, অ্যান্টিফগ লাইটিং সিস্টেম স্থাপন, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের আধুনিকায়ন, হাইটেক যন্ত্রপাতি স্থাপন ও কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নিলে ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
আড়িয়ল বিলে কারিগরি ঝুঁকি: সিভিল এভিয়েশনের সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ বাতাসের বিপরীতে করতে হয়। বাংলাদেশে বছরের ৭০ শতাংশ সময়কালে বায়ুপ্রবাহ দক্ষিণ থেকে উত্তরে বয়ে যায়। বাকি ৩০ শতাংশ সময়কালে উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে থাকে। ফলে প্রায় ৭০ শতাংশ উড্ডয়ন ও অবতরণ হয় উত্তর-দক্ষিণ দিকনির্দেশনায়। বাকি সময় ৩০ শতাংশ দক্ষিণ-উত্তর দিকনির্দেশনায়। হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়েও উত্তর-দক্ষিণমুখী।
কিন্তু আড়িয়ল বিলটি পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। পশ্চিমে শেষ প্রান্তে পৌঁছে পশ্চিম-উত্তরে বেঁকে গেছে। তাই প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে পূর্ব-পশ্চিম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যদি তা হয়, তাহলে সারা বছর আড়াআড়ি বাতাসের (ক্রস-উইন্ডের) মধ্যে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে হবে। এটা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে জটিলতা বাড়াবে, খরচও বাড়বে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আড়িয়ল বিলের মাটি মূলত পিটজাতীয় জৈব মাটি (গাছপালা পচে তৈরি হওয়া নরম মাটি)।
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক ম ইনামুল হক বলেন, বিলে বিমানবন্দর ও বঙ্গবন্ধু সিটি করতে পুরো এলাকা ২০-৩০ ফুট বালু দিয়ে ভরাট করতে হবে। কিন্তু এখানে গভীর জৈব মাটির (পিট সয়েল) স্তর থাকায় বিমানবন্দরসহ নির্মিত স্থাপনা দেবে যাওয়ার সার্বক্ষণিক ঝুঁকিতে থাকবে। ৪০০ থেকে ৮০০ মেট্রিক টন ওজনের বিমান ওঠানামার জন্য জৈব মাটি বড় কারিগরি ঝুঁকি হিসেবে দেখা দেবে।

No comments:

Post a Comment