Monday, January 31, 2011

পিরামিড ভেঙে এখন পেটমোটা প্রশাসন

প্রশাসনের আদর্শ কাঠোমো ধরা হয় পিরামিড আকৃতিকে। এ দেশের প্রশাসনের মূল কাঠামোও এত দিন ছিল পিরামিড। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে সেটা ভেঙে হয়ে গেছে ‘পেটমোটা প্রশাসন’। আর এ কারণে দেখা দিচ্ছে নানান ‘অসুস্থতা’। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিকৃত চেহারার প্রশাসন আর চলতে পারছে না।
এর আশু নিরাময় দরকার। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নির্ধারিত পদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণসংখ্যক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ায় ফুলে-ফেঁপে উঠেছে প্রশাসনিক কাঠামোর মাঝের দুই স্তর। আবার অর্ধেকের বেশি পদ খালি থাকায় নিচের দুই স্তর হয়ে গেছে সরু। ফলে মোটা পেট নিয়ে জনপ্রশাসন প্রায় অচল হয়ে পড়ায় একে গতিশীল করতে গত দুই বছরে সরকারের ওপর মহল থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে ১১টি বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। এমনকি, শূন্য পদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি দেওয়ার সময় অডিটর জেনারেল অফিস থেকে আপত্তি তোলা হয়; কিন্তু সেটাও আমলে নেওয়া হয় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক সংস্থাপনসচিব ড. এ এম এম শওকত আলী এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রশাসনের স্বাভাবিক গতি অব্যাহত রাখার জন্য প্রথম কাজই হচ্ছে শূন্য পদের বিপরীতে পদোন্নতি দেওয়া। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু শূন্য পদ না থাকার পরও অতিরিক্ত পদোন্নতির কারণে প্রশাসনের কাঠামো অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। এতে কাজের স্বাভাবিক গতিও হারিয়ে গেছে। পাশাপাশি পদের চেয়ে কর্মকর্তা বেশি হওয়ায় পদায়নের জন্য তদবিরের মাত্রাও বেড়ে গেছে। পদায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট
কম মেধাবীরা তদবিরের মাধ্যমে ভালো পদে নিয়োগ পাচ্ছেন। আর মেধাবীরা অসহায় হয়ে পড়ছেন। ওএসডি হওয়ার আশঙ্কায় তাঁরাও একই পথ ধরেন। সব মিলিয়ে গোটা জনপ্রশাসন মেধাশূন্য হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে প্রশাসন সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ এখনই নেওয়া প্রয়োজন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খানও বলেন, প্রশাসনের মূল কাঠামো ভেঙে পড়ায় পদে পদে ফাইল আটকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই এ প্রশাসনের কাছ থেকে আর ভালো কিছু আশা করা যায় না। নির্ধারিত পদের বাইরে পদোন্নতি দেওয়ায় বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে অহেতুক ওএসডি করে রাখতে হচ্ছে। এঁদের কাছ থেকে সার্ভিস পাওয়া না গেলেও তাঁদের পেছনে ব্যয় হচ্ছে সরকারের বড় অঙ্কের অর্থ। এসব কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে কাজের স্পৃহা হারিয়ে ফেলছেন। এ অবস্থা থেকে উদ্ধারের একমাত্র উপায় হচ্ছে গোটা প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো। জরুরি হয়ে পড়েছে জনপ্রশাসন সংস্কার।
তবে সংস্থাপনসচিব ইকবাল মাহমুদের মুখে ভিন্ন সুর। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, প্রশাসন কাঠামোর তেমন কোনো বিকৃতি হয়নি। কাজের স্বাভাবিক গতি অব্যাহত আছে। বরং উপসচিব পর্যায়ের ডেস্ক থেকেই অনেক কাজ শুরু হয়। এতে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া এক ধাপ কমে এসে কাজ দ্রুত সম্পন্ন হচ্ছে।’
‘পদ না থাকার পরও বিপুলসংখ্যাক কর্মকর্তাকে উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি কেন দেওয়া হয়েছে?’জানতে চাইলে সচিব সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে বলেন, ‘আমরা সুপার নিউমারি (নির্দিষ্ট মেয়াদে অস্থায়ী পদ) পদ সৃষ্টি করছি।’
উল্লেখ্য, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবের জন্য নির্ধারিত পদের বাইরে এ মুহূর্তে ৭৮৯ জন অতিরিক্ত কর্মকর্তা থাকলেও সুপার নিউমারি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে শুধু উপসচিবের জন্য, মাত্র ২৬০টি।
‘স্বাভাবিক থাকলে কাজের গতি বাড়ানোর কথা উল্লেখ করে কিছু দিন পর পর সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নানা ধরনের নির্দেশনা পাঠাচ্ছে কেন?’জানতে চাইলে সংস্থাপনসচিব বলেন, এটি রুটিন ওয়ার্ক।
এক হিসাবে দেখা গেছে, পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি হওয়ায় ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, যাঁদের কোনো কাজ নেই) হয়ে আছেন ৪৯৩ জন। এ ছাড়া শূন্য পদের অভাবে পদায়ন না পাওয়া বিভিন্ন স্তরের প্রায় ৯০ জন কর্মকর্তাকে প্রেষণে প্রশাসনের বাইরে সরকারের অন্যান্য দপ্তরে নিয়োগ দিতে হয়েছে এবং তাঁদের মূল বেতনের ২০ শতাংশ প্রেষণ-ভাতা দিতে হচ্ছে। এতে করেও সরকারের মোটা অঙ্কের টাকা গচ্চা যাচ্ছে।
প্রশাসনের স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে গত দুই বছরে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যে ১১টি বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে২০০৯ সালের ১২ মার্চ খোদ প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগের কথা জানিয়ে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের চিঠি দেয় তাঁর কার্যালয়। যাঁদের কারণে প্রশাসন স্থবির হয়ে পড়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয় ওই চিঠিতে। এ ছাড়া সচিবরা রুলস অব বিজনেসের বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘন করে প্রশাসনে ফাইলজটের সৃষ্টি করছেন অভিযোগ এনে ওই বছরের ২৬ এপ্রিল অর্থসচিব ও ৭ মে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং পরের বছর ২৪ নভেম্বর আবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব তিন দফা চিঠি ছাড়েন। ওদিকে তদবিরবাজদের চাপে মন্ত্রণালয়ের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হচ্ছে উল্লেখ করে ২০০৯ সালের ৪ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক চিঠিতে সচিবালয়ের পাস ইস্যুর সংখ্যা সীমিত রাখাসংক্রান্ত সরকারের এক আদেশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজরে আনে।
এ ছাড়া ২০০৯ সালের ১ জুলাই সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের উদ্দেশে একটি চিঠি দেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোল্লাহ ওয়াহেদুজ্জামান। এ চিঠিতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সর্বশেষ জারি করা প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা অর্পণসংক্রান্ত আদেশের তথ্য, অনিষ্পন্ন পেনশন কেসের সংখ্যা ও নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ, অডিট আপত্তির সংখ্যা ও অর্থের পরিমাণসহ ১১টি বিষয়ে তথ্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়া অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির ব্যাপারে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের আগ্রহ সামান্যই। পেনশন নিষ্পত্তিতেও ঢিলেঢালা ভাবটাই চলছে। আর প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা অর্পণের বিষয়টির বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। ফলে উপসচিব, যুগ্ম সচিব বা অতিরিক্ত সচিবের ডেস্ক থেকে যেসব নথি নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, সেগুলো কোনো কারণ ছাড়াই সরাসরি সচিব বা মন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে সচিবালয় নির্দেশিকা অনুযায়ী নথি ছাড়ার সর্বোচ্চ সময়সীমা ৭২ ঘণ্টা কার্যকর হচ্ছে না।
বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফাইল ছাড় করার ব্যাপারে নানা দিক চিন্তা করেন তাঁরা। নেতিবাচক মন্তব্য দিলে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের বিরাগভাজন হয়ে ওএসডি হতে পারেনএমন আশঙ্কায় কোনো স্তরের কর্মকর্তাই ঝুঁকি নিতে চান না। আর পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা তো জুনিয়রদের অধীনে চলে যাওয়ায় এখন কাজের স্পৃহাই হারিয়ে ফেলেছেন।
এসব কারণেই মূলত বারবার নির্দেশ হাঁকার পরও তেমন ফল হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার এ পর্যন্ত প্রশাসনের উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে ৯৫০ জনকে পদোন্নতি দিয়েছে। আর প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকার পরও পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন ৬৯৭ জন।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের তিনজন সচিব, চারজন অতিরিক্ত সচিব ও তিনজন উপসচিব (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) প্রশাসনিক কাজের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে একমত পোষণ করে বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ২৭ শতাংশ। একই সময় গত অর্থবছরে এ হার ছিল ২৯ শতাংশ।
তবে সংস্থাপনসচিব ইকবাল মাহমুদ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এ নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। শেষ ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।
সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসন কাঠামোর মাঝের দুই স্তরে যুগ্ম সচিবের জন্য নির্ধারিত ৪৩০টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৫৬৮ জন এবং উপসচিবের ৮৩০ পদের বিপরীতে আছেন এক হাজার ৪৮১ জন। অর্থাৎ এ দুই পদে অতিরিক্ত কর্মকর্তা আছেন ৭৮৯ জন। অন্যদিকে প্রশাসনের নিচের দুই স্তরসহকারী সচিবের জন্য নির্ধারিত পদ দুই হাজার ৯৪টি হলেও এ মুহূর্তে কর্মরত আছেন এক হাজার ৪৫০ জন ও সিনিয়র সহকারী সচিবের এক হাজার ৭৭৪টি পদের বিপরীতে আছেন ৭৭৩ জন। অর্থাৎ নিচের দুই স্তরে কর্মকর্তার ঘাটতি এক হাজার ৬৪৫ জন। পদ না থাকার পরও সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে ৫৬৯ জনকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়াতেই মূলত প্রশাসনিক কাঠামোর নিচের দিক সরু ও মাঝের স্তর মোটা হয়ে গেছে। আবার শূন্য পদের বিপরীতে পদোন্নতি না দিয়ে যুগ্ম সচিব পদে ২৪৯ জনকে পদোন্নতি দেওয়ায় মাঝের স্তর আরো মোটা হয়ে গেছে।
প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কর্মরত ক্যাডার সার্ভিস কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুপারিশ করতে গঠিত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের অন্যতম সদস্য ও সরকারের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল আহমেদ আতাউল হাকিম কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্ধারিত পদের বাইরে পদোন্নতি দেওয়ায় সরকারের বাজেটবহির্ভূত ব্যয় বেড়ে যায়, আর এটা আইন লঙ্ঘনের শামিল। কারণ একটি অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেট হচ্ছে একধরনের আইন। যখন পদ না থাকার পরও পদোন্নতি দেওয়া হয়, তখন অডিটর জেনারেল অফিস থেকে আপত্তি দেওয়া হয়। তবে সরকার যদি বিশেষ প্রয়োজনে নির্ধারিত পদের বাইরে পদোন্নতি দেওয়া জরুরি মনে করে, সে ক্ষেত্রে সুপার নিউমারি পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতি দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

No comments:

Post a Comment