Monday, January 31, 2011

সাহিত্যের প্রচলিত ছক, শাখা, ভাগ একটা গড় ব্যাপার

ত্তেফাক সাময়িকী : প্রথম গল্প লিখতে গিয়ে কি কখনো প্রশ্ন জাগেনি, কেন আপনাকে গল্পই লিখতে হবে? হাসান আজিজুল হক : আমি আজ পর্যন্ত কখনো বলিনি যে, প্রথম গল্প 'শকুন' লিখতে গিয়ে আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম যে, আমাকে গল্পই লিখতে হবে।

বরং এর ঠিক উল্টো কথাই আমি বরাবর বলে এসেছি। সেটা তো তোমাদের খেয়াল করার কথা। আমি বলেছি, বড় লেখা_উপন্যাসই বলো, আর যাই বলো আমার বরাবরই প্রথম ইচ্ছা ছিল । যে গল্পটির কথা বলছো, তার আগেই অন্তত একটি অসমাপ্ত দীর্ঘ লেখা_ছাপলে প্রায় ১০০ পৃষ্ঠা হতে পারে_লিখেছিলাম। আর তার কিছুকাল পরে একটি পুরো ছোট উপন্যাসও লিখেছিলাম। টুকটাক গল্প বা কবিতাও কম লিখিনি। কাজেই প্রথম গল্প লেখার সময় আমি কখনো মনস্থ করিনি, আমাকে গল্পই লিখতে হবে। খুব ছোটবেলার একটা ঘটনার স্মৃতি মাথায় ছিল। সাঁঝের অাঁধারে রাতকানা এক শকুন এসে পড়েছিল খোলা খামারবাড়িতে। পথ-বিপথে ছোটা, এই বিভ্রান্ত শকুনটির পিছু নিয়েছিলাম আমরা। সেটার বর্ণনা দিয়েই গল্প শুরু হয়। গল্পের কলা-কৌশল, আঙ্গিক, কল-কব্জা কোনো কিছুরই ধারণা ছিল না। গল্পটি বের হওয়ার পর এ পর্যন্ত যত কথা শুনেছি, তা সবই পাঠকদের বিচার-বিশেস্নষণ এবং মন্তব্য। এ সমস্ত বিচার ও মন্তব্যের বৈচিত্র্যের মধ্যে আমার কথা ঘুরতে থাকে। বেশ বিভ্রান্ত ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি। এই এতগুলো কথা হলো তোমার প্রশ্নের জবাব।

ইত্তেফাক সাময়িকী : সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে গল্প ফর্মটিকে আলাদাভাবে কেন বিবেচনা করা দরকার?

হাসান আজিজুল হক : এ ব্যাপারে বলি, তুমি তো বরং বেশ উল্টো কথাই বলে ফেললে। আমি আগাগোড়া বলে এসেছি, সেদিনও একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে বলেছি_সাহিত্যের প্রচলিত ছক, শাখা, ভাগ একটা গড় ব্যাপার। খুব নির্দিষ্ট কিছু নয়। তাহলে আমি কেন বলতে যাব, ছোটগল্প বলে খুব আলাদা একটা সাহিত্যের ফর্ম আছে?

ইত্তেফাক সাময়িকী : 'শকুন' আপনার লেখা পাঠক সাধারণের কাছে বহুল পঠিত প্রথম গল্প। এই গল্প লেখার আগেও আপনি বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছেন বলে আমরা জানি। পূর্বের লেখা সেই গল্পগুলোকে ছাপিয়ে 'শকুন' গল্পটি পাঠক এত উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করলো কেন?

হাসান আজিজুল হক : আগে সেই সব লেখালেখি সাধারণ পাঠকদের কাছে তো পেঁৗছায়নি। স্থানীয় কোনো মফস্বল-গঞ্জ থেকে প্রকাশিত ভুলেভরা পত্রপত্রিকা ক'জন পাঠকইবা পড়েছে? সেই সব গল্পের কথা আমার নিজেরও মনে নেই। মনে হয়, বেশি পাঠক পড়লেও নিশ্চয়ই মনে রাখার মতো কিছু সেখানে ছিল না। দু'একটি লেখা হয়তো কোনোদিন প্রকাশিতও হয়নি। কাজেই তোমার প্রশ্নের আর কি জবাব হতে পারে?

ইত্তেফাক সাময়িকী : এই গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত 'সমকাল' পত্রিকায় ১৯৬০ সালে। কীভাবে গল্পটি এই পত্রিকার দপ্তরে পেঁৗছেছিল? এই গল্পটি পেঁৗছানোর পেছনের গল্পটি একটু বলুন।

হাসান আজিজুল হক : এই পেছনের গল্পটাও আগে নানাভাবে বলেছি। আমার হাতের লেখা প্রায় প্রথম থেকেই দুষ্পাঠ্য_আজও তাই। কাজেই ওই গল্পটির মূল কপি একটা বাঁধানো খাতায় এখনো লেখা আছে। খাতায় গল্পটির মাথার পাশে গল্পটি লেখা শুরু করার তারিখটিও লেখা আছে। আমার বড় বোনের হাতের লেখা সুন্দর ছিল। তিনি গল্পটি কপি করে দিয়েছিলেন। রেজিস্ট্রি করে ডাকে পাঠিয়েছিলাম। ছাপা_অল্পদিন পরেই সমকালের মার্চ সংখ্যাতে বেরিয়েছিল। সমকালে নিজের লেখা চোখে দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম_সন্দেহ নেই।

ইত্তেফাক সাময়িকী : শুধু একটি বিদঘুটে ও হিংস পাখি শকুনকে নিয়ে একটি গল্প তৈরি হতে পারে তা আপনার ভাবনা জগতে কীভাবে ধরা দিল?

হাসান আজিজুল হক : জবাব তো আগেই দিলাম। কোনো পরিকল্পনা-টরিকল্পনার ব্যাপার নেই। বরেন্দ্রের ঝাঁঝাঁ রোদের মধ্যে, ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে, চৌকিতে বুকের তলায় বালিশ দিয়ে শুয়ে, একটা সরু নিভওয়ালা শেফার্স কলম দিয়ে এলেবেলেভাবে গল্পটি লেখা শুরু করি। আলো এত কম ছিল, নিজের লেখা নিজেই দেখতে পাই না। এই তো ব্যাপার।

ইত্তেফাক সাময়িকী : ঝপ করে একটি শকুন খামারবাড়িতে নামার পরে গাঁয়ের ছেলেরা তাকে দেখতে পেল। কিন্তু তারা শকুনটিকে ঘিরে একটি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করল। তার পিছু পিছু দৌড়াল এবং প্রায় সারা রাতে তারা মাঠে মাঠে শকুনটিকে তাড়িয়ে কাটালো। গল্পটির গল্পকার হিসেবে কেন এমন করেছেন বলে আপনি মনে করেন?

হাসান আজিজুল হক : কোনো কারণ নেই। ঘটনাটি ওরকমই ছিল। গল্প বেরিয়ে এসেছে লেখার পরে। আমি লিখতে লিখতে এটা-ওটা-সেটা ভেবে থাকতে পারি। কিছু মিশেল কর্মও করে থাকতে পারি। কিন্তু সেটা কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে করেছিলাম বলে কোনোমতেই আমি মেনে নিতে পারবো না। কাজেই প্রশ্নের জবাব যদি পেতেই হয়, তাহলে গল্পটি পড়ে পাঠকরা নিজেরাই এই প্রশ্নের জবাব বের করে নেবেন।

ইত্তেফাক সাময়িকী : গল্পে কিশোরদের মুখের কথার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার এবং বিভিন্ন শ্রেণী ও বিত্তের কিশোর ছেলেরা সংঘবদ্ধভাবে কেন একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? বিশেষত শকুনের ওপর সেই কিশোর বালকরা নানাভাবে আনন্দমাখা অত্যাচার করতে উৎসাহী হয়ে উঠল কেন?

হাসান আজিজুল হক : সরল জবাব হচ্ছে, কোথাও কারো কোনো পরিকল্পনা ছিল না। সাধারণভাবে জিনিসটা নাও না! গাঁয়ের ছেলে-মেয়েরা দুষ্টুমি করে বেড়ায় না! মানুষের উপদ্রবও করে, ক্ষতিও করে ফেলে। এই কারো মাচা থেকে শসা চুরি করছে, কারো গাছ থেকে বাতাবিলেবু পেড়ে ফুটবল খেলছে। পাখির বাচ্চা কেউ পুষছে, কেউ মেরে ফেলছে। ধূসরিত, গরিব, ছন্নছাড়া ছেলেগুলোর স্বভাব নানারকম। সকলের অবস্থাও একরকম নয়। কেউ সচ্ছল। কেউ দুপুরের খাওয়ার পর আর কিছু খেতে পারেনি। কেউ গরু চড়ায়, কেউ স্কুলে যায়। সবারই পরনে নোংরা পোশাক, ধুলায় ধুলায় ধূসরিত এইসব বালক যদি দেখতে পায়, বিরাট এক শকুন তাদের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে, তখন তাকে নিয়ে মজা করা, সারা প্রান্তর জুড়ে তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো, তার পালক খসিয়ে নেয়া_এসব তো করবেই। এটাই স্বাভাবিক। তাই-ই তারা করছে। আর আমি সেটা ফোটাতে গিয়েই অবিকল তাদের মুখের ভাষা ব্যবহার করেছি। আর তাদের কথা ও চিন্তার মধ্যে যেসব কথা লিখেছি সেসব কিছুটা আন্দাজ করেছি। যেমন_পাখিটাকে সুদখোর মহাজনের সঙ্গে তুলনা কিংবা গল্পের একেবারে শেষে অবৈধ, অসামাজিক যৌন সম্পর্ক, আর প্রায় পশু জীবন হয়তো যোগ করেছি। তখন ভাবিনি, এখন ভাবি_লেখা হয়তো এরকম করেই হয়।

ইত্তেফাক সাময়িকী : ৫০ বছর আগে 'শকুন' গল্পটি লিখেছেন আপনি। গল্পটি প্রকাশের ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে এ বছর। এখন যদি এই গল্পটির দিকে আবার ফিরে তাকান তাহলে কীভাবে এই গল্পের গল্পকার হিসেবে গল্পটি মূল্যায়ন করবেন?

হাসান আজিজুল হক : এর এক কথায় জবাব হচ্ছে, সাধারণত আমি আমার পুরানো দিনে ফেলে আসা লেখাগুলো আবার কখনোই পড়ি না। 'শকুন' যদি পড়ি, আবার কী মনে হবে সে জল্পনা-কল্পনা করতে চাই না।

ইত্তেফাক সাময়িকী : তাহলে আপনার গল্পের নন্দন ভুবনটি কোথায়?

হাসান আজিজুল হক : আমার গল্পের নন্দন ভুবনটি হচ্ছে, ঠিক এই_মাটির পৃথিবীর কোনো কোনো ভূ-খণ্ডের মানুষ আর তার মৌলিক বেঁচে থাকাটার মধ্যে।

No comments:

Post a Comment