Monday, January 31, 2011

জনতার নিয়ন্ত্রণে কায়রো

মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে রাজপথে নামা মানুষের বিক্ষোভ আরও জোরালো হয়েছে। গতকাল রোববার কায়রোর কেন্দ্রস্থল তাহরির স্কয়ার ছিল বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে। স্কয়ারের আশপাশ ও বিভিন্ন রাজপথে ট্যাংকসহ সেনাসদস্যদের দেখা গেলেও তাঁরা বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।

বরং জনতার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানেই আগ্রহ দেখা গেছে তাঁদের মধ্যে। আলেকজান্দ্রিয়া ও সুয়েজ শহরেও টানা ষষ্ঠ দিনের মতো বিক্ষোভ হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন প্রেসিডেন্ট মোবারক। গণবিক্ষোভ অব্যাহত থাকায় প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে।
নজিরবিহীন সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মধ্যে মিসরের বিভিন্ন স্থানে লুটপাটসহ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির বেশ কয়েকটি কারাগার থেকে হাজার হাজার বন্দী পালিয়ে গেছে। গত মঙ্গলবার শুরু হওয়া সরকারবিরোধী বিক্ষোভে আইনশৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে এ পর্যন্ত অন্তত ১২৫ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ।
বিক্ষোভের খবর প্রচার করায় কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল-জাজিরার প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে মিসরীয় কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি সরকার-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর বলপ্রয়োগ না করতে এবং সহিংসতা বন্ধে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে মোবারকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
কারফিউ সত্ত্বেও কায়রোর তাহরির স্কয়ারে অনেক বিক্ষোভকারী রাতভর অবস্থান করেন। গতকাল সকালের দিকে বিক্ষোভকারীরা সেখানে জড়ো হতে থাকেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। লোকজন দলে দলে বিক্ষোভে যোগ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে এটি প্রেসিডেন্ট মোবারকের ৩০ বছরের শাসনামলের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমাবেশে পরিণত হয়। গতকালের বিক্ষোভে বিরোধীদলীয় নেতা মোহাম্মদ এলবারাদি যোগ দেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সমাবেশস্থলে যাওয়ার মুখে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের দেহ তল্লাশি করেন। স্কয়ারে জড়ো হয়ে বিক্ষোভকারীরা মোবারকবিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। তাঁরা বলেন, ‘মোবারক চলে যাও, তোমার জন্য বিমান প্রস্তুত রয়েছে’, ‘মোবারক, আর নয়’। একজন বিক্ষোভকারী আশা প্রকাশ করে বলেন, মোবারক পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। বিক্ষোভে যোগ দিতে যাওয়ার পথে আরেকজন বিক্ষোভকারী বলেন, ‘মিসরের জনগণ আমূল পরিবর্তন চায়। তার শুরু হতে হবে প্রেসিডেন্ট মোবারকের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে।’ এলবারাদি বলেন, ‘আমরা নতুন যুগের সূচনা করতে যাচ্ছি। মোবারককে ক্ষমতা ছাড়তেই হবে।’
বিক্ষোভের মধ্যে কায়রোসহ বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে, আলেকজান্দ্রিয়ায় ব্যাপক লুটপাটের খবর পাওয়া গেছে। স্থানীয় লোকজন দল বেঁধে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। স্থানীয় একজন অভিযোগ করেন, এই লুটপাটের সঙ্গে সরকারের পুলিশ বাহিনী জড়িত। লুটপাটের সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে আটক করে তাঁরা সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছেন বলেও ওই ব্যক্তি জানান। আলেকজান্দ্রিয়া শহরে একটি সুপার মার্কেটেও লুটপাটের খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কায়রোতে একটি জাদুঘর লুটপাটের চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রত্নসম্পদের জন্য বিশ্বখ্যাত মিসরের এ বিষয়ক সর্বোচ্চ পরিষদের মহাসচিব জাহি হাওয়াস জানান, লুটপাটের উদ্দেশ্যে দুই ব্যক্তি ছাদ দিয়ে জাদুঘরে প্রবেশ করে। তারা কোনো কিছু নিতে না পারলেও কিছু জিনিসের ক্ষতি করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি কারাগারের নিরাপত্তাকর্মীরা দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ায় বন্দীরা কারাগার ভেঙে পালিয়ে গেছে। কায়রোর উত্তরাঞ্চলের একটি কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় পদপিষ্ট হয়ে আটজন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। কোনো কোনো কারাগারে বন্দীরা দাঙ্গা সৃষ্টি করে ফটক ভেঙে পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়া বন্দীদের মধ্যে দেশটির নিষিদ্ধঘোষিত দল মুসলিম ব্রাদারহুডের ৩৪ নেতা-কর্মীও রয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার ওই নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়।
তাহরির স্কয়ারের আশপাশে গতকালও সেনাসদস্যদের ট্যাংক নিয়ে অবস্থান করতে দেখা যায়। আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ ভবনে সেনাসদস্যদের সতর্ক অবস্থান লক্ষ করা গেছে। তবে তাঁদের আগের দিনের মতো অ্যাকশনে যেতে দেখা যায়নি। বরং বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সেনাদের আচরণ ছিল বন্ধুসুলভ। বিক্ষোভকারীরা ট্যাংকের ওপরে উঠে মোবারকবিরোধী স্লোগান দেন। সেনাসদস্যদের সঙ্গে তাঁদের কোলাকুলিও করতে দেখা যায়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা একজন সেনাসদস্যকে কাঁধে তুলে নিয়ে নাচতে থাকেন।
এদিকে প্রেসিডেন্ট মোবারক গতকাল দেশটির সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
গতকাল কায়রোসহ বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে পুলিশ দেখা যায়নি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিক্ষোভ দমনে ব্যর্থ হওয়ায় পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট মোবারক এখন বিক্ষোভ দমনে সেনাসদস্যদের দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। আর এই উদ্দেশ্যেই ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। বিশ্লেষকেরা এও বলছেন, রোববার বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সেনাসদস্যদের আচরণ দেখে মন হয় না জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে মোবারককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে টিকিয়ে রাখার দায় তাঁরা নেবেন। তবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈঠকের পর তাহরির স্কয়ারের ওপর দুটি জঙ্গি বিমান ও একটি হেলিকপ্টারকে বারবার চক্কর দিতে দেখা গেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন মিসরের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। মিসরের পরিস্থিতি নিয়ে গত শনিবার জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। পরে হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে শান্ত থাকতে এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করা ও রাজনৈতিক সংস্কার এগিয়ে নিতে মিসরের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা নিরস্ত্র জনগণের প্রতি কোনো ধরনের বলপ্রয়োগ না করতে ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কিছু দেশ তাদের নাগরিকদের মিসর ভ্রমণ না করতে সতর্ক করে দিয়েছে। কায়রোতে মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোনো মার্কিন নাগরিক মিসর ছাড়তে চাইলে তাকে সহায়তা দেওয়া হবে।
প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক প্রায় ৩০ বছর ধরে মিসরের ক্ষমতায় রয়েছেন। ‘এপ্রিল ৬ মুভমেন্ট’ নামের একটি যুবসংগঠন দুর্নীতি, বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এএফপি, রয়টার্স ও বিবিসি।

No comments:

Post a Comment