Thursday, February 10, 2011

ভর্তি পরীক্ষা পৃথকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয় by ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

মাদের সমাজে সমস্যা হলো অলৌকিক উপদেশ দেওয়ার লোকের অভাব নেই। পণ্ডিত ব্যক্তিরাও অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের অপ্রাসঙ্গিক উক্তি করে থাকেন। শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নে বর্তমান সরকার চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকারের এ উদ্যোগ আরো ভালো হবে যখন উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কেবল মাস্টার্স নয়, এমফিল, পিএইচডির মান আরো উন্নত করা যাবে। এ জন্য অবশ্য প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে আরো কঠোর নিয়মনীতি অনুসরণ করতে হবে।

আমাদের দেশে যাতে উচ্চশিক্ষার মান আরো উন্নত হয়, সে জন্য সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের দায়দায়িত্ব অনেকখানি। দেশের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে এ দেশেরই কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমকক্ষতা প্রদান করতে চায় না। এটি কেন হচ্ছে, এর কারণ খতিয়ে দেখে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির অর্থ ব্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় আবেদন করার কাজে মোবাইলের ব্যবহার বা কম্পিউটারাইজড পদ্ধতি প্রচলনের ব্যবস্থা করা সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু তাই বলে একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক পদ্ধতিতে পড়ানো হয়। বহু ধরনের কোর্স যেখানে পড়ানো হয়। মেডিক্যাল তো মাত্র একটি নির্দিষ্ট বিষয়। সার্বিকভাবে সেখানে অনেক ধরনের বিষয় থাকে। কলা অনুষদের অধীনেই বিভাগ থাকে ১০-১১টি। আইবিএ-বিবিএতে যে মানের স্টুডেন্ট ভর্তি হয়, তা অত্যন্ত উচ্চ। অথচ জোর করে কেউ যদি নিজস্ব মতামত চাপিয়ে দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন মেডিক্যালের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একই ধরনের পরীক্ষার আলোকে ছাত্রছাত্রী নির্বাচন করার জন্য, তা হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তীচ্ছু পরীক্ষার্থীদের বরং বঞ্চিত করা হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান বজায় রাখার অসুবিধা হবে। আবার ধরুন, একজন অভিভাবক থাকেন লালমনিরহাটে। তাঁর মেয়ে টিকল চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ ক্ষেত্রে কী হবে?
মেডিক্যালে মাত্র একটি বিষয় অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০টির মতো বিষয়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও অনেক বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করানো হয়। একই অবস্থা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় যেমন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথায় আসা যাক। সেখানে এগ্রিবিজনেস অনার্স পড়ানো হয়। অথচ প্রফেসর পদে ওই বিভাগে শিক্ষক নেই। ঠিক তেমনি নানা জোড়াতালি দিয়ে বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। তবে বর্তমান সরকার মানোন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান একই সমান্তরালে ধরতে চায়, তাহলে সমস্যার সৃষ্টি হবে। কেননা সঠিক বেঞ্চ মার্কিংয়ের অভাবে পরিমাপ করার জন্য ইয়ার্ড স্টিক ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে ইয়ার্ড স্টিকের ব্যবহার যথাযথ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে যে ধরনের শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ করা হচ্ছে, তা আসলেই একধরনের নিকৃষ্টতম ঘটনা। একদা ভালো ছাত্রছাত্রী ছিলাম, পরবর্তী সময়ে দল করেছি; কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রকাশনা তেমন নেই, সে বিষয়ে মোটেও খেয়াল রাখা হচ্ছে না। হয়তো প্রাথমিক সিলেকশনে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় নিয়োগের ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তদন্ত করার ব্যবস্থা নিতে পারেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, তারা আজ তাদের উন্নতমানের শিক্ষাব্যবস্থা এবং উচ্চশিক্ষায় অধিকতর বিনিয়োগের কারণে পরাশক্তির অন্যতম দাবিদার। সেখানেও কিন্তু বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন তারিখে পরীক্ষা হয়ে থাকে। নির্দিষ্টভাবে পরীক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়ায় ভর্তি পরীক্ষারই প্রয়োজন হয় না। আন্ডার গ্র্যাজুয়েটে ভর্তি হতে হলে পূর্ববর্তী পরীক্ষার রেজাল্টের ভিত্তিতে ভর্তি হতে পারছে।
আমাদের দেশের সমস্যা হলো জনসংখ্যার তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা স্বল্প। বিশেষত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং জাহাঙ্গীরনগরের অত্যন্ত উন্নত। বুয়েটের মানও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মা-বাবা কষ্ট করে সন্তান ভর্তি করাতে চান। এ সমস্যা সমাধানে শুধু সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে চলবে না; বরং অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী এ ব্যাপারে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা-উত্তরকালে শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটান। সেই শিক্ষার মান যাতে বহাল থাকে এবং অভিভাবকরা যেখানে তাঁর সন্তানকে পড়িয়ে সন্তুষ্ট হবেন, সেখানে মেডিক্যালের মতো পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা শিক্ষাব্যবস্থাকে সংকুচিত করার প্রয়াস হবে বলে প্রতীয়মান হয়। আসলে সমস্যা হলো, এ দেশে শিক্ষাব্যবস্থাকে গিনিপিগ বানিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। তারই সূত্র ধরে রচনামূলক প্রশ্নের বদলে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন চালু করে জিপিএ ৫-এর ব্যবস্থা করা হয়। লাখ লাখ ছেলেমেয়ে এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে অথচ শিক্ষার মান উন্নতির বদলে অবনতি হয়েছে। ১৯৮২-তে যেখানে চারটি বোর্ডে প্রায় এক হাজার ৮০০-এর মতো প্রথম বিভাগ পেয়েছিল, এখন সব বোর্ডে জিপিএ ৫ পাওয়ার সংখ্যা হচ্ছে প্রায় শত গুণ।
সম্প্রতি একটি গবেষণাকাজে এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছে এমন ৩০০ ছাত্রছাত্রী এবং ও-লেভেলে ইংরেজিতে 'সি' পেয়েছে এমন ৩০০ ছাত্রছাত্রীর ইংরেজি জ্ঞানের পরীক্ষা নিয়ে দেখা গেল ও-লেভেলে যে ইংরেজিতে 'সি' পেয়েছে, তার মান অনেক ভালো। অথচ দেশে হাতে গোনা কয়েকটি স্কুলে ইংলিশ মিডিয়ামে ঠিকমতো পড়ানো হয়। বাকিটা নির্ভর করে ও-লেভেল এবং এ-লেভেলে প্রাইভেট পড়ার ওপর। তা হলে প্রশ্ন জাগে, কেন এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়া ছাত্রদের এ দৈন্যদশা? বাংলাদেশে শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রয়াস নিয়েছে। তাদের এ প্রয়াস সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু ভয় হয়, কোনো কোনো পণ্ডিত ব্যক্তি যখন অলীক স্বপ্ন দেখান বা ভ্রান্তনীতির কারণে বলেন, গুচ্ছ ব্যবস্থায় মেডিক্যালের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে হবে, তখন যদি সরকার এ ধরনের ভ্রান্তনীতি মেনে নেয়, তা হলে আখেরে অধিকাংশ অভিভাবক আশাহত হবেন। বরং কী করে কোচিং ব্যবসা বন্ধ করা যায়, রেজাল্টের ভিত্তিতে সহজভাবে ভর্তি করা যায় এবং জিপিএ ৫ পাওয়া স্টুডেন্টের মান যেন সত্যি উন্নত হয়, সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, সুন্দর মানস গঠনের হাতিয়ার। সমাজ থেকে দুর্নীতি এবং সামাজিক ব্যাধি, অনাচার কমে যাবে যদি পারিবারিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা ও দেশপ্রেমে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে উদ্বুদ্ধ করা যায়। মানবিকতাপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা বাঞ্ছনীয়। চলতি বছর যেভাবে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক শিক্ষার্থীদের ভর্তির ব্যবস্থা বজায় রয়েছে তা যেন ভবিষ্যতেও বজায় থাকে, সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জননেত্রীর কাছে প্রত্যাশা করছি। জননেত্রী ২০২১ সাল নাগাদ দেশের উন্নয়নের জন্য যে রূপরেখা দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে শিক্ষার মান উন্নত হওয়া বাঞ্ছনীয়। আশার কথা, বর্তমান সরকার সে লক্ষ্যে কাজ করছে। কোনো ধরনের বিভ্রান্তি যেন পিছু হটাতে না পারে।

লেখক : অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন এবং অর্থনীতির অধ্যাপক

No comments:

Post a Comment