Wednesday, September 21, 2011

বিএনপিকে পাশে পেয়েই জামায়াত বেপরোয়া by আবদুল্লাহ আল ফারুক

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত নেতাসমৃদ্ধ জামায়াতে ইসলামী বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শুরু থেকেই কোণঠাসা ছিল। একদিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া, অন্যদিকে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ধরপাকড়ে দিন দিন অসহায় হয়ে পড়ছিল দলটি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিরোধের সামনে তারা দাঁড়াতেই পারছিল না আন্দোলনের মাঠে।

কিন্তু হঠাৎ করেই গত সোমবার জামায়াত রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। পুলিশের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায়। তাদের গাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ সেদিন কোণঠাসা হয়ে পড়ে জামায়াত-শিবিরের 'যৌথ বাহিনীর' কাছে। বিএনপিকে পাশে পেয়েই জামায়াত এই শক্তি ও সাহস পেয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে জামায়াতকে একমঞ্চে নিয়ে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেটি কার্যকর হবে ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে। আর সেই শক্তিতে বলীয়ান হয়েই জামায়াত শক্তি প্রদর্শনে নেমেছিল। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, জামায়াতকে নিয়ে একমঞ্চে আন্দোলনের পক্ষে নন_এমন বিএনপি নেতারা বলছিলেন, 'জামায়াতের সেই শক্তি নেই। তারা নিজেরাই আন্দোলন করতে পারছে না। অসহায় হয়ে বিএনপিকে পাশে চাইচ্ছে'_এই অভিযোগ পাওয়ার পর জামায়াত গত সোমবার শোডাউন করে প্রমাণ করার চেষ্টা করল, তাদের আন্দোলন করার মতো শক্তি ও সাহস আছে। তারা হারিয়ে যায়নি। জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর সহকারী সেক্রেটারি আবদুল হালিম বলেন, কেউ কেউ বলছিলেন, জামায়াত শক্তি-সাহস হারিয়ে ফেলেছে। সোমবার জামায়াত প্রমাণ করেছে, তারা শক্তি হারায়নি।
বিএনপিকে পাশে পেয়ে জামায়াত বেপরোয়া হওয়ার মতো শক্তি ও সাহস পেয়েছে_এ কথা সরাসরি স্বীকার না করলেও বিএনপি নেতারা অস্বীকারও করছেন না। তাঁরা বলছেন, বিষয়টি জামায়াত নেতাদেরই জিজ্ঞেস করুন। জামায়াত নেতারা বলছেন, বিএনপিকে পাশে পাওয়ার কারণে নয়, জামায়াত যে শক্তি ও সাহস রাখে, সেটিই তারা দেখিয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আনোয়ার হোসেন বলেছেন, জামায়াতের যে কোনো পরিবর্তন হয়নি, সোমবারের ঘটনায় সেটা প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। সেই দূরত্ব ঘুচে গেছে গত ১২ সেপ্টেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে। ওই দিন রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, জামায়াতকে একমঞ্চে নিয়ে তারা কর্মসূচি পালন করবে। ২৭ সেপ্টেম্বর মহাসমাবেশে একমঞ্চে থাকবেন জামায়াতসহ শরিক নেতারা। জামায়াতের আমির থাকবেন মহাসমাবেশে বিশেষ অতিথি। সেখান থেকেই সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এই সিদ্ধান্তের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই গত সোমবার জামায়াতের প্রথম শোডাউন হলো রাজধানীর পল্টন, বিজয়নগর ও কাকরাইল এলাকায়, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আশপাশেই। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল, জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি আপাতত একমঞ্চে আন্দোলন করবে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির তিনজন সদস্য ড. খন্দকার মেশাররফ হোসেন, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান ও নজরুল ইসলাম খান ওই রিপোর্টে স্বীকার করেছিলেন যে জামায়াতের সঙ্গে একমঞ্চে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নেই বিএনপির। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েকটি কারণে বিএনপি ও জামায়াতের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। কারণগুলো হচ্ছে_বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকতে মন্ত্রণালয়গুলোতে প্রভাব খাটিয়ে দলীয় স্বার্থ উদ্ধার করেছে জামায়াত। অথচ তারা এমন আচরণ করেছে যে দুর্নীতির অভিযোগ শুধু বিএনপির বিরুদ্ধে, তাদের বিরুদ্ধে নয়। ওয়ান-ইলেভেনের পরও তাদের আচরণ বিএনপি ভালোভাবে নিতে পারেনি। বিশেষ করে ওই সময় জামায়াত বিএনপিকে এড়িয়ে চলেছে এবং ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক বজায় রেখেছে। জামায়াত বিএনপিকে ব্যবহার করে এবং টপকে বড় দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টাও করেছে বলে তাঁরা মনে করেন। সর্বশেষ গত ১২ সেপ্টেম্বর উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যে প্রকাশ পেয়েছে যে, জামায়াত ওই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমর্থিত ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর পিডিপিসহ কিংস পার্টিগুলোকে সমর্থন জানিয়েছিল। এ ছাড়া বিএনপি যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ার কারণেও জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখছিল।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান সরকারের শুরু থেকেই জামায়াত বিএনপিকে পাশে টানার চেষ্টা করছিল। বিএনপির সিদ্ধান্ত ছিল, শুধু নির্বাচনী জোট, একমঞ্চে আন্দোলন নয় জামায়াতের সঙ্গে। কিন্তু বিএনপি এককভাবে আন্দোলন জমাতে পারছিল না। সরকারপক্ষের হামলা-মামলারও শিকার হচ্ছিলেন নেতারা। এ অবস্থায় তাদের একটি শক্তিশালী সহযোগী প্রয়োজন বলে ভাবা হচ্ছিল। সে জন্যই ১২ সেপ্টেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে দূরত্বটুকু দূর করা হয়।
তবে সোমবার জামায়াত নেতাদের গ্রেপ্তারের পরদিন বিএনপির হরতাল ডাকার বিষয়টি একই সূত্রে গাঁথা বলে মনে করছেন অনেকে। সোমবার রাতে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে হরতালের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় জামায়াত নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গটিও আলোচনা করা হয় বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। বিএনপিকে পাশে পেয়ে জামায়াত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কি না_এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, এটা তাদেরই জিজ্ঞেস করুন। তিনি বলেন, জামায়াতের সঙ্গে সোমবার রাতে যোগাযোগ হয়েছে আন্দোলনের ব্যাপারে, বিশেষ করে ২৭ সেপ্টেম্বর মহাসমাবেশ নিয়ে। জামায়াতের ওপর পুলিশি হামলা বা গ্রেপ্তারের সঙ্গে হরতালের কোনো সম্পর্ক নেই। জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা ও একতরফাভাবে জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে হরতাল ডাকা হয়েছে। এই হরতাল জনগণের দাবি আদায়ের হরতাল। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, এবারের হরতাল একেবারেই জনস্বার্থে ডাকা হয়েছে। জামায়াতের ওপর পুলিশি হামলার জন্য এই হরতাল ডাকা হয়নি। বিএনপিকে পাশে পেয়ে জামায়াত বেপরোয়া হয়ে উঠল কি না জানতে চাইলে তিনিও বলেন, 'এটা আমি জানি না। জামায়াত নেতাদের জিজ্ঞেস করুন।'
জামায়াত দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে দাঁড়াতে পারেনি। হঠাৎ করে সোমবার কেন পুলিশের সঙ্গে এত বড় সংঘর্ষে জড়াল, এর পেছনে রহস্য কী_ এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সহকারী প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, বিএনপির সঙ্গে যৌথ কর্মসূচির কারণে শক্তি প্রদর্শন করা হয়নি। ২৭ সেপ্টেম্বরের মহাসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণার আগেই কেন্দ্রীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর দুদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। মূলত সে কারণেই জামায়াত সোমবার মাঠে নেমেছিল, শক্তি প্রদর্শনের জন্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আনোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত দুটি রাজনৈতিক দলই ধ্বংসাত্মক শক্তি। এরা স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে এ ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। 'তাদের তাণ্ডব পরিকল্পিত' মন্তব্য করে তিনি বলেন, এটা শক্ত হাতে দমন করতে হবে। গত সোমবার রাজধানীতে যে তাণ্ডব চালিয়েছে জামায়াত, তাতে এটা স্পষ্ট হলো, এ চক্রটির কোনো পরিবর্তন হয়নি। ছদ্মবেশ ধারণ করে আছে মাত্র। তিনি বলেন, লক্ষ করবেন, বিএনপির হরতাল কর্মসূচিতে জামায়াতের দাবি-দাওয়াগুলোর উল্লেখ রয়েছে।

No comments:

Post a Comment