Tuesday, July 26, 2011

তাহেরের হেরফের নেই! by কামরুল হাসান ও এম জে আলম

ঞ্জিন, আসন, চাকা—কোনো কিছুই আগের মতো নেই। কাঠামোটা এখনো টিকে আছে। তবে রং চটে গেছে, ধরেছে মরিচা। লক্ষ্মীপুর মডেল থানা চত্বরে ১০ বছর ধরে পড়ে আছে মাইক্রোবাসটি। এটি বিএনপির নেতা নুরুল ইসলাম হত্যা মামলার আলামত।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাইক্রোবাসটি নতুন করে আবার থানায় আগত মানুষের নজর কাড়ছে। তাহেরপুত্র বিপ্লবের ফাঁসির দণ্ড মওকুফের পর মামলার এই আলামতের মধ্যে এখন নতুন সন্ত্রাসের আলামত দেখছে এলাকার মানুষ। দিন কয়েক আগে নুরুল ইসলামের স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলা এলাকার মানুষের এই আশঙ্কাকে আরও জোরালো করেছে।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, এই মাইক্রোবাসে চড়েই দাপিয়ে বেড়াতেন লক্ষ্মীপুরের বিতর্কিত আওয়ামী লীগের নেতা আবু তাহেরের বড় ছেলে ফাঁসির আসামি এ এইচ এম বিপ্লব, পালিত ছেলে আবদুল জব্বার লাবু ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা। বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে, ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ১০টি খুন ও এক ডজনের বেশি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে এই মাইক্রোবাস ব্যবহূত হয়েছিল। এই মাইক্রোবাস নিয়েই লক্ষ্মীপুর পৌর ছাত্রদলের নেতা মুনছুর আহমেদ ও আনোয়ার হোসেন জুলফুর দুই হাতের সব আঙুল কেটে ফেলেন তাহেরের বড় ছেলে বিপ্লব। সেই মামলায় তাঁর সাজাও হয়েছিল।
কিন্তু এত দিন পরও এলাকাবাসী গণমাধ্যমের সামনে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। লক্ষ্মীপুরে এসে কয়েক দফা চেষ্টার পর দুই তরুণের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁরা কথা বলতে রাজি হন, কিন্তু ভয়ে ছবি তুলতে সম্মত হননি। এমন আতঙ্ক এখন লক্ষ্মীপুরজুড়ে।
আঙুল হারানো মুনছর প্রথম আলোকে শুধু বললেন, ‘রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকে যখন অবিচার হয়, তখন আত্মহত্যা করা ছাড়া আর উপায় থাকে না।’
বিএনপির নেতা নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় তাহেরের ছেলে এ এইচ এম বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। কিন্তু তাহেরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফ করেন। নুরুল ইসলাম হত্যা মামলা ছাড়াও বিপ্লব আরও চারটি হত্যা মামলার আসামি। এর মধ্যে দুটিতে তাঁর যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। তিনি বর্তমানে লক্ষ্মীপুর কারাগারে আছেন। বিপ্লবের এই সাজা মওকুফ নিয়ে লক্ষ্মীপুরবাসীর মনে আবার আতঙ্ক ভর করেছে। সবার একই আশঙ্কা, বিপ্লব মুক্ত হলেই আবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু হবে।
নিজের ছেলে বিপ্লবের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও সাজা মওকুফ হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তাহের বলেন, ‘বিপ্লবের নাম কে জানত, এখন সবাই তাকে চেনে। সে জেলা কমিটির (আ.লীগ) সদস্যও না। অথচ আজ প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, বিরোধী নেতা, ড. কামাল, সুরঞ্জিত সেন, মোহাম্মদ নাসিম—সবার মুখে মুখে তার নাম। টেলিভিশনে তাকে নিয়ে টক শো হচ্ছে। সে এখন জাতীয় নেতা। এক কোটি টাকা খরচ করেও এমন নাম পাওয়া যাবে না। ছেলেকে বলেছি, তুই এখন মরলেও আমি খুশি।’
তবে তাহেরকে নিয়ে জনমনে আতঙ্ক থাকলেও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ কমই হয়েছে। কেবল মেয়র নির্বাচনের সময় তিনি বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে প্রতিপক্ষের লোকজনকে বের করে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাহের অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ—কেউ আমাকে ভোট দেয়নি। তারা আমার বিরোধিতা করেছে। পৌর নির্বাচনে আমি কারও কাছে ভোট চাইতেও যাইনি, লোকজন ভালোবেসে আমাকে ভোট দিয়েছে।’
লক্ষ্মীপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম সরোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, এই সরকারের আমলে তাহের ও তাঁর ছেলেদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা অভিযোগ দায়ের হয়নি, যা আছে সব বিগত সময়ের অভিযোগ।
উন্নয়নকাজের নিয়ন্ত্রণ: স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর লক্ষ্মীপুর পৌরসভাসহ জেলায় যত সরকারি উন্নয়নকাজ হয়েছে, এর প্রায় সবই নিয়ন্ত্রণ করেছেন তাহের। এ ক্ষেত্রে তাঁর পক্ষে সব দেখাশোনা করেছেন মেজো ছেলে এ কে এম সালাউদ্দিন টিপু। জেলা পরিষদ, শিক্ষা প্রকৌশল, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের যাবতীয় ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণ তাঁরই হাতে। তাঁর কথামতোই সব কাজ ভাগ হয়েছে, সেভাবেই দরপত্রে ঠিকাদারেরা অংশ নিয়েছেন। তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তারা এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পৌর কাউন্সিলর অভিযোগ করেন, দরপত্র চাওয়ার আগেই বাস টার্মিনালের সীমানাদেয়াল নির্মাণের কাজ মেয়র তাঁর পছন্দের ঠিকাদারকে দিয়ে দেন।
তবে মেয়র তাহের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কে আমার নাম কইছে, কন।’ লোকজন বলেছে, আপনার নামেই তো এসব হয়ে থাকে—এ কথার জবাবে তাহের বলেন, ‘ওই আমলে (বিগত আওয়ামী লীগ আমল) হয়ে থাকতে পারে। এবার আমি কোনো এক্সইএনকে (নির্বাহী প্রকৌশলী) একটি ফোনও করিনি।’
পরবর্তী লক্ষ্য সাংসদ হওয়া: এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাহের এখন স্বপ্ন দেখছেন আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার। এর আগে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হতে চান। এরপর আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। এভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাহের। দল চার ভাগে বিভক্ত হলেও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে তিনি নিজের পছন্দের লোকদের জিতিয়ে এনেছেন। তাঁদের মধ্যে সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত দুই ইউপি চেয়ারম্যানও রয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে।
নিজের ‘ভাবমূর্তি’ উজ্জ্বল করতে পৌরসভার বাজেট ঘোষণার সময় ৬৫টি খাসি কেটে ভোজ দিয়েছেন তাহের। বিএনপি-জামায়াতের নেতারা সেই ভোজে অংশ নিয়েছেন, বক্তৃতাও করেছেন। তাহের এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি পৌর মেয়র হিসেবে আমন্ত্রণ করেছি, এমপি হলেও আমন্ত্রণ করব।’
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র সাহাবুদ্দিন সাবু প্রথম আলোকে বলেন, তাহেরের লক্ষ্য আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া। তাই নিজের ভাবমূর্তি উদ্ধারে তিনি এটা করেছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দলের কাউন্সিলররা সিদ্ধান্ত নেবেন, কে সভাপতি হবেন। কেউ চাইলেই তিনি সভাপতি হবেন, তা তো নয়।
সংসদ নির্বাচনের ইচ্ছা আছে কি না, জানতে চাইলে তাহের প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৌরসভা নির্বাচনের সময় মানুষের কাছে ওয়াদা করেছিলাম, আমি আর নির্বাচন করব না। কথা তো রাখতে হবে। তবে নেত্রী (শেখ হাসিনা) যদি চায়, তাহলে তো আমি আর না করতে পারব না।’

No comments:

Post a Comment