Tuesday, August 09, 2011

এসব কি গুপ্তহত্যা? by গোলাম মর্তুজা

১ জুলাই, সকাল নয়টা, দয়াগঞ্জ বাজার মোড়। স্থানীয় তরুণ জুয়েল গিয়েছিল চিনি, চা-পাতা কিনতে। আর রাজীব বের হয়েছিল নাশতা করতে। এখান থেকেই এদের ধরে নিয়ে যায় সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি দল। এরা নিজেদের ‘ডিবি’ বলে পরিচয় দিয়েছিল। আরেক তরুণ ওয়ার্কশপ কর্মী মিজানুর হোসেনকেও এদের সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর পাঁচ দিন পর ৫ আগস্ট এই তিনজনের মধ্যে দুজনের লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরের পুবাইলে রাস্তার ঢালে। ঢাকা-মাওয়া সড়কের পাশ থেকে পাওয়া যায় আরেক তরুণের লাশ। তিনজনেরই হাত-পা বাঁধা ছিল গামছা দিয়ে। মুখেও গোঁজা ছিল গামছা। জুয়েলের কপালের বাঁ পাশে ও গলায় আর রাজীবের মাথার চাঁদিতে গুলির চিহ্ন ছিল। মিজানের শরীরে গুলির কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলে তাঁর বাবা জানিয়েছেন। তিন যুবক নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে পরিবারগুলো গেন্ডারিয়া ও যাত্রাবাড়ী থানায় পৃথক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের মুখপাত্র ও গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ) উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিবির এ ধরনের হত্যার কালচার নেই। ডিবি আসামি ধরে, মামলা ডিটেক্ট করে, আসামি আদালতে চালান দিয়ে দেয়। ওই সময় যারা ডিবির নাম বলেছে, তারা অবশ্যই মিথ্যা পরিচয় দিয়েছে।’
কারা এ গুপ্তহত্যা ঘটাচ্ছে? কী তাদের উদ্দেশ্য? এসব প্রশ্নের জবাব মেলেনি। পুলিশের দায়িত্বশীল কেউ এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না।
তবে যোগাযোগ করা হলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ এস এম শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে বা যারাই এ ঘটনা ঘটাক না কেন, আমাদের এজেন্সিগুলো তা খুঁজে বের করবে বলে আমি আশা করি।’
তিন তরুণের পরিচয়: গাজীপুরের পুবাইল থেকে উদ্ধার হয় জুয়েল সরদার (১৮) ও মিজানুর হোসেনের (২০) লাশ। আর সিরাজদিখান থেকে উদ্ধার হয় রাজীব সরদারের (২৩) লাশ।
জুয়েল আর রাজীব চাচাতো ভাই। দয়াগঞ্জের ৩১/১ সরদারবাড়ি তাদের ঠিকানা। তাদের স্বজনেরা জানান, জুয়েল একটি এসি-ফ্রিজ মেরামতের দোকানে কাজ করত। রাজীব বড় ভাইয়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনের ব্যবসা ও টিউশনি করত। মিজানুরের বাড়ি দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীতে। ভাইয়ের সঙ্গে ওয়ার্কশপে কাজ করত সে।
তবে মিজানুর হোসেন চার বছর আগে দয়াগঞ্জে মোহন হত্যা মামলার ৩ নম্বর আসামি। অন্য দুজনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। অবশ্য রাজীবের এক ভাই রানা সরদার ২০০৫ সালে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়।
রাজীব আর জুয়েলের বিষয়ে জানতে চাইলে গেন্ডারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুক আহমেদ বলেন, গেন্ডারিয়া থানার কাজ শুরু হয়েছে দেড় বছর আগে। এই সময়ের মধ্যে এ দুজনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসেনি। এদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা জিডি নেই।
ওসি বলেন, ১ আগস্ট রাজীব ও জুয়েলের পরিবার তাদের নিখোঁজ হওয়ার কথা জানিয়ে থানায় দুটি জিডি করে।
যেভাবে নিখোঁজ: জুয়েলের বাবা সালাম সরদার বলেন, স্থানীয় জনি চৌধুরীর এসি-ফ্রিজ মেরামতের দোকানে কাজ করত জুয়েল। ৩১ জুলাই খুব সকালে তাদের এক জায়গায় এসি মেরামতে যাওয়ার কথা ছিল। জুয়েল ঘুম থেকে উঠে জনির বাসায় যায়। এর কিছুক্ষণ পরই শোনা যায়, বাজারের মোড়ে কারা যেন জুয়েলকে মারধর করে ধরে নিয়ে গেছে।
জুয়েলের দোকানমালিক জনি চৌধুরী জানান, সকালে জুয়েল কাজে যাওয়ার জন্য বাসায় এলে তাঁর মা জুয়েলকে চিনি ও চা-পাতা কিনতে পাঠান। টাকা নিয়ে বের হয়ে যায় জুয়েল। বেশ কিছু সময় পরও ফিরে না আসায় জনি ফোন করলে জুয়েল বলে, তাকে পুলিশ ধরেছে। এরপর জনি দয়াগঞ্জ বাজার মোড়ে যান।
জনি বলেন, ‘আমি গিয়া দেহি, সিটি তেহারির দোকানের সামনে কয়েকজন মিল্লা জুয়েলরে সমানে মারতাছে। আমি ভয়ে আর সামনে আগাইলাম না। আমি দৌড়ায়া মহল্লায় আইয়া জুয়েলের এক চাচিরে কইলাম, জুয়েলরে ডিবি ধরছে। এরপর পঞ্চায়েতের সরদার ফরিদ চাচারে কইলাম। পরে ফরিদ চাচাসহ মোড়ে গিয়া দেহি, হ্যারা কেউই নাই।’
জুয়েলের বাবা সালাম সরদার বলেন, ‘বাজারের মোড়ে গিয়া আমরা শুনি, ডিবির লোক আইছিল। সাদা মাইক্রোতে জুয়েল আর রাজীবরে তুইল্লা নিয়া গ্যাছে। তারা ওইহানেই মাইরা জুয়েলের মাথা ফাটায়া ফালাইছে। এই সময় একটা পোলা আবার দৌড় পাইড়া ভাগছে।’
রাজীবের ভাই রনি সরদার জানান, সকালে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নাশতা করার জন্য বের হয় রাজীব। এর একটু পরেই শোনা যায়, রাজীবকে ধরে নিয়ে গেছে ডিবি।
দয়াগঞ্জ বাজার মোড়ে স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী জানান, ওই দিন সকালে সশস্ত্র কয়েকজন লোক সিটি তেহারির দোকানের সামনে জুয়েল আর রাজীবকে পাকড়াও করে। এ সময় জুয়েল তাদের সঙ্গে তর্কাতর্কি শুরু করে। একপর্যায়ে তারা দুজনকে ধরে কী যেন জিজ্ঞেস করতে করতে মারতে থাকে। এ সময় মনে হয়, জুয়েলের মাথাও ফেটে যায়। স্থানীয় কয়েকজন এগিয়ে আসার চেষ্টা করলে ওই লোকগুলো নিজেদের ‘ডিবির লোক’ পরিচয় দেয়। তারা তাদের আশপাশে কাউকে ভিড়তে দেয়নি। তাদের হাতে ছোট পিস্তল ও শটগান ছিল।
একটি রেস্তোরাঁর কর্মী বলেন, রাস্তার ওপর দুজনকে পেটাতে দেখে সেনাবাহিনীর একটি পিকআপ ভ্যান ওইখানে দাঁড়ায়। এ সময় জুয়েল আর রাজীবকে মারধরকারী ব্যক্তিদের একজন এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয়পত্র দেখালে সেনাবাহিনীর পিকআপটি চলে যায়। একটু পরেই সাদা একটি মাইক্রোবাসে রাজীব আর জুয়েলকে তুলে নিয়ে যায় তারা। এ সময় এক যুবক দৌড়ে পালিয়ে যায়।
জুয়েল আর রাজীব স্থানীয় হওয়ায় তাদের এলাকার প্রায় সব ব্যবসায়ীই চেনেন। স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, ওই দিন এলাকার অনেক ব্যবসায়ীই জুয়েল আর রাজীবকে হাতকড়া লাগিয়ে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যেতে দেখেছেন। প্রথমে কেউ কেউ ভেবেছিলেন, স্থানীয় যুবকদের মধ্যে মারামারি লেগেছে। মুরব্বিরা এগিয়ে এলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওই দলটির একজন বলেন, ‘আমরা ডিবির লোক। আমাদের কাজ করতে দেন, এখানে ভিড় করবেন না।’
নিহত মিজান হোসেনের বাসা ৩৬ বি দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী। সেখানে তার বাবা ফারুক হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। ফারুক জানান, ৩১ জুলাই সকালে কাজে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল মিজান। রাজীব তাকে ফোন করে ডেকে নেয়। ওই দিন দুপুরে তাঁকে একজন খবর দেন যে মিজানকে ডিবি ধরে নিয়ে গেছে।
ফারুক হোসেন বলেন, তাঁদের সঙ্গে রাজন নামের করাতিটোলার এক তরুণকেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওই দলটি ধরেছিল। পরে রাজন দৌড় দিয়ে পালিয়ে যায়। এখন আর রাজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
খোঁজাখুঁজি: রাজীব ও জুয়েলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা গেন্ডারিয়া থানা, মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়, মালিবাগের সিআইডি কার্যালয়, র‌্যাব-১০, র‌্যাব-৩ এবং অন্যান্য জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তাদের পাননি।
রাজীবের ভাই রনি সরদার বলেন, ‘থানায় যাওয়ার পর প্রথমে থানা জিডি নিতে চায়নি। থানার এক দারোগা কইল, হয়তো সন্দেহ করে আটক করছে। চার-পাঁচ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ হইলে ছাইড়া দিব। এই কতা শুইনা আমার মায় একটু সান্ত্বনা পাইল।’
গেন্ডারিয়া থানা থেকে একই রকম সান্ত্বনার বাণী শুনেছেন জুয়েলের বাবা সালাম সরদারও। তিনি বলেন, ‘থানায় যাওয়ার পর দারোগারা কইছে, চিন্তা কইরেন না, ডিবি ধরলে তদন্ত শ্যাষে ছাইড়া দিব।’
মিজানের বাবা ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমি সব জায়গায় খুঁইজাও কোথায় পাইনি। যাত্রাবাড়ী থানায় জিডি করতে গ্যালে ডিবির কথা হুইনা হ্যারা প্রথমে জিডি নিতে চায়নি। এক দিন পর নিছে।’

No comments:

Post a Comment