Tuesday, October 02, 2012

বৌদ্ধপল্লিতে হামলাঃ সন্দেহে রোহিঙ্গা জঙ্গিরা

কক্সবাজারের রামু ও উখিয়ার বৌদ্ধ উপাসনালয়ে হামলার ঘটনায় রোহিঙ্গা জঙ্গিদের হাত রয়েছে বলে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সন্দেহ করছেন। তাঁদের ধারণা, সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, তার প্রতিশোধ নিতেই বৌদ্ধ উপাসনালয়ে হামলা চালানো হয়।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, হামলার সময় বিভিন্ন ব্যক্তির মুঠোফোনে ধারণ করা ভিডিওচিত্র দেখে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। এর পেছনে মূল ব্যক্তি কে বা কারা, সেটাও খোঁজা হচ্ছে। হামলার ঘটনায় গতকাল সোমবার রাত পর্যন্ত ৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, মন্দিরে হামলার আগে আয়োজিত একটি সমাবেশে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা বক্তব্য দেন। তাঁদের উপস্থিতিতেই উপাসনালয়ে হামলা হয়।
জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর বলেন, এ হামলা ছিল পরিকল্পিত। সব হামলার ঘটনা ঘটেছে রাতের অন্ধকারে। ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সের তরুণেরা এতে অংশ নেয়। এর পেছনে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের হাত থাকতে পারে বলে তিনি সন্দেহ করেন।
শনিবারের হামলার ঘটনার পর রামু ও উখিয়ার পরিস্থিতি আপাতত শান্ত। এলাকায় সেনা মোতায়েন রয়েছে। ১৪টি মামলা হয়েছে। আটক ৯৭ জনকে এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। চারজনের বেশি লোক যাতে জমায়েত হতে না পারে, সে জন্য ১৪৪ ধারা বলবৎ রাখা হয়েছে।
যে তরুণের ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননার ছবি দেখা গেছে, সেই তরুণের খোঁজ মেলেনি। রামুর হাইটুপি গ্রামের উত্তম কুমার বড়ুয়া নামের এই তরুণ ঘটনার পর থেকে পলাতক। পুলিশ তার মা ও বোনকে হেফাজতে নিয়ে রেখেছে।
রামু থানার পুলিশ জানায়, উত্তম একটি কম্পিউটার দোকানে বসে আড্ডা দিত। শনিবার রাতে ওই দোকানে কাজ করার সময় অন্য একজন দেখেন, উত্তম কুমারের ফেসবুকে কে বা কারা আপত্তিকর ছবিটি পাঠিয়েছে। এটি জানাজানি হলে উত্তম লোকজনকে বলে, কে বা কারা তার ফেসবুকে ছবিটি ট্যাগ (যুক্ত) করেছে। ঘটনাটি অল্প সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
আকবর আলী নামের এক গ্রামবাসী জানান, এর প্রতিবাদে রাত সাড়ে নয়টার দিকে ছাত্রলীগের নেতা সাদ্দাম হোসেন ও মৌলভি হাসানের নেতৃত্বে ৫০-৬০ জন লোক মিছিল বের করে। মিছিল শেষে একটি সমাবেশ হয়। এতে রামু নাগরিক উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুল ইসলাম ওরফে সেলিম ও মৎস্যজীবী লীগের নেতা আনসারুল হক বক্তব্য দেন। সমাবেশের খবর পেয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজিবুল ইসলাম সেখানে যান। তিনিও বক্তব্য দেন। সমাবেশে দুই-আড়াই শ লোক জড়ো হয়।
সমাবেশের ব্যাপারে জানতে চাইলে নুরুল ইসলাম বলেন, সমাবেশ করে তিনি সবাইকে শান্ত থাকার জন্য বলেছেন। তবে রাত ১০টার দিকে তিনি লক্ষ করেন, হঠাৎ করে বিভিন্ন যানবাহনে করে শত শত লোক রামুর দিকে আসছে। ওই বহরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও ছিলেন। এভাবে রাত ১২টা পর্যন্ত সেখানে শত শত লোক জড়ো হয়। এরপর তারা হামলা শুরু করে। রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত এ হামলা চলে। হামলায় আওয়ামী লীগের নেতারা ছিলেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাতের অন্ধকারে ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছিল না। তবে অনেক লোক জড়ো হয়েছিল। তিনি বলেন, বিএনপির সাংসদ লুৎফর রহমান কাজলও আসেন। তিনি লোকজনকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
সূত্র জানায়, সমাবেশে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরোয়ার, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মুশরাত জাহান মুন্নী উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশের ব্যাপারে জানতে চাইলে সোহেল বলেন, ‘আমি লোকজনকে ঠেকানোর চেষ্টা করছিলাম।’
সূত্র জানায়, একইভাবে পরদিন রাতে উখিয়ার উপাসনালয়ে হামলা হয়। দুই দিনে রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি উপাসনালয়ে হামলা চালিয়ে ছোট-বড় পাঁচ শতাধিক বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করা হয়। ওই সময় অর্ধশতাধিক বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয় ও ভাঙচুর করা হয়।
মন্ত্রীদের নিয়ে ব্যস্ত পুলিশ: এ পরিস্থিতিতে দুই দিনে চারজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার লোক কক্সবাজারের এলেন। গতকাল আসেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুব উল আলম হানিফ ও সাংসদ বীর বাহাদুর। তাঁরা কক্সবাজারে দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর দুপুরের দিকে এলাকা পরিদর্শন করেন। তাঁরা স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে ওই দিনের ঘটনা শোনেন। তবে এত কিছুর পরও গতকাল রামুতে সমাবেশ করার চেষ্টা করা হয়। জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, সমাবেশের মাইকিং করার সময় পাঁচ তরুণকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এরা সবাই মাদ্রাসার ছাত্র। গ্রেপ্তারের পর এই পাঁচ তরুণের একজন হাফেজ রেজাউল করিম পুলিশকে জানায়, স্থানীয় এক ব্যবসায়ী এ সমাবেশের জন্য অর্থের জোগান দিচ্ছেন। তাঁর কথা অনুসারে মাইকিং করা হচ্ছিল। তবে পুলিশ ওই ব্যবসায়ীর বাসার পৌঁছানোর আগেই তিনি পালিয়ে যান।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ঘটনার পর থেকে মন্ত্রীরা কক্সবাজারে আসছেন। তাঁদের প্রটোকল দিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ই পাওয়া যাচ্ছে না।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দুই দিনের হামলার ঘটনা ঘটেছে রাতে। এতে কম বয়সের তরুণেরা অংশ নিয়েছে। তাদের বড় অংশ মাদ্রাসার ছাত্র। মজার ব্যাপার হলো, তারা কোনো ব্যক্তির ওপর আক্রমণ করেনি। এত বড় ঘটনা ঘটলেও কেউ আহত পর্যন্ত হয়নি। আবার যেখানে মুসলিম বসতি আছে, সেখানকার উপাসনালয়ে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। এসব দেখে তাঁরা বলছেন, এটা পুরোপুরি পরিকল্পিত।
স্থানীয় লোকজন জানান, মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর সেখান থেকে দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনার পর থেকেই বাংলাদেশে অবস্থান করা রোহিঙ্গা বাসিন্দা ও রোহিঙ্গাদের কথিত স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা তিনটি জঙ্গিগোষ্ঠী ক্ষুব্ধ ছিল। ইনোসেন্স অব মুসলিমস ছবি ইউটিউবে প্রচারের পর গত ২১ সেপ্টেম্বর এর প্রতিবাদে টেকনাফে বড় একটি সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ওই সমাবেশে টেকনাফের সরকারদলীয় সাংসদ আবদুর রহমান বদি বক্তব্য দেন। একই সবাবেশে বক্তব্য দেন জামায়াতের টেকনাফ উপজেলা আমির নুর আহমদ আনোয়ারী।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ওই সময়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে অসন্তোষ ছড়ানোর চেষ্টা করে রোহিঙ্গারা। কিন্তু পুলিশি বাধার মুখে তারা পারেনি।

No comments:

Post a Comment