Wednesday, February 02, 2011

কায়রো জনসমুদ্র: সেনাবাহিনী মাঠে, তবে গুলি চালাবে না

মিসরের রাজধানী কায়রো জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল গতকাল মঙ্গলবার। প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকবিরোধী গণবিক্ষোভ তুঙ্গে উঠেছে। গতকাল সেখানে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। একদিকে প্রবল গণ-আন্দোলন, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক চাপ মাথায় নিয়ে গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে মুবারক সরকার। বলা যেতে পারে, মুবারক সরকারের পতনের ক্ষণ-গণনা শুরু হয়েছে।

মিসরে গতকাল টানা দ্বিতীয় দিনের মতো দেশজুড়ে পালিত হয়েছে সর্বাত্মক ধর্মঘট। সোমবারের গণসমাবেশের পরদিন গতকাল আরো বড় মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়ে দেশবাসীকে মুবারকবিরোধী বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল বিরোধী সংগঠনগুলো। জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে গতকাল রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারের সেই মহাসমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। কয়েক লাখ বিক্ষোভকারী প্রেসিডেন্ট মুবারকের
পতন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাবে না বলে ঘোষণা দেওয়ায় গভীর রাত পর্যন্ত তাহরির স্কয়ার মুবারকবিরোধী মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে। তবে সহিংস আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসায় গতকাল পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।
এদিকে তাহরির স্কয়ারসহ গোটা রাজধানী মুবারকবিরোধী ব্যানার ও পোস্টারে ছেয়ে গেছে। তাহরির স্কয়ার এখন সমাবেশকারীদের দেশাত্মবোধক গান, বিপ্লবী স্লোগান, বিদ্রুপ-ব্যঙ্গাত্মক বক্তৃতা ও জনগণকে মাঠ না ছাড়ার উদ্দীপ্ত আহ্বান জানানো শাণিত বক্তৃতায় মুখরিত। শত শত মিসরীয় আরবি অক্ষরে মুবারকের উদ্দেশে প্লাকার্ডে লিখছে, ‘ইরহাল’ যার অর্থ ‘ভাগো’ বা ‘কেটে পড়ো’।
এ পরিস্থিতিতে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সেনাবাহিনী এবার মাঠে নেমেছে। এত দিন শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান, প্রেসিডেন্টের প্রাসাদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান করলেও গতকাল থেকে বিক্ষুব্ধ জনতাকে তাহরির স্কয়ারের গণসমাবেশে যোগদানে বাধা দেওয়ার জন্য তাদের ব্যবহার শুরু করেছে সরকার। বাইরে থেকে আগত মিসরীয়দের ঠেকানোর জন্য তারা গতকাল কায়রো ও আলেকজান্দ্রিয়া শহরের প্রবেশমুখগুলোতে চেকপয়েন্ট বসিয়েছে। শহরের বাইরে থেকে আগত প্রতিটি যানবাহন ও ব্যক্তিদের দেহতল্লাশি করা হচ্ছে। বেশির ভাগ ব্যক্তিকেই শহরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গণদাবি বৈধ। তারা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাবে না।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নব নিযুক্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলাইমান বলেছেন, বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে সংকট উত্তরণের জন্য প্রেসিডেন্ট মুবারক তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তবে জনতার দাবি যেখানে মুবারকেরই পদত্যাগ, সেখানে তিনি সফল হবেন কি না এ নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন।
উল্লেখ্য, আট দিন ধরে কায়রো শহরে প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক সরকারের ৩০ বছরের শাসনামলের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন চলছে। আন্দোলনের পাঁচ দিনের সহিংসতায় কমপক্ষে শতাধিক লোক নিহত ও কয়েক হাজার আহত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট মুবারক মন্ত্রিসভার রদবদলসহ নতুন করে ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু এসব পরিবর্তন মুবারকবিরোধী আন্দোলনে এখনো কোনো প্রভাব ফেলেনি, বরং সহিংস আন্দোলনের পথ ছাড়াই বিরোধীদের আন্দোলন এখন গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। মুবারক সরকারের দীর্ঘদিনের বন্ধু হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র সরকারও দেশটিতে একটি ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ প্রতিষ্ঠা করে আগামী সেপ্টেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যন্ত উভয় পক্ষকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছে। এতে মুবারক সরকার স্পষ্টতই বেকায়দায় পড়েছে।
এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ন্যাভি পিল্লাই দাবি করেছেন, মিসরজুড়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অন্তত ৩০০ বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে এবং তিন হাজারের বেশি আহত হয়েছে। এ ঘটনায় সরকারের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, সরকারি নিরাপত্তারক্ষীরা শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। এ ঘটনা পুরোপুরি মানবাধিকারের পরিপন্থী এবং এজন্য তিনি ভীষণভাবে ব্যথিত।
মুবারকের পদত্যাগ ও দেশটিতে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসা নোবেল বিজয়ী নেতা মোহামেদ এল বারাদি গতকালও একটি ব্রিটিশ সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মিসরের জনগণ ফুঁসে উঠেছে। এখন নিজের পিঠের চামড়া বাঁচাতেই মুবারককে প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়তে হবে।’ মুবারকের ঘনিষ্ঠ লোকজন ও তাঁর প্রশাসনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘যখন সারা দেশের মানুষ আন্দোলনে নেমেছে, তখন ওঁনার (মুবারকের) কাছের কিছু লোক তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, এটা অল্প কিছু লোকের ঝগড়া-ফ্যাসাদ মাত্র। তাঁরা মুবারককে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, লোকজন একসময় সরে যাবে। তাঁর কিছু হবে না। এ ধরনের আচরণ ভীষণ হাস্যকর এবং একই সঙ্গে অন্যায়। মুবারককে সত্য কথাটি জানতে হবে এবং সেটা জেনে এখনই তাঁর পদত্যাগ করা মঙ্গল।’
বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে বিদেশি নাগরিকদের কায়রো ছাড়ার হিড়িক পড়েছে। কায়রো বিমানবন্দর বিদেশি নাগরিকে ঠাসা। কিন্তু নতুন করে সেখানে কোনো বিদেশিকে আসতে দেখা যাচ্ছে না। কিছু বিদেশি কায়রো শহর ছাড়ারও চেষ্টা করছেন। তাঁদের সবাই উদ্বিগ্ন এবং ভীষণভাবে আতঙ্কিত।
কায়রোর বিশাল জনসমাবেশের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে মুবারকবিরোধী প্রায় ৫০ হাজার মানুষ গতকাল আলেকজান্দ্রিয়া নগরীতেও বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করেছে। কয়েক দিন ধরেই এ শহরে মুবারকবিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলেও গতকালের সমাবেশ ছিল বৃহত্তম। সমাবেশে মুবারকের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়, কেউ কেউ মুবারকের প্রতীকী কফিনও বয়ে নিয়ে যায়। আন্দোলনকারীরা মুবারকের পদত্যাগের দাবিতে পুরো আলেকজান্দ্রিয়া শহর প্রকম্পিত করে। সাংবাদিক ও বিশ্লেষকদের ধারণা, আলেকজান্দ্রিয়ার এই বিক্ষোভ সমাবেশ কায়রোর তাহরির স্কয়ারের চেয়ে ছোট হলেও এটি আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই আরো বড় সমাবেশে পরিণত হতে পারে। তার চেয়ে বড় কথা, এ ঘটনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে মিসরের ছোট-বড় সব শহরে অচিরেই মুবারকবিরোধী বড় বড় সমাবেশ ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে দুই সপ্তাহর কিছু বেশি সময় আগে তিউনিসিয়ার গণ-আন্দোলনের মুখে সে দেশের সরকার পতনের পর এবং মিসরে মুবারকবিরোধী আন্দোলন চলার মাঝেই গতকাল হঠাৎ করেই জর্দানেও গণবিক্ষোভের মুখে দেশটির সরকার পতন হওয়ায় মিসরবাসীর গণ-আন্দোলন আরো তীব্রতর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
সূত্র : বিবিসি, এএফপি, আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য হিন্দু, ইয়াহু নিউজ।

No comments:

Post a Comment