Saturday, February 12, 2011

বিদ্যুৎ মেলে না, কম ডিজেলের জোগান, বিপাকে বোরো চাষিরা

'প্রতিদিন হামার ২০০ ট্যাকা করে বেশি খরচ করা লাগিচ্ছে। এডা পোষামু কেংকা করে, জানি না।' বাড়তি দর দিয়ে ডিজেল কিনে এভাবেই ক্ষোভ আর আশঙ্কার কথা বলছিলেন মির্জাপুরের সাদুবাড়ী গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম। দেশে ৫৮ শতাংশ ধানের চাহিদা পূরণ করে বোরো।

তবে এবার বোরো চাষের ভরা মৌসুমে বিদ্যুৎ অপ্রতুল। ডিজেলের সরবরাহও চাহিদার অর্ধেক। ফলে কৃষকরা সেচের পানির জন্য হিমশিম খাচ্ছেন। বোরো ধানে সেচ দিতে রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ এবং সর্বত্র ডিজেল প্রাপ্তির নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসকদের ১ জানুয়ারি নির্দেশনা দিয়েছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়। তবে বিদ্যুৎ সরবরাহ কম হওয়ায় তার বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে ৪৪ টাকার ডিজেলও কিনতে হচ্ছে ৬০ টাকায়। এ জন্য কৃষকরা দায়ী করছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈরী আবহাওয়ায় আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে বৃষ্টি। নেমে গেছে পানির স্তর। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদ্যুৎ ও ডিজেল ঘাটতি। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বোরো চাষ মৌসুমে সেচ যাতে নির্বিঘ্ন হয়, তা নিশ্চিত করা আবশ্যক।
টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে কৃষিসচিব সি কিউ কে মুসতাক আহমেদ গত বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ফসলের চাষ ও উৎপাদন বাড়াতে সরকার সব ধরনের পদক্ষেপই নিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ ও ডিজেল সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ডিজেল সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে সচিব বলেন, 'চোরাচালানের ভয়ে ডিজেলের সরবরাহে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কিছুটা ঘাটতি দিয়েছিল। তবে তা আর এখন থাকবে না। অন্যান্য সমস্যাও দ্রুত কেটে যাবে।' তিনি আরো বলেন, দাম ভালো পাওয়ায় কৃষক এবার ধান চাষে বেশি করে আগ্রহী হয়েছে।
বিদ্যুৎ সরবরাহের সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, সেচে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে ২৬ ডিসেম্বর আন্তমন্ত্রণালয়ের বৈঠক হয়। এতে সেচের জন্য প্রতিদিন এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের সরবরাহ চাওয়া হয়। ওই বৈঠকে বিদ্যুৎ বোর্ড এক হাজার ৩৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু উৎপাদন কম হওয়ায় এখন প্রতিদিন সরবরাহ দিচ্ছে এক হাজার মেগাওয়াট।
ডিজেল আছে অর্ধেক : বোরো ধানে সেচের আনুমানিক ৭৫ শতাংশই পূরণ করে ডিজেলচালিত পাম্প। কিন্তু চলতি বছর এ ডিজেলের সরবরাহ কমে চাহিদার অর্ধেকে নেমেছে। তীব্র চাহিদার সুযোগ নিয়ে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ৪৪ টাকা লিটারের পরিবর্তে ৬০ টাকা আদায় করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার কৃষক আবুল সরকার ও শেরপুরের বিশালপুর ইউনিয়নের দোয়ালসারা গ্রামের এনামুল হক টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে জানান, ৪৪ টাকার ডিজেল তাঁদের কিনতে হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬২ টাকায়। তাও সংগ্রহ করতে হচ্ছে তিন থেকে চার মাইল দূরের খোলা দোকান থেকে। ১০-১৫ দিন ধরে চলছে এ অবস্থা।
রাজশাহী বিভাগীয় পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগ, ডিপো থেকে পর্যাপ্ত তেল তাদের দেওয়া না হলেও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ঠিকই সরবরাহ নিচ্ছে। পরে তারা লিটারপ্রতি ৮-১০ টাকা বেশি দামে খুচরা বিক্রি করছে। এতে করে উত্তরাঞ্চলের সাড়ে চার শ তেলের পাম্পে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
রাজশাহী বিভাগীয় পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম এ মোমিন দুলাল অভিযোগ করেন, টাকা দিলেও চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ মিলছে অর্ধেক। তিনি জানান, উত্তরাঞ্চলে স্বাভাবিক সময়ে ডিজেলের চাহিদা দৈনিক ২২ লাখ ৫০ হাজার লিটার। এখন চাহিদা এর প্রায় দ্বিগুণ।
পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় মহাসচিব মিজানুর রহমান রতন জানান, বোরোর ভরা মৌসুমে সারা দেশের ডিজেলের মোট চাহিদার অর্ধেকেরও বেশি প্রয়োজন হয় উত্তরাঞ্চলে। অথচ এখন সরবরাহ কম বলে পাম্প মালিকদের চাহিদার অর্ধেক তেলও দেওয়া হচ্ছে না।
এদিকে বিপিসির বাঘাবাড়ী অয়েল ডিপো সূত্র জানায়, প্রায় ৬১ লাখ লিটার জ্বালানি তেল নিয়ে নদীতে (নাব্যতা সংকটের কারণে) আটকে আছে ১৭টি শ্যালো ড্রাফট ট্যাংকার।
উত্তরাঞ্চলীয় জ্বালানি তেল মনিটরিং সেলের এজিএম শাহীন রেজা খান কালের কণ্ঠকে গতকাল জানান, 'প্রতিদিনের চাহিদার বিপরীতে ৯০ শতাংশ বিতরণ করা হচ্ছে। তবে চাহিদার পুরোটা সরবরাহ করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছে।' তিনি কৃষক ও পাম্প অ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের যোগসাজশ কিংবা সম্পর্ক নেই। কেউ বেশি দামও আদায় করছে না। আর সব সমস্যারই দ্রুত সমাধান হবে।'
ডিজেলের দাম অস্বাভাবিক বাড়া সম্পর্কে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পরিচালক (বিপণন) মুহাম্মাদ নূরুল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে ডিজেলনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় ডিজেলের চাহিদা বেড়েছে। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় দাম কম হওয়ায় হয়তো পাচারও হচ্ছে। তিনি জানান, গত বছরের জানুয়ারি মাসে দেশে দুই লাখ ৫১ হাজার টন ডিজেল বিক্রি হলেও এবার (জানুয়ারি মাসে) হয়েছে প্রায় চার লাখ ২০ হাজার টন। অতিরিক্ত দাম আদায়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঘাটতির সুযোগে এটা হয়ে থাকতে পারে। নূরুল আমিন দাবি করেন, জ্বালানি সরবরাহ বাড়াতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ইঞ্জিন ও ওয়াগন দিতে ব্যর্থ হচ্ছে রেলওয়ে।
সেচকাজে ব্যবহৃত পাম্পের জন্য বোরো মৌসুমে ডিজেলের চাহিদা ধরা হয় ১৩ লাখ ৪৭ হাজার টন। আর ডিজেলের সরবরাহ ও বিতরণে সংকট সৃষ্টি হওয়ায় বিপিসির চেয়ারম্যানকে গত বুধবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
পানির জন্য নির্ঘুম প্রতীক্ষা : ডিসেম্বর থেকেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছে বোরোর চাষ। শীত মৌসুম এখনো থাকলেও চলছে বিদ্যুৎ সংকট। সেচের চাহিদার ২৫ শতাংশ পূরণ করে বিদ্যুৎ। সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সংকট প্রকট হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন কৃষি বিশেষজ্ঞ ও কৃষকরা।
জাতীয় বীজ বোর্ডের সদস্য ও কৃষক প্রতিনিধি যশোরের আলতাব হোসেন গত বৃহস্পতিবার টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, বোরো চাষের শুরুতেই চলছে বিদ্যুৎ সংকট। সেচের এ ভরা মৌসুমে প্রতিদিনই লোডশেডিং হচ্ছে। তিনি জানান, পানির অভাবে অনেক জমি এখনো চাষের আওতায় আসেনি।
নওগাঁর মান্দা উপজেলার ছোটমুল্লুক গ্রামের কৃষক ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গভীর নলকূপের ম্যানেজার সাইফুদ্দিন প্রামাণিক বলেন, '২৪ ঘণ্টায় ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। এদিকে সেচের অভাবে এ নলকূপের আওতায় থাকা ২৪৪ বিঘা জমির মধ্যে প্রায় ১০০ বিঘা জমি এখনো চাষ করা যায়নি।' তিনি জানান, রাত জেগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও সেচের পানি মিলছে না। এতে কৃষক ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। তবে এবার ধানের দাম ভালো পাওয়ায় বিদ্যুৎ সংযোগের গভীর নলকূপের এলাকায় ব্যক্তিমালিকানাধীন এক ডজনেরও বেশি অগভীর নলকূপ অব্যাহতভাবে সেচের কাজ করছে।
ধুনট উপজেলার কৃষক আকবর মোল্লা টেলিফোনে জানান, 'লোডশেডিংয়ের কারণে গত বোরো মৌসুমে দুবার পানির পাম্পের মোটর নষ্ট হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এবার মৌসুমের শুরুতেই দেখা দিয়েছে তীব্র বিদ্যুৎ সংকট। দিনরাতে ১৪-১৫ বার শোডশেডিং হচ্ছে। ফলে পানির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুতের আশায় বসে থাকতে হচ্ছে।'
বরিশালের মুলাদির কৃষক মোশারফ হোসেন জানান, সাত দিন রাত জেগে তিনি তাঁর বোরো জমির মাত্র এক-তৃতীয়াংশে সেচ দিতে পেরেছেন। তিনি বলেন, দিনে দু-এক ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকে না।
বরিশাল ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানির (ওজোপাডিকো) নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হিসাবে, বরিশাল সিটি করপোরেশন, সদর উপজেলা, মুলাদি, মেহেন্দীগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, বাকেরগঞ্জ, স্বরূপকাঠি, নলছিটি ও ঝালকাঠি সদর উপজেলায় বিদ্যুতের গড় চাহিদা দিনে ৪২ এবং রাতে ৬০ মেগাওয়াট। অথচ গত ৪ ফেব্রুয়ারি বরাদ্দ মেলে দিনে ৩০ এবং রাতে ৩২ মেগাওয়াট। তাঁরা জানান, গত বছর শুধু সেচের জন্য দুই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বরাদ্দ করেছিল সরকার। এ বছর তাও নেই।
কৃষি অধিদপ্তর বরিশাল অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মো. শাহ্ আলম কালের কণ্ঠকে জানান, এবার বরিশাল কৃষি অঞ্চলের ১১ জেলার ৩৫ লাখ এক হাজার ৪৬৬ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে ২২ লাখ তিন হাজার ১১৪ হেক্টরে চাষ শেষ হয়েছে, যার শতকরা হারে ৬৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। দ্রুতই অবশিষ্ট জমি চাষ হয়ে যাবে।
বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম ঠাণ্ডু কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে বিএমডিএর ১২ হাজার ৬৯৭টি পাম্পের দৈনিক চাহিদা ৫৫০ মেগাওয়াট হলেও সরবরাহ মিলছে ৩৩০ থেকে ৩৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। তবে ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে মার্চ মাসে বিদ্যুৎ বিভ্রাট যাতে না হয়, সে ব্যবস্থা নিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
পিডিবি বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী ইস্কেন্দার আরিফ বলেন, বগুড়ায় বিদ্যুতের চাহিদা প্রতিদিন ১০৮ মেগাওয়াট হলেও সরবরাহ গড়ে মাত্র ৫২ মেগাওয়াট।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এবারের বোরো মৌসুমে ৪৭ লাখ ৫০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয় লাখ ৫০ হেক্টরে হাইব্রিড, ৫০ হাজার হেক্টরে স্থানীয় জাত এবং অবশিষ্ট ৪০ লাখ ৫০ হাজার হেক্টরে দেশি উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের ধান চাষ হচ্ছে। তবে উৎপাদন চিত্র নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হিসাবের গরমিল করার কারণে এবারই প্রথমবারের মতো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি।
পানির স্তর নামছেই : তিন বছর ধরে ক্রমেই বৃষ্টি কমছে। ফলে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাম্প্রতিক করা গবেষণা তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে অধ্যাপক ড. গোলাম সাবি্বর সাত্তার তাপু বলেন, বৃষ্টির অভাবে উত্তরাঞ্চলে ভূমির আর্দ্রতা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। পাউবোর সাবেক প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম বলেন, ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে সংশ্লিষ্ট নদ-নদীগুলো বেশির ভাগ সময় শুষ্ক থাকছে। তিনি জানান, উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্রভূমিতে ১৯৯১ সালে পানির স্তর ছিল ভূগর্ভের ৬২ ফুটের মধ্যে। ২০০০ সালে তা ১১০ ফুটে নেমে যায়। এখন এ স্তর স্থানভেদে ১২০ থেকে ১৪০ ফুটের মধ্যে। বিষয়টি আতঙ্কজনক।

No comments:

Post a Comment