Friday, January 28, 2011

অস্ত্রশিল্পের বিকাশ মানবতার প্রতি নিষ্ঠুর অবিচার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্রশিল্পের অব্যাহত বিকাশকে মানবতার প্রতি ‘নিষ্ঠুর অবিচার’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। অক্সফোর্ড ইউনিয়নে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ‘বিশ্ব শান্তি’র ওপর বক্তব্য দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি খুবই মর্মান্তিক।
এই ধ্বংসাত্বক শিল্পের আকার ও ব্যয় সামান্য কমানো হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নিতান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসরত কোটি কোটি মানুষ উপকৃত হতো। তিনি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে অস্ত্রের পেছনে আমরা যত বেশি ব্যয় করব দারিদ্র্য বিমোচন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দরিদ্রদের ক্ষমতায়নের জন্য আমাদের সামর্থ্য ততই কমে যাবে।’

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাজ্য র‌্যাবকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উড়িয়ে দিয়েছেন। এর আগে তিনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে বৈঠক করেন। খবর বাসস, ইউএনবি ও বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর। অক্সফোর্ড ইউনিয়নের মেইন চেম্বার হলে বিশ্ব শান্তির ওপর বক্তৃতায় শেখ হাসিনা গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বিশাল মজুদ সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যাওয়ার বিপজ্জনক আশঙ্কা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশসহ অনুন্নত দেশগুলোর দারিদ্র্যের প্রকট চিত্রের বিপরীতে উন্নত বিশ্বের বেপরোয়া জীবনযাত্রা অবিচারের আরেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই বঞ্চনা এমন এক মানসিকতার জন্ম দেয়, যা প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টির উর্বর ক্ষেত্র। শেখ হাসিনা সব জাতি ও নাগরিককে বৈষম্য এবং শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, শান্তি ও সমৃদ্ধির বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় সব জাতি ও নাগরিককে এক হয়ে সব ধরনের কুসংস্কার, বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
বিশিষ্ট ব্যক্তি, ফ্যাকাল্টি মেম্বার এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অক্সফোর্ড ইউনিয়নের এ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ফোরামে শেখ হাসিনা বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠা এখনো চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। তবে এই লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিগত দশকগুলোতে ব্রিটেনের কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এ ফোরামে বক্তব্য দেন।

শেখ হাসিনা বলেন, অবিচার এমন সব কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত মূল্যবোধ ও আইনকানুনের পরিপন্থী। আর এটা বিভিন্ন ঘর, সম্প্রদায়, সমাজ ও জাতির মধ্যে সংঘটিত হতে পারে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশ-জাতির জন্য শান্তি অর্জনে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার জন্য সুবিচার, মর্যাদা, অধিকার ও স্বাধীনতার সংগ্রামে আমাদের সবার অবশ্যই আন্তরিকভাবে হাত মেলাতে হবে।’

শেখ হাসিনা বলেন, দেশের অভ্যন্তরে এবং এক দেশ কর্তৃক অন্য দেশের মানুষের নাগরিক, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগত অধিকারের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন ও দমনমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট অবিচারের পরিণতিতে শান্তি বিনষ্ট হয়। ‘যত বৈষম্য তত সংঘাত’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইতিহাস জাতির অভ্যন্তরে অধিকার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সত্যের বিজয়ের মাধ্যমে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার বিপ্লব বারবার প্রত্যক্ষ করেছে। দেশের অভ্যন্তরে শান্তি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার কথা পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, তাঁর সরকার গণতন্ত্র সুসংহত, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দারিদ্র্য বিমোচনের সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার উদাহরণ হিসেবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার সম্পন্ন, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ এবং ১৯৯৭ সালে যুগান্তকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি করার কথা উল্লেখ করেন।

পরে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা কি বিশ্বাস করেন, নিজেদের নাগরিক হত্যা করতে র‌্যাবকে যুক্তরাজ্য প্রশিক্ষণ দিয়েছে? অবশ্যই নয়।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘র‌্যাবকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে মানুষকে রক্ষার জন্য।’ শেখ হাসিনা আরো বলেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি ও তাঁর সরকার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, অপরাধ করার পর অপরাধীদের আইনি সাহায্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা মানবাধিকারে বিশ্বাস করি।’
বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মের অনুপস্থিতি নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্ম আমাদের বিশ্বাস ও চর্চা...সব ধর্মের মানুষ বাংলাদেশে সার্বিক স্বাধীনতা ভোগ করে।’ বাংলাদেশে প্রতিহিংসার রাজনীতি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তাঁর সরকার সংসদে বিরোধী দলের নেতার ও বিরোধী দলের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে। বিরোধী দল অচিরেই সংসদে ফিরে আসবে বলেও তিনি আশা করেন। এ ছাড়া পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দেশ দুটির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, দ্বিপক্ষীয় কিছু বিষয়ে কিছু সমস্যা এখনো রয়ে গেলেও উভয় পক্ষই তা সমাধানে তৎপর রয়েছে।
ক্যামেরন-হাসিনা বৈঠক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্য সফরের দ্বিতীয় দিনে গতকাল সকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে লন্ডনে তাঁর সরকারি কার্যালয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে বৈঠক করেন। আন্তরিক পরিবেশে প্রায় ৪০ মিনিট দুই নেতার বৈঠক চলে বলে জানান লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার রাশেদ চৌধুরী।
রাশেদ চৌধুরী জানান, দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোই আলোচনায় স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে নেওয়া ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রশংসা করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। তিনি অর্থনৈতিক খাতসহ অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশকে দেওয়া সহযোগিতা অব্যাহত রাখা হবে বলে জানান। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্কুল-ফিডিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার কথাও বলেন ডেভিড ক্যামেরন। সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি এ বিষয়ে দুই দেশের সহযোগিতার সম্পর্ক অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।
এ সময় মানবাধিকার সংরক্ষণসহ অন্যান্য ইস্যুও আলোচনায় স্থান পায় বলে জানিয়েছেন প্রেস মিনিস্টার রাশেদ চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রতি অব্যাহত সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ভবিষ্যতে তা আরো বাড়ানোর জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা, সিলেটের মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, ব্রিটেনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ড. সাইদুর রহমান খান, অ্যাম্বাসাডর অ্যাট লার্জ এম জিয়াউদ্দিন প্রমুখ।
লন্ডনের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শেখ হাসিনা ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে পৌঁছান। সে সময় মূল ফটকের বাইরে বেরিয়ে এসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান। দুই প্রধানমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকর্মীদের ছবি তোলার সুযোগ দেন। পরে শেখ হাসিনাকে নিয়ে ডেভিড ক্যামেরন তাঁর অফিসকক্ষে যান। সেখানে দুই প্রধানমন্ত্রী একান্ত আলোচনায় বসেন।

No comments:

Post a Comment