Thursday, May 26, 2011

রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত জাতীয় কবি

কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বিদ্রোহের কিংবা প্রেমের কবিই নন, তিনি আমাদের জাতীয় কবিও। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে এ মর্যাদা দেওয়া হলেও তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণ এবং সৃষ্টিকর্মের প্রসারে নেই আন্তরিক কোনো উদ্যোগ। নজরুল গবেষকরা জানান, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, গণমাধ্যম থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠক্রমেও অবহেলিত এ কবি। সরকারি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও তিনি উপেক্ষিত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী বাংলাদেশ ও ভারত একসঙ্গে উদ্‌যাপন করলেও নজরুলজয়ন্তী পালনের ক্ষেত্রে এমন কোনো চিন্তা সরকারের নেই।


জানা যায়, দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নজরুল জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হলেও প্রচারের অভাবে এটি পড়ে রয়েছে অন্তরালে। একই অবস্থা নজরুলবিষয়ক ওয়েবসাইটেরও। বন্ধ হয়ে গেছে নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত স্থানকেন্দ্রিক পর্যটন কার্যক্রম। এ অবস্থায় আজ মঙ্গলবার সারা দেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় কবির ১১২তম জন্মোৎসব।
জাতীয় কবির মৃত্যুর সাড়ে তিন দশক পরও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রকাশ সম্ভব হয়নি তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী। নির্মাণ করা হয়নি কোনো তথ্যচিত্র। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে নজরুল এখনো অনেকটাই অচেনা, অজানা।
নজরুলের স্মৃতিধন্য স্থানগুলোকে ঘিরে বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিলেও কখনোই সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও নজরদারি না থাকায় নজরুলের নামে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধের পথে। এ সবের পাশাপাশি চলচ্চিত্র, সাংবাদিকতা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য নজরুলের নামে জাতীয় পর্যায়ে আজও কোনো পদক বা পুরস্কার চালু করা হয়নি।
নজরুলের সাহিত্য ও সংগীত বিষয়ে গবেষণার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নেই পর্যাপ্ত বাজেট। জানা যায়, নজরুল ইনস্টিটিউটের গবেষণা ও প্রকাশনা খাত মিলিয়ে বাজেট ১৫ লাখ টাকা। আর নজরুলের নামে একমাত্র সরকারি এই প্রতিষ্ঠানে গবেষকের পদ মাত্র একটি। অন্যদিকে পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা না পাওয়ায় গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান 'নজরুল একাডেমী' এখন গবেষণার কাজ বাদ দিয়ে শুধু সংগীতচর্চাকেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে।
গবেষক অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নজরুল বিষয়ে গবেষণার দুঃখজনক দিক হচ্ছে, যাঁরা এ বিষয়ে পিএইচডি করেন, তাঁরা চাকরি পান না। আমি আমার তত্ত্বাবধানে এ পর্যন্ত পাঁচজন শিক্ষার্র্থীকে পিএইচডি করিয়েছি। তাঁদের কারোরই চাকরি হচ্ছে না।'
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতেও উপেক্ষিত জাতীয় কবি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাংলা বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে তাঁর রচনা পড়ানো হয় মাত্র ২৬ নম্বরের জন্য। আর সেটাও ঐচ্ছিক, আবশ্যিক নয়। শিক্ষাবিদদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা বিষয়ে পাঠ্যসূচি সাজানো হয়েছে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত পাঠক্রম দিয়ে। নজরুলের ব্রিটিশবিরোধী ভূমিকা আড়াল করার উদ্দেশ্যেই ওই মডেলকে অনুসরণ করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠসূচিতে জাতীয় কবি হিসেবে নজরুলের রচনা এক শ নম্বরে আবশ্যক করার প্রস্তাব দিয়ে বেশ কয়েকবার তিনি তিরস্কৃত হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির সংগীত বিভাগেও অবহেলিত ক্ষণজন্মা এই সংগীতস্রষ্টা। সংগীত বিভাগে পাঁচজন রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষকের বিপরীতে নজরুলসংগীতের শিক্ষক রয়েছেন মাত্র একজন। কবির স্মৃতিধন্য ময়মনসিংহের ত্রিশালে তাঁর নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলেও সেখানে যেসব বিভাগ খোলার কথা ছিল, তার বেশির ভাগই খোলা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টি শুধু নজরুলের নামে করেই যেন তাঁর প্রতি দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে রাষ্ট্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্কুল ও কলেজের পাঠ্যক্রমেও সেভাবে স্থান পাচ্ছে না জাতীয় কবির রচনাবলি।
সংস্কৃতি ও সাহিত্য নিয়ে দেশের একমাত্র গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমীতেও উপেক্ষিত নজরুল। একাডেমী খ্যাতিমানদের পাশাপাশি অনেক অখ্যাত ব্যক্তির জীবনী প্রকাশ করলেও জাতীয় কবির জীবনী প্রকাশ করেনি। এখনো পূর্ণাঙ্গ নজরুল রচনাবলি প্রকাশ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। কবির অনেক বই এখন পুনর্মুদ্রণ করার মতো সময় নেই বাংলা একাডেমীর! জানা যায়, ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমীকে নজরুলের শতাধিক গানের স্বরলিপি সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম। অনেক বছর কেটে যাওয়ার পর তিন খণ্ডে স্বরলিপি প্রকাশ করা হলেও, পরে তা আর প্রকাশ করা হয়নি। একই সঙ্গে, একাডেমীতে নির্মিত 'নজরুল মঞ্চ' বইমেলার সময় ছাড়া ব্যবহার করা হয় না। বইমেলার সময় মোড়ক উন্মোচন করার কাজে এই মঞ্চটি ব্যবহৃত হয়। বাকি সময় মঞ্চটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে।
সরকারি আরেকটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত আড়াই শতাধিক বই, এগারোজন শিল্পীর চিত্রপ্রতিলিপি, বিশজন শিল্পীর চিত্রকর্মের ভিউকার্ড প্রকাশ করেছে। অনেক বিদেশি শিল্পীর চিত্রকর্ম নিয়ে বই প্রকাশিত হলেও নজরুলের আঁকা চিত্রকর্মের বই প্রকাশ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। একইভাবে তাঁর নাটক, চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত বইও একাডেমী প্রকাশ করেনি। শিল্পকলা একাডেমী নিজস্ব প্রযোজনায় নাটক নির্মাণ করলেও, তাতে ঠাঁই হয় না নজরুলের। অথচ বিদেশি নাট্যকারের নাটক অহরহ প্রযোজনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু নজরুলের লেখা আশিটি নাটকের একটিও এখনো প্রযোজনা করেনি শিল্পকলা একাডেমী।
জাতীয় কবির গান এখন অবহেলিত। নজরুলের প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মতো গান রয়েছে। কিন্তু সব গান না বাজিয়ে ঘুরেফিরে শ'খানেক গানের মধ্যেই আটকে আছে নজরুলসংগীতের চর্চা। সরকারি বেতার-টেলিভিশনেও নজরুলবিষয়ক অনুষ্ঠান ও নজরুলসংগীতের প্রচার বাড়েনি। এমনকি দেশের রণসংগীতও অবহেলিত। সেনাবাহিনীর রণসংগীত 'চল চল চল' নজরুলের লেখা। কিন্তু সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রণসংগীতকে বাদ দিয়ে বাজানো হয় অন্যান্য দেশাত্মবোধক গান। এমনকি জাতীয় প্যারেডের সময়ও তেমন মর্যাদা পায় না গানটি। আর দশটি গানের মতোই বাজানো হয় এটি।
কবির স্মৃতিধন্য স্থানগুলো রক্ষণাবেক্ষণের কার্যকর উদ্যোগ নেই। সংরক্ষিত না হওয়ায় বদলে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছে কবির স্মৃতিচিহ্ন। অন্যান্য দেশে জাতীয় কবির স্মৃতিজড়িত সব স্থান সংরক্ষণের আওতায় নেওয়া হলেও, এদেশে তা হয়নি। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কবির স্মৃতিবিজড়িত স্থান, স্থাপনাগুলো দেখার সুযোগ করে দিতে নজরুল ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন 'নজরুল পর্যটন' চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল ২০০৬ সালের ২১ জানুয়ারি। এ কার্যক্রম গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে বন্ধ। এ প্রসঙ্গে নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক রশীদ হায়দার বলেন, নজরুলের স্মৃতিধন্য স্থানগুলোর সংস্কার চলছে। সংস্কার সম্পন্ন হলে এই প্রকল্প আবার শুরু হবে।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নজরুল চিকিৎসাধীন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দোতলার ১১৭ নম্বর কক্ষে। এ কক্ষটিও সংরক্ষিত নয়।
নজরুল ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ঢাকায় নজরুলের স্মৃতিধন্য ৩১টি স্থান রয়েছে। সেসব স্থান সংরক্ষণ এবং সেখানে স্মৃতিফলক বসানোর জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) কাছে নজরুল ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে ২০০৬ সালে আবেদন করা হয়েছিল। সে আবেদনে সাড়া দেয়নি ডিসিসি। ১৯৭২ সালের ২৪ মে থেকে ১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই পর্যন্ত কবি ধানমণ্ডির যে বাড়িতে বাস ছিলেন, পরিকল্পনার অভাবে সে বাড়িটি এখন লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে। বাড়ির সামনের যে বাগানে কবি হাঁটতেন, তা পরিণত হয়েছে গ্যারেজে। এভাবেই জাতীয় কবিকে অবহেলিত করে রাখা হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পরিকল্পনাও নেই সরকারের।

No comments:

Post a Comment