Wednesday, January 26, 2011

সরকারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড

মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের জোরালো প্রতিশ্রুতি থাকলেও দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি-দুটোই অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ)।

সংস্থাটির গত সোমবার প্রকাশিত বিশ্ব প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে আরো বলা হয়, এ দেশে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও অন্য বাহিনীগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। সুধী সমাজ ও গণমাধ্যমের ওপর আঘাত এসেছে। নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন পোশাক শিল্প শ্রমিকরা। আর এসবের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দায়মুক্তি পেয়েছেন।
প্রতিবেদনে সিডও সনদের ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের অনুস্বাক্ষর না করার এবং সমকামিতার অপরাধে এ দেশে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থাকার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া সীমান্তে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে এ দেশের জনগণের হতাহত হওয়া এবং দুর্নীতির মামলা তদন্তে বৈষম্য ইত্যাদি বিষয় স্থান পেয়েছে প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারে দেওয়া জোরালো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতন যেমন চলছে, তেমনি এর জন্য দায়ী আইনশৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দায়মুক্তি পেয়েছেন। এ ছাড়া সরকার গণমাধ্যম ও বিরোধী দলের স্বাধীন মত প্রকাশের ওপরও আঘাত করেছে। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকরা ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনের লক্ষ্য। অনেক ক্ষেত্রে তাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারেও পাঠানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরপরই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মেনে না নেওয়ার এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু ২০১০ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। র‌্যাব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্য বাহিনীগুলোর কোনো ভুল করার কথাও অস্বীকার করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্য কর্মকর্তারা। র‌্যাব স্বীকার করেছে, ২০০৪ সালে বাহিনীটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে গোলাগুলির সময় ‘ক্রসফায়ারে’ কমপক্ষে ৬২২ জন নিহত হয়েছে। র‌্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, অপরাধীদের সহযোগীরা র‌্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার পর আÍরক্ষার্থে তাঁরাও গুলি ছোড়েন এবং ‘ক্রসফায়ারে’ পড়ে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ ও র‌্যাব ওই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডতত্ত্ব প্রয়োগ করে কয়েক শ মানুষকে হত্যা করেছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, র‌্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায়ই অনেককে হত্যা করা হয়েছে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন র‌্যাবের বিরুদ্ধে সব হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন কমিশন গঠন করার সুপারিশ করলেও এখনো একজনেরও বিচার হয়নি। এদিকে ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে ক্রসফায়ারে লুৎফর ও খায়রুল খালাসী নিহত হওয়ার ঘটনায় র‌্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে নাÑতা স্বপ্রণোদিত হয়ে হাইকোর্ট সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। তবে এ ব্যাপারে আর কোনো আদেশ জারি হওয়ার আগেই ওই বিচারকদের বেঞ্চ পুনর্গঠন করা হয়। এর পর ওই মামলার আর শুনানি হয়নি।
প্রতিবেদনে দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, মাহমুদুর রহমান আদালতে অভিযোগ করেন, পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তারা তাঁকে নির্যাতন করেছেন। এ ছাড়া গত বছরের ২২ মার্চ দৃক আয়োজিত ‘ক্রসফায়ার’ শীর্ষক প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়ার কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০১০ সালে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে আন্দোলনরত পোশাক শ্রমিকদের ওপর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের হামলার পাশাপাশি ওই আন্দোলনকে উসকে দেওয়ার অভিযোগে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির (বিসিডাব্লিউএস) পরিচালকদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালানোর বিষয় প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে।
প্রতিবেদনে দায়মুক্তি শিরোনামে এক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ সত্ত্বেও ২০১০ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দায়মুক্তি পেয়েছেন।
এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে বলা হয়েছে, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করে এ বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা এখনো আন্তর্জাতিক মানের হয়নি। গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর জামায়াতে ইসলামীর পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করার পর থেকে বিচারের অপেক্ষায় রাখা হয়েছে।
সিডও সনদের ২ নম্বর অনুচ্ছেদ বাংলাদেশ এখনো অনুস্বাক্ষর করেনি উল্লেখ করে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে আইন ও নীতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
সীমান্তে হত্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ২০০০ সাল থেকে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কমপক্ষে ৯৩০ জন বাংলাদেশি বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সীমান্তে হত্যা বন্ধে সংযম প্রদর্শনের আশ্বাস দিলেও বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না।
দুর্নীতির মামলায় বৈষম্য অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় সংকল্পের কথা বললেও রাজনৈতিক হয়রানি বিবেচনায় তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে।
রোহিঙ্গাদের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ ছাড়া নতুন করে কোনো রোহিঙ্গাকে শরণার্থী হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশি রাষ্ট্রগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও দায়মুক্তির ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পোশাক শিল্পের শীর্ষ শ্রমিক নেতাদের গ্রেপ্তারের পর গত বছরের আগস্ট মাসে মার্কিন কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পোশাক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে পোশাক শ্রমিকদের মুক্ত করার আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া মার্কিন কংগ্রেস শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশকে জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (জিএসপি) সুবিধা না দেওয়ারও আহ্বান জানায়।

No comments:

Post a Comment