Thursday, October 04, 2012

বৌদ্ধ জনপদে হামলাঃ বৌদ্ধদের কাছে গিয়ে এখন হামলাকারীদের মায়াকান্না!

কক্সবাজারের রামু উপজেলা সদরে গত শনিবার রাতে যে সমাবেশ ও মিছিলের পর বৌদ্ধপল্লীতে ভয়াবহ হামলা হয়, সেই মিছিল-সমাবেশের হোতাদের পুলিশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার কথা শোনা যাচ্ছে।

ওই ব্যক্তিরা এখন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছে, ধ্বংসযজ্ঞের জন্য মায়াকান্না করছে। এতে বৌদ্ধরা সেই রাতের ঘটনা নিয়ে নতুন নতুন তথ্য জেনেও পুলিশের তদন্তের ওপর আস্থা আনতে পারছে না। ওই মিছিলকারীরাই বৌদ্ধ জনপদে হামলা চালায় বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, সেই রাতে বৌদ্ধপল্লীমুখী মিছিল যাওয়ার সময় ৩০-৪০টি মোটরসাইকেল নিয়ে তৎপর ছিল ৬০ থেকে ৭০ জন তরুণ। তারা এখন পুলিশের সামনেই ঘোরাফেরা করছে। এসব নিয়ে পুলিশের প্রতি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ক্ষোভ আরো বাড়ছে। তাদের মধ্যে আতঙ্কও বিরাজ করছে। গতকাল মঙ্গলবার রামুর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো ঘুরে জানা গেছে এসব তথ্য।
গত সোমবার রাত পর্যন্ত কক্সবাজার জেলার চারটি উপজেলায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর সহিংস ঘটনা নিয়ে ৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নতুন কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আকতার কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, রাতে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো হবে। এদিকে রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের পানেরছড়া রাখাইনপল্লীতে একদল সন্ত্রাসী নতুন করে হামলার হুমকি দেওয়ায় সেখানে গতকাল সকাল থেকে সেনা ও বিজিবি টহল জোরদার করা হয়েছে।
রামুর প্রথম মিছিলকারীদের কর্মকাণ্ড
এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে পবিত্র কোরআনের অবমাননার ছবি সংযুক্ত করার অভিযোগ নিয়ে শনিবার রাতে রামু বাসস্ট্যান্ডে প্রথম বিক্ষোভ মিছিলকারীরাই এখন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সদস্যদের সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে। তারা পুলিশের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে পরিত্রাণের পথ খুঁজছে বলে অভিযোগ করেছে বৌদ্ধপল্লীর লোকজন। রামুর মেরুংলোয়া বড়ুয়াপাড়ার সুলক বড়ুয়া, পিন্টু বড়ুয়া, সুজন বড়ুয়া ও রাজু বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে জানান, সেদিন রাতে রামু উপজেলা সদরের বাসিন্দা এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নুরুল ইসলাম সেলিম; ফতেখাঁরকুল ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ও বিএনপি নেতা মিজান উদ্দিন, মণ্ডলপাড়ার জাহাঙ্গীর ও আনসারুল হক ভুট্টোসহ ৩০ থেকে ৪০ জনের একটি দল মিছিল করে বৌদ্ধ যুবকটির শাস্তি দাবি করেছিল। তাদের সেই মিছিলের পর থেকেই আশপাশের এলাকা থেকে দলে দলে লোকজন মিছিল নিয়ে আসতে থাকে। জেলা বৌদ্ধ সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রাখাল বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, সেই রাতের প্রথম মিছিলকারীরা সংখ্যায় ছিল খুবই কম। তাদের মিছিলের পর ধীরে ধীরে মিছিলকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রথম মিছিলকারীদের ইন্ধন থেকেই বৌদ্ধপল্লীতে এ রকম ভয়াল ঘটনা ঘটে গেছে বলে মনে করে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন। অথচ ওই মিছিলকারীরাই এখন পুলিশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং তারাই বৌদ্ধদের জন্য সবচেয়ে বেশি কান্নাকাটি করে চলেছে। বৌদ্ধ সম্প্র্রদায়ের লোকজন এসব মুখোশধারীর আসল রূপ উদ্ঘাটনের দাবি জানিয়েছে।
এদিকে রামুর আওয়ামী ঘরানার নেতা নুরুল ইসলাম সেলিম এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে তা সঠিক নয়। তিনি বলেন, 'আমি বরাবরই বৌদ্ধদের সুখ-দুঃখের সঙ্গে জড়িত।' বিএনপি নেতা মিজান উদ্দিনও তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন।
মোটরসাইকেল আরোহীরা কারা : শনিবার রাতে রামুর বৌদ্ধপল্লীর দিকে মিছিল যাওয়ার সময় ৩০-৪০টি মোটরসাইকেলে ছিল ৬০ থেকে ৭০ জন তরুণ। এসব তরুণের হাতেই ছিল জেরিকেন। অগ্নিসংযোগে এসব জেরিকেনে থাকা পেট্রল, অকটেন, কেরোসিন ব্যবহার করা হয়। বৌদ্ধপল্লীর লোকজন অভিযোগ করেছে, ওই তরুণদের অনেকে এখন পুলিশের সামনেই ঘোরাফেরা করছে দাপটের সঙ্গে। এ পর্যন্ত পুলিশ তাদের কারো পরিচয়ই উদ্ধার করে কোনো ব্যবস্থা নিতে পেরেছে বলে জানা যায়নি।
হাফেজ আবদুল হকের জঙ্গি কানেকশন : রামুর বৌদ্ধপল্লীতে সহিংস ঘটনার সময় মোবাইল ফোনে বিভিন্ন এলাকার লোকজনকে জড়ো করার কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে হাফেজ মওলানা আবদুল হকের বিরুদ্ধে। গত জুন মাসে তিনি কক্সবাজার শহরের একটি হোটেলে জঙ্গিদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করার সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি কামরুল হাসান গতকাল কালের কণ্ঠকে এ তথ্য জানিয়ে বলেন, শহরের লালদিঘীর পারের হোটেল পালংকীতে বৈঠকের সময় হাফেজ আবদুল হকসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। তিনি জামায়াত নেতা হিসেবে পরিচিত হলেও ইসলামী ঐক্যজোটের কক্সবাজার জেলার সহসভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। পাশাপাশি তিনি রামুর জোয়ারিয়ানালা মাদ্রাসার সুপার। জানা গেছে, রামু কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম থাকার সময় নানা অভিযোগে তাঁকে সেখান থেকে বিদায় করা হয়।
নতুন করে হুমকি রাখাইনপল্লীতে : কক্সবাজারের রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের পানেরছড়া রাখাইনপল্লীতে হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। এ পল্লীর বাসিন্দারা জানিয়েছে, দক্ষিণ মিঠাছড়ির সমিতিপাড়ার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী শাহাবুদ্দিন, পুথিয়া, হাবিবুল্লাহ, মোহাম্মদ কালু ও নুরুল হুদা নামের একদল সন্ত্রাসী তাদের হুমকি দিয়েছে। প্রশাসনকে এ তথ্য জানানোর পর গতকাল সকাল থেকে সেখানে সেনা ও বিজিবি সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পুলিশকে দেওয়া তালিকা : হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িতদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে। অভিযুক্তরা হলেন লট উখিয়ার ঘোনা, ইউনিয়ন, কাউয়ারখোপের মৌলবি শফিক আহাম্মদ, পিতা মৃত নুর আহম্মদ, গ্রাম পশ্চিম গনিয়াকাটা; হাফেজ হাবিবুল্লাহ, পিতা মৌলবি সিকান্দার, গ্রাম লামারপাড়া, উখিয়ার ঘোনা; ফরিদ আহাম্মদ, পিতা মৃত ছালেহ আহম্মদ, গ্রাম স্কুল পাহাড়; রশিদ আহাম্মদ, পিতা মৃত ছালেহ আহম্মদ, গ্রাম স্কুল পাহাড়; মহিউদ্দিন, পিতা সিরাজুল হক, গ্রাম স্কুল পাহাড়; নুর আহাম্মদ, পিতা মৃত মণ্ডল, গ্রাম স্কুল পাহাড়; মৌলবি আবদুল রশিদ, পিতা মো. হোছন, গ্রাম স্কুল পাহাড়; আবুল ছৈয়দ, পিতা মৃত মণ্ডল আহমদ, গ্রাম গনিয়াকাটা; হানিফ, পিতা মৃত আলী আহমদ, গ্রাম গনিয়াকাটা; ছবি্বর আহমদ, পিতা মো. কালু, গ্রাম লট উখিয়ার ঘোনা; বদিউল আলম, পিতা কাছি, গ্রাম লট উখিয়ার ঘোনা; রাহামত উল্লাহ, পিতা জাফর আলম, গ্রাম উখিয়ার ঘোনা; বড়ুয়াপাড়া, আবদুল কাদের, পিতা জাফর আলম, গ্রাম উখিয়ার ঘোনা, বড়ুয়াপাড়া; জাফর আলম, পিতা ফজরত আলী, গ্রাম উখিয়ার ঘোনা, বড়ুয়াপাড়া; আবদুছ ছালাম, পিতা মৃত ছুরুত আলম, গ্রাম তচ্ছাখালী, উখিয়ার ঘোনা; সৈয়দ আলম, পিতা মৃত এজাহার মিয়া, গ্রাম টেইলাপাড়া, উখিয়ার ঘোনা; মৌলবি নুরুল ইসলাম, পিতা মৃত আবদুছ ছোবাহান, উখিয়ার ঘোনা; আবদুল্লাহ, পিতা আবদুর রহমান, স্কুল পাহাড়, উখিয়ার ঘোনা; সেয়াফত আলী, পিতা মৃত শুক্কুর, গ্রাম টেইলাপাড়া, উখিয়ার ঘোনা; হেলাল, পিতা মৃত আবদুল, গ্রাম রাবার বাগানের পাশে; ফজল, পিতা মৃত মোজাহের আলী, গ্রাম স্কুল পাহাড়, উখিয়ার ঘোনা; ওয়াদুল, পিতা সাহেব মিয়া, গ্রাম সওদাগরপাড়া, উখিয়ার ঘোনা; সাদ্দাম হোসেন, পিতা জাফর, গ্রাম সওদাগরপাড়া, উখিয়ার ঘোনা; রমজান আলী, পিতা দুদু মিয়া, গ্রাম স্কুল পাহাড়, উখিয়ার ঘোনা; ওসমান গণি, পিতা দুদু মিয়া, গ্রাম স্কুল পাহাড়, উখিয়ার ঘোনা। সাতঘরিয়াপাড়া, রামু কলেজের সামনে, মোজাফ্ফর আহমদ (আলবদর কমান্ডার), পিতা মৃত গোলাম কবির, সাতঘরিয়াপাড়া, আমিনুর কবির, পিতা মোজাফ্ফর আহমদ (আলবদর কমান্ডার), সাতঘরিয়াপাড়া, শফিউল কবির, পিতা মোজাফ্ফর আহমদ (আলবদর কমান্ডার), সাতঘরিয়াপাড়া, সরওয়ার আলম, পিতা আবদুছ ছালাম, সাতঘরিয়াপাড়া।
ছিরামুরা, চাকমারকুলের আবুল কাশেম, পিতা মৃত গোলাম কাদের, আবদুল মাসুদ, পিতা আবুল কাশেম। শ্রীধনপাড়া, ফতেখাঁরকুলের দেলোয়ার হোসেন, পিতা ড্রাইভার নুরুল ইসলাম, আমতলীয়াপাড়া, জহির আহমদ, পিতা মৃত আহমইদ্যা, আমতলীয়াপাড়া, পূর্ব মেরংলোয়া, ফতেখাঁরকুলের দিদারুল আলম দিদার, পিতা মৃত শমসু মিয়া, মধ্যম মেরংলোয়া, আজিজ, পিতা মৃত শমসু মিয়া, মধ্যম মেরংলোয়া, জহির আহম্মদ (জহির ডেকোরেটর্স), চৌমুহনী, পিতা অজ্ঞাত, মধ্যম মেরংলোয়া। ভূতপাড়া, ফতেখাঁরকুলের গিয়াসউদ্দিন, পিতা আবদুছ ছোবাহান, ভূতপাড়া, ফতেখাঁরকুল। রামু বাজারের হাফেজ আহমদ, পিতা অজ্ঞাত, দক্ষিণ শ্রীকুলের মিজান মেম্বার, পিতা অজ্ঞাত, ফতেখাঁরকুল, সাফী, পিতা প্রবাসী, মাতা শিমুল, নুরুল উল্লাহ, পিতা গুরামিয়া, ইলিয়াস, পিতা মোজাহার মিস্ত্রি, রাজাকার, মেহেদী, পিতা অজ্ঞাত, মোহাম্মদ হানিফ, পিতা সুলতান আহমদ তেচ্ছিপুল, ফতেখাঁরকুলের আবুল কাশেম, পিতা মালেকুজ্জামান, তেচ্ছিপুল, সিরাজুল ইসলাম ভুট্টো চেয়ারম্যানের ছোট ভাই মৌলবি, পিতা রাজাকার মোহাম্মদ।

No comments:

Post a Comment