Thursday, October 04, 2012

কে ওদের অভয় দেবে?

ভর দুপুরে আশ্বিনের রোদহীন আকাশটাকে মনে হলো পুড়ে ছাই হওয়া বৌদ্ধপল্লির বেদনার ছবি। কক্সবাজারের ছোট্ট উপজেলা রামুর সদরও ছিল অস্বাভাবিক রকমের নীরব।

শহরের প্রায় মধ্যিখানে শ-তিনেক পরিবার নিয়ে বৌদ্ধপল্লিটি। তার ভেতরে ঢুকলে নৈঃশব্দ্য যেন আরও গাঢ় হলো। নাকে এসে লাগে ছাইয়ের গন্ধ। সরু গলি দিয়ে মূল বৌদ্ধবিহারের পথে হাতের ডানে নতুন কতগুলো তাঁবু। গত শনিবার রাতের আক্রমণে যাঁদের ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তাঁদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ওই সব তাঁবুর ব্যবস্থা। শূন্য তাঁবুর ভেতরে হাহাকার। কারণ তাঁদের চালচুলো, হাঁড়ি-পাতিল সবই গেছে। একটি তাঁবুর মুখে বেদনার্ত বদনে বসে আছেন এক বর্ষীয়ান নারী। শিশুরা খালি গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পুরুষেরা এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছেন।
রামুর বৌদ্ধপল্লিতে হামলার তৃতীয় দিনের চিত্র এটি। প্রথম দুদিনের চিত্র কেমন ছিল তা সহজেই অনুমেয়।
রামুর সবচেয়ে বড় সীমা বিহারের ভেতরে ঢুকলে পোড়া গন্ধটা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে কাঠের কাঠামো, একটি জায়গা থেকে তখনো কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। বিহারের একটি বারান্দায় পদ্মাসনে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তি। তাঁর চোখের মণিদুটো সাদা। ভুল ভাঙল যখন একজন এগিয়ে এসে বললেন, চোখের মণিদুটো ছিল অতি মূল্যবান পাথরের। আক্রমণকারীরা আগুন ধরিয়ে দেওয়ার আগে মণিদুটো খুলে নিয়েছে। বিশাল মূর্তিটির পায়ের কাছে লম্বা পাটাতন বরাবর ছোট ছোট আরও প্রায় অর্ধশত মূর্তি। কোনোটি ধাবত, কোনোটি পাথুরে। আগুনে কোনোটি জ্বলে গিয়ে রং হারিয়েছে, কোনোটি কালিলিপ্ত, কোনোটি ফেটে চৌচির। কয়েকটির মাথা পড়ে আছে কোলের কাছে। মূর্তিগুলোর পাশে দেখা গেল পোড়া ও আধাপোড়া ত্রিপিটক, আরও কিছু গ্রন্থ।
একই বিহারের আরেক পাশে বিশাল একটি ঘরের দরজা খুলে দিলেন একজন। জুতো খুলে ঢুকলাম সিংহবিহার বুদ্ধমূর্তির ঘরে। ভেতরে এক কনুইয়ে ঠেস দিয়ে আধাশোয়া বুদ্ধমূর্তি: তাঁর চোখদুটিতে বুদ্ধের স্বভাবসুলভ স্থৈর্য, কিন্তু নাকের একাংশ ভাঙা। আক্রমণ চলেছে এখানেও। ভাঙার চেষ্টাও চলেছে, কিন্তু বৌদ্ধমূর্তিটি কঠিন ধাতুতে গড়া। নাক ছাড়া তেমন কিছু ভাঙেনি। সেখানেও ছোট ছোট অনেক মূর্তি ভাঙা। একজন বললেন, অনেক মূর্তি আক্রমণকারীরা নিয়ে গেছে! একজন বললেন, ধাতব দানবাক্সের তালা খোলা হয়েছে ধাতু গলিয়ে। কী উপায়ে সেটা করা হয়েছে, সেটা তাঁর কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার।
হঠাৎ দরজার কাছ থেকে ভেসে এল নারীকণ্ঠে কান্নার শব্দ। তাকিয়ে দেখি, দরজার বাইরে হাঁটু গেড়ে বসে ভেতরের বৌদ্ধমূর্তির দিকে জোড়াহাত তুলে কাঁদছেন এক নারী: ‘ও ভগবান!’
অগ্নিসংযোগের ব্যাপারে প্রায় সবারই অভিযোগ, আক্রমণকারীরা আগুন লাগানোর আগে ‘গান পাউডার’ ও কেরোসিন ছিটিয়েছিলেন, ফলে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। গান পাউডার প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উক্তি। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কি গান পাউডার চেনেন? একজন বললেন, ‘সাদা সাদা পাউডারের মতো’। বারুদ ছিটানো হয়ে থাকতে পারে, কারণ ধাতব যেসব বুদ্ধমূর্তি আগুনে ফেটে গেছে, সেগুলোতে উচ্চমাত্রার তাপ সৃষ্টি হয়েছিল।
কথা হলো কয়েকজন ভিক্ষুর সঙ্গেও। তাঁরা বিশেষ কিছু বলছেন না; হতবাক হয়ে গেছেন। মনে পড়ল, ঘটনার পরদিন লাল চিং বৌদ্ধবিহারের ভিক্ষু ওয়েছেকা ছারা মহাথেরো (৮৭) বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা কোনো পাপ করেছিলাম। নইলে এমন ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে হলো কেন?’ একজনকে জিগ্যেস করলাম, আপনিও এ রকম মনে করেন? তিনি দূরে ধ্যানমগ্ন মণিহারা বুদ্ধের দিকে তাকালেন শুধু। কিছু বললেন না।
মূল চত্বরের ভস্মস্তূপের পাশে জড়ো হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে কিছু তরুণ-যুবক এগিয়ে এসে কথা শুরু করলেন। বর্ষীয়ান ওই ভিক্ষুর মতো তাঁরা মনে করেন না যে, এই আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞ তাঁদের কোনো অজানা পাপের ফল। ক্ষুব্ধ স্বরে তাঁরা অভিযোগ জানালেন। একের পর এক বলতে লাগলেন উত্তেজনা সৃষ্টিকারীদের নাম। তারপর বললেন, বাইরে উত্তেজনা দেখে বৌদ্ধ তরুণ-যুবকেরা এসে জড়ো হয়েছিলেন সীমা বিহারে, মূর্তি পাহারা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু থানার ওসি (এ কে নজিবুল ইসলাম) এসে তাঁদের বলেন, ‘আপনারা বাড়ি চলে যান, কেউ এখানে আক্রমণ করতে আসবে না। যদি আসে আমরা সেটা দেখব।’ তরুণ-যুবকেরা চলে যাওয়ার পর দলে দলে লোক এসে আক্রমণ শুরু করে। তাঁরা বললেন, ‘পুলিশ প্রশাসন চাইলে আক্রমণ অবশ্যই ঠেকাতে পারত, কিন্তু পুলিশ তা চায়নি।’
কয়েকজন মধ্যবয়সী নারী দাঁড়িয়ে আছেন এক পাশে। একজনের চোখে অশ্রুর দাগ। একজন বললেন, ‘আমাদের প্রতিবেশীরা “মোসলেম”। সারা জীবন আমরা পাশাপাশি বসবাস করি। কিন্তু হামলার সময় তারা কেউ আমাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি।’ ৬০ বছরের এক মহিলা বললেন, তিনি জীবনে কখনো কল্পনাও করেননি, তাঁদের সম্প্রদায়ের ওপর এ রকম হামলা হতে পারে। বাকি জীবন এখানে কীভাবে কাটাবেন এটাই এখন তাঁর সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয়। প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে, আর কোনো বিপদ নেই। কিন্তু তাঁরা ভরসা পাচ্ছেন না।
ঘুরে ঘুরে একের পর এক অনেক মানুষের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। লক্ষ করা হয়নি, আমার পিছু পিছু আসছিলেন এক মধ্যবয়সী লোক। হঠাৎ তাঁর চোখে চোখ পড়ল, তিনি নিজের পরনের জামাটি দেখিয়ে বললেন, ওই জামাটি তাঁর নিজের নয়। তাঁর নিজের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই, সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে। পাশে টেনে নিলাম তাঁকে। নাম জিজ্ঞেস করলে নামটি বললেন, সঙ্গে সঙ্গে অনুরোধ জানালেন, নামটি যেন না লিখি, কারণ তিনি ভীত। স্থানীয় একটি ব্যাংকে চাকরি করেন, দুই ছেলে, চার মেয়ে, স্ত্রী ও বাবাকে নিয়ে তাঁর পরিবার। ছেলেরা ঢাকায় পড়াশোনা করেন, বাকিদের নিয়ে তিনি বাস করেন ওই বৌদ্ধপল্লিতেই নিজের বাড়িতে। আধাপাকা বাড়িটিতে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটু পরে সেখানে ছুটে এলেন তাঁর এক মেয়ে। তিনি কাকতি-মিনতি করতে লাগলেন, তাঁদের বাড়িটি দেখতে যাওয়ার জন্য। সেখানে গিয়ে যা দেখলাম, তার বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। শুধু ইটের কয়েকটি দেয়াল ছাড়া পাঁচ ঘরের বাড়িটির সব কিছু ভস্ম হয়ে গেছে।
সিকি মাইল দূরের শ্রীকূল পাড়ায় লালচিং বৌদ্ধবিহারের ভস্মস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে ৭৮ বছর বয়সী বঙ্কিম বড়ুয়া বর্ণনা করছিলেন সেই রাতের বিভীষিকার কথা। তাঁর মনে রাজ্যের প্রশ্ন: ‘এত মানুষ কোত্থেকে এসেছিল? কারা এসব মানুষ? কেন আমাদের ওপর ওদের এত ক্রোধ? আমরা ওদের কী করেছি?’ বঙ্কিম বড়ুয়া ধর্মীয় অনুভূতির ওপর কথিত আঘাতের বিষয়টি ঠিকমতো বুঝতে পারছিলেন না বলে মনে হলো। কিন্তু এটা তিনি ঠিকই বুঝে ফেলেছেন, এই ঘর আর তাঁদের নিরাপদ নিবাস নয়। সরকারের কাছে এখন আপনারা কী চান? এই প্রশ্নের উত্তরে নিরাশ কণ্ঠে আঞ্চলিক ভাষায় যা বললেন, তা এই রকম, ‘সরকারের কাছে আর কী চাইব? এখন তো রাস্তা দেখতে হবে।’ কিসের রাস্তা? কোথায় যাবেন? এসব প্রশ্নের উত্তর তাঁর জানা নেই। কিন্তু তিনি ভয় পেয়ে গেছেন; আক্রমণ করা হয়েছে বেছে বেছে বৌদ্ধদের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয়গুলোতে, পাশের মুসলমান বাড়ি ও দোকানে একটি ঢিলও পড়েনি। এই কাজ শুধু বাইরের লোকেরা এসে করেনি, কারণ বাইরের লোক জানে না, কোন বাড়িটা বৌদ্ধের কোনটি মুসলমানের। বঙ্কিম বড়ুয়ার মনে ভয় ঢুকে গেছে এই কারণে যে, তাঁর প্রতিবেশীদের অনেকেও ছিলেন আক্রমণকারীদের সঙ্গে।
রামু থেকে ৩০-৩২ কিলোমিটার দূরে উত্তর মিঠাছড়ি হাজারিকুল বৌদ্ধবিহারের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীমৎ করুণাশ্রয়ী ভিক্ষুকে সান্ত্বনা ও অভয় দিচ্ছিলেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মোহাম্মদ জিল্লুল হক। কমান্ডার ভিক্ষুকে বলছিলেন, ‘আর কোনো ভয় নেই। আমরা সবখানে পর্যাপ্ত শক্তি নিয়ে এসেছি। আপনাদের কিছু হবে না। নিশ্চিন্ত থাকুন।’ কমান্ডার একটু দূরে চলে গেলে ভিক্ষুর মুখোমুখি হলাম। ভিক্ষু আমার চোখের দিকে চেয়ে বললেন, ‘কিন্তু আমরা কীভাবে নিশ্চিন্ত থাকতে পারি?’
দিনভর এখানকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, আক্রমণের ক্ষতিটা কেবল বৈষয়িক বা বস্তুগত নয়, আঘাতটা তীব্রভাবে লেগেছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মনে। তাঁদের বিশ্বাস টলে গেছে, চুরমার হয়ে গেছে নিরাপত্তার বোধ। এখন কে তাঁদের অভয় দেবে?

No comments:

Post a Comment