Thursday, October 04, 2012

বৌদ্ধ জনপদে হামলাঃ প্রশাসনের ওপর ঝরছে মানুষের ক্ষোভ

ভয়াল শনিবার রাতের কয়েক দিন পর রামুর মানুষ এখন প্রশ্ন করছে একে অন্যকে, কেন এমন ভয়ংকর ঘটনা ঘটল তাদের শান্তি-সম্প্রীতির জনপদে?

কোনো সম্প্রদায়ের মানুষই তো হাজার বছর ধরে এখানে কাউকে দূরের মানুষ বলে ভাবতে পারেনি। দুষ্কৃতকারীরা পরিকল্পনা এঁটে অগ্রসর হলেও কি সেটা থামানো সম্ভব ছিল না? ছোটখাটো সংঘর্ষেও পুলিশ কাঁদানে গ্যাস-ফাঁকা গুলি ছোড়ে, কিন্তু সে রাতে চারটি বৌদ্ধপল্লীর প্রতিটি ঘর-মন্দির থেকে চিৎকার উঠলেও, আগুনে পুরো রামুর আকাশ লাল হয়ে গেলেও পুলিশ একটি গুলি বা টিয়ার শেল ছোড়েনি। থানার ওসি ফোন ধরেননি, জেলা প্রশাসনের লোকজন মাত্র ১৭ কিলোমিটার দূরের ঘটনাস্থলে আসেন সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর। রামুর ক্যাম্পে প্রস্তুত থাকা সেনাবাহিনী ও বিজিবিকেও ডাকা হয় দেরিতে। মানুষের ক্ষোভ এখন ঝরছে প্রশাসনের ওপর।
সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি দায়ী করছেন রামু থানা থেকে এরই মধ্যে ক্লোজ হওয়া ওসি নজিবুল ইসলামকে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন মরিয়া হয়ে বারবার তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য বললেও তিনি সাড়া দেননি। উপজেলা প্রশাসনও তেমন কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। রাত ১১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত তাণ্ডব চললেও কক্সবাজার জেলা শহর থেকে পুলিশের পর্যাপ্ত ফোর্স পাঠানো হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে গেছেন রাত সাড়ে ৩টার পর। গতকাল বুধবার রামুর নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে এসব কথা।
'ভুবন শান্তি ১০০ ফুট সিংহশয্যা গৌতম বুদ্ধমূর্তি'র বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনাকেন্দ্রের পরিচালক করুণাশ্রী ভিক্ষু কালের কণ্ঠকে জানান, রাত ২টার দিকে তাঁদের বিহারে হামলার ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তরা বিহারটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ভোর পর্যন্ত তাণ্ডব চালায়। কিন্তু তাঁরা পুলিশের কোনো সহায়তা পাননি। বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশন কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক বঙ্কিম বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের উপস্থিতিতে মন্দির ও বড়ুয়াপাড়াগুলোতে আগুন দিয়েছে উগ্রবাদীরা। একই সঙ্গে লুটপাট চালায় তারা। রিসসো কোসেকাই বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলের পরিচালক বাবুল বড়ুয়া বলেন, শনিবারের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। রামু থানার পুলিশ ওই দিন কী করেছিল, তা তদন্ত হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।
রামুর সুগত বড়ুয়া জানান, সেদিন রাতে রামু সদরে মাত্র চার-পাঁচজন পুলিশকে তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। তিনি আরো জানান, এর পর থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল আসতে থাকে। রাত ১১টায় শ্রীকুল এলাকায় দেড়-দুই শ লোক রাস্তায় মিছিল করে। সাড়ে ১১টায় মিছিল থেকে পূর্ব মেরংলোয়ার প্রবীণ শিক্ষক সুগত রঞ্জন বড়ুয়ার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় একটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে তিন পুলিশ সদস্য সেখানে উপস্থিত হন। তাঁরা ঘটনার সময় হামলাকারীদের বাধা না দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ওই এলাকার আপন বড়ুয়া জানান, হামলার সময় পুলিশ সদস্যদের সহায়তা চাওয়া হলে তাঁরা বলেন, আপনারা নিরাপদ স্থানে চলে যান। এর পরপরই হামলাকারীরা পার্শ্ববর্তী শ্রীকুলের চেরংঘাট রাখাইন প্যাগোডায় হামলা চালায়। সেখান থেকে একটি দল এসে আগুন লাগিয়ে দেয় লালচিং বৌদ্ধবিহারে। এ সময় বিহারের পাশের বাসিন্দা ও চট্টগ্রাম মহসিন কলেজের ছাত্র সাজু বড়ুয়া রামু থানার ওসি এ কে নজিবুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করেন, কিন্তু ওসি ফোন ধরেননি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিন পুলিশ সদস্যকে সাহায্যের অনুরোধ জানালেও তাঁরা কোনো ভূমিকা রাখেননি। পুরো দুই ঘণ্টা ধরে মৈত্রীবিহার, লালচিং, সাদাচিং, সচিত্র মহাজনের পারিবারিক মন্দির এবং পাশের বড়ুয়াপাড়ায় হামলা, লুটপাট ও আগুন দেওয়া হলেও পুলিশ সেখানে আসেনি। থানায় ফোন করেছিলেন শ্রীকুলের বাসিন্দা ও কক্সবাজার সরকারি কলেজের ছাত্র বাপ্পু বড়ুয়াও। তিনি বলেন, ঘটনার রাতে প্রশাসনের কেউ আসেনি।
কক্সবাজার সদর-রামু আসনের বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য লুৎফুর রহমান কাজল গতকাল কালের কণ্ঠকে এ প্রসঙ্গে বলেন, 'গত শনিবারের এ রকম ধ্বংসলীলার জন্য জেলা ও পুলিশ প্রশাসনই সম্পূর্ণভাবে দায়ী। ঘটনার প্রাথমিক অবস্থা থেকে মধ্যরাতে পুরোপুরি অবস্থায় পৌঁছা পর্যন্ত হাতে যথেষ্ট সময় ছিল, কিন্তু প্রশাসন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। আমি নিজেও তাঁদের দুজনের (জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার) সঙ্গে যোগাযোগ করে ফোর্স পাঠাতে অনুরোধ করেছিলাম।' তিনি বলেন, আগামী দিনে এ ধরনের ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য জাতীয় স্বার্থেই এ রকম নিষ্ক্রিয়তার নেপথ্যের কারণ খুঁজে বের করা দরকার। কাজল জানান, রাত ১২টার দিকে রামু উপজেলা নির্বাহী (ইউএনও) কর্মকর্তা মিসেস দেবী চন্দ তাঁকে মোবাইল ফোনে রামুতে উত্তেজনা সৃষ্টির কথা জানিয়ে ঘটনাস্থলে আসার অনুরোধ জানান। তিনি গাড়িতে করে রাত সাড়ে ১২টার দিকে রামু চৌমুহনীতে পৌঁছে দেখেন, একটি প্রতিবাদ সভায় রামু উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরোয়ার কাজল বক্তব্য দিচ্ছেন। সেই প্রতিবাদ সভায় তিনি নিজেও যোগ দিয়ে জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান।
লুৎফুর রহমান কাজল বলেন, 'আমি রামু চৌমুহনীতে পৌঁছার পরই রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রতিবাদ সভায় এসে পৌঁছান। প্রতিবাদ সভায় তখন ক্ষুব্ধ মানুষের উপস্থিতিও বেশ লক্ষ করা যায়।' তিনি বলেন, 'সেখানেই আমি হাফেজ আবদুল হককে মোবাইল ফোনে ডেকে নিয়ে আসি। এই হাফেজ আবদুল হকই গত জুন মাসে কক্সবাজার শহরের একটি হোটেলে গোপন জঙ্গি বৈঠক করার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। তবে আমি এ তথ্য জানতাম না।'
সেদিন রাতে কক্সবাজার শহর থেকে বাস, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলে অনেক রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় লোকজনের রামুর সহিংস ঘটনায় যোগ দেওয়ার নেপথ্যে তাঁর হাত ছিল বলে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে কাজল বলেন, 'আমি একাই রামুতে গিয়েছিলাম। লোকজনকে রামুতে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমার সংশ্লিষ্টতা নেই।'
রামুর বৌদ্ধপল্লীতে ঘটনার জন্য প্রশাসনকে দায়ী করে রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরোয়ার গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রশাসনের কর্মকর্তারা পাত্তা না দেওয়ায় আজ রামুর হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলনক্ষেত্র চুরমার হয়ে গেছে। রম্যভূমি রামুর খ্যাতি রয়েছে এক প্লেটে বসে হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিমদের খাবারদাবারের জন্য। সেই খ্যাতি আমরা আজ হারালাম প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে।' তিনি বলেন, 'রামু থানা থেকে প্রত্যাহার হয়ে যাওয়া ওসি নজিবুল ছিলেন অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। তিনিই সবচেয়ে বেশি দায়ী এ ঘটনার জন্য। আমি ওসিকে বারবার অনুরোধ করেছিলাম ফোর্স বাড়ানোর জন্য, কিন্তু তিনি আমার কথায় পাত্তাই দিতে চাননি। এখন মনে হচ্ছে, পুলিশের এই ওসি এ রকম একটি ঘটনা নিজেই চেয়েছিলেন।'
উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরোয়ার বলেন, রাত সাড়ে ৩টার পর পরিস্থিতি যখন শান্ত হয় তখনই জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে আসেন। রামু সদরেই রয়েছে সেনাবাহিনীর গ্যারিসন, বিজিবি ও র‌্যাব। তাদেরও সেদিন যথাসময়ে ডাকা হয়নি। তিনি বলেন, 'শনিবার রাতের ঘটনাটি একদম পরিকল্পিত ছিল। তা না হলে হামলাকারীদের হাতে অস্ত্র থাকার কথা নয়। আমি যখন মন্দিরে আগুন দেওয়ার সময় বাধা দিচ্ছিলাম তখন একজন হামলাকারী ড্যাগার দিয়ে আমাকে হত্যার চেষ্টা চালায়। আমার কাছে পিস্তল থাকায় নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছি।' এ সহিংসতার নেপথ্যে অনেক দিনের পরিকল্পনা কাজ করেছে বলে তিনি মনে করেন।
রামু কালীমন্দিরের ব্রাহ্মণ সুবীর চৌধুরী বাদল গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, রামু থানার প্রত্যাহার হয়ে যাওয়া ওসি নজিবুল একই থানায় এর আগে সাব ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি কোনো সময়ই সংখ্যালঘুদের ভালো চোখে দেখেননি। শনিবারের ঘটনাই তার প্রমাণ।
রামুর খুনিয়া পালং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল গণি গত শনিবারের ঘটনা প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, সেদিন রাতে তাঁদের এলাকায় মসজিদের মাইকে লোকজনকে ধর্মীয় উন্মাদনা দিয়ে ডাকা হয়েছিল। এ কারণেই লোকজন ছুটে আসে রামু সদরে।
বিজিবির চট্টগ্রামের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল জিল্লুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা যথাসময়ে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের ডাক দেওয়া হয় মধ্যরাতের পর। আমরা যেতে যেতে সব শেষ হয়ে গিয়েছিল।' রামু সেনা গ্যারিসনের একজন কর্মকর্তাও একই কথা বলেন।
প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সেই রাতে খবর পাওয়ার পর আমি (তখন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, রাজস্ব) রামুতে ছুটে গিয়েছিলাম। তখনো মনে হয়নি, পরিস্থিতি এ রকম খারাপ হবে। তার পরও জেলা শহর থেকে ১৫ জন করে দুই দফায় ৩০ জন পুলিশ ফোর্স পাঠানো হয় রামুতে।' তিনি জানান, জেলা ও পুলিশ প্রশাসন ঘটনা সম্পর্কে এক প্রকার অন্ধকারে ছিল থানার ওসি নজিবুলের কারণে। ওসি নজিবুল পরিস্থিতির ভয়াবহতা জানাননি। জানালে এ রকম ভয়াবহ পরিস্থিতি হতো না। উল্লেখ্য, তখনকার কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জয়নুল বারী ঘটনার এক দিন পরই চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে কক্সবাজার ত্যাগ করেন।
শনিবারের ঘটনার ব্যাপারে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আসলে এ রকম একটি ঘটনা ঘটবে তা কল্পনাও করা যায়নি। কেননা কক্সবাজারের আটটি উপজেলার মধ্যে রামু উপজেলার ইতিহাসই হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। এখানে কোনো সময় এ রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু সেই স্থানে এমন একটি ভয়াল ঘটনা ঘটবে- তা শুধু আমি কেন কেউই ভাবতে পারেননি। তদুপরি একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর এখন আমি আর কিই-বা বলতে পারি!'

No comments:

Post a Comment