Saturday, December 11, 2010

টিআইয়ের সমীক্ষায় বাংলাদেশঃ প্রশাসনে দুর্নীতি জেঁকে বসলে মাত্রা কমবে কী করে?

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) সাম্প্রতিক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। জনগণের অভিমত ও অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিমাপক প্রতিবেদনটিতে দেখা যাচ্ছে, দেশে দুর্নীতির শীর্ষে রয়েছে পুলিশ। আর তার পরই আছে জনপ্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও বিচার বিভাগ। রাষ্ট্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত থাকার অর্থ দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম দুর্বল হয়ে পড়া আর পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানও দুর্বল হওয়া। সরকার ও প্রশাসনে যদি দুর্নীতির আখড়া হয়, তাহলে সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি প্রশ্রয় পেতে বাধ্য।

গত ২৬ অক্টোবর টিআই প্রকাশিত দুর্নীতি ধারণা সূচকে দেখা যায়, আগের বছরের সাপেক্ষে বাংলাদেশের দুর্নীতি-পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে দুর্নীতি আগের মতোই চলছে। এর আগে কয়েকবার বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নের লজ্জা পেতে হয়েছিল। এবারের সমীক্ষায় পাওয়া তথ্য দুর্নীতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাই জাগায়। সমীক্ষায় ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, এ দেশে গত তিন বছরে দুর্নীতি বেড়েছে। আর রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান উপাদানে দুর্নীতির এই প্রকোপ থেকে ধারণা করা যায়, বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী নয়, বরং দুর্নীতিবান্ধব পরিবেশই বিরাজ করছে।
দুর্নীতি নামের এই ব্যাধি সুশাসন ও উন্নয়নের প্রতিবন্ধক, গণতান্ত্রিক বিকাশ রুদ্ধকারী। জনসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঘুষের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। তার পরও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না। তবে আশার কথা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ৯০ শতাংশ উত্তরদাতা দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ে শামিল হতে চান। অন্যদিকে তাঁদের ৯৫ শতাংশই এ লড়াইয়ে অবতীর্ণ সহকর্মী বা বন্ধুদের সহায়তা করতে আগ্রহী। আর ৯৩ শতাংশ মনে করেন, সাধারণ মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ে বড় পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
দেশ থেকে দুর্নীতি বিতাড়িত করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সরকারের দায়বদ্ধতা এবং আন্তরিক সদিচ্ছা। প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ মানুষ দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকার ও রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নির্ভরতার কথা বলেছেন। দুর্নীতি প্রতিরোধে অন্য সব প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারকে স্থান দিয়েছেন তাঁরা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি দমনের বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করার অঙ্গীকার ছিল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে। কিন্তু তা করা হয়নি। বরং আইন সংশোধনের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা হ্রাস করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করে একে আরও কার্যকর করতে হবে। দুর্নীতিবাজ যেন পার পেয়ে না যায়, তাও নিশ্চিত করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সরকারের সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য হলো, পুলিশ ও জনপ্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। এসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য এদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ব্যবস্থা আরও সুদৃঢ় করা আবশ্যক। দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ, পেশাদারি জনপ্রশাসন, সত্যিকার অর্থে স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনো বিকল্প নেই।
তা ছাড়া জনগণকে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত করা দরকার। জনমনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে সচেতনতা দেখা যাচ্ছে, তাতে দুর্নীতিবিরোধী লড়াই সঠিকভাবে পরিচালনা করলে সাফল্য আসবেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের লড়াই করার অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়লে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো আপস নয়, অব্যাহতভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

No comments:

Post a Comment